ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গুরুত্বপূর্ণ আড়াই বছর সময়...

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১১
গুরুত্বপূর্ণ আড়াই বছর সময়...

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় একটা কথা বলেন:তার সরকার জনগণের শাসক না, সেবক-খাদেম। খুব ভালো কথা।

কিন্তু আজকাল আর সবক্ষেত্রে এটা কী তিনি মানেন? না মানেন তার মন্ত্রীরা? মানলেতো মানুষ কী চায় বা বলে তা একটু আমল পাত্তা দেওয়া দরকার না কী?

চলতি সরকারের খেয়াল-মর্জি এই কিছুদিন আগেও এমন ছিলোনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় বসার পরও সবকিছুতে মনে হচ্ছিল আগের চেয়ে তথা ৯৬’র সরকারের চেয়ে অনেক চেঞ্জড। পরিণত।

আড়িয়ল বিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে নতুন এয়ারপোর্ট করতে চেয়েছিল সরকার। আড়িয়ল বিলের চারপাশের সব এমপি আওয়ামী লীগের। কিন্তু তারা এর মাঝে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতে এলাকায় যে একটা বিশাল এয়ারপোর্টের মতো স্থাপনা হবে, যার মাধ্যমে বদলে যাবে গোটা এলাকার অর্থনৈতিক জীবনচিত্র, সে ব্যাপারে এলাকার লোকজনকে উদ্বুদ্ধ-সম্পৃক্তও করতে পারেননি। তাই বিলের জায়গায় স্বপ্নের বিমানবন্দর স্থাপনের বিরুদ্ধে উল্টো পাবলিক ক্ষেপে যায় বা ক্ষেপানো হয়! সরকারও জেদাজেদিতে না গিয়ে বললো ঠিক  আছে, ওখানকার মানুষ যেহেতু চাইছে না, বিমান বন্দর ওখানে না, অন্যখানে হবে। সরকারের এমন একটি একোমডেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ খুব পছন্দ করেছিল। জনগণের সেবক একটি  নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারতো এমনি হওয়া উচিত, তাই নয় কী?

কিন্তু এরপর যে কোথায় কী যে গোলমাল হয়ে গেল যে, সরকার আর পাবলিকের কথা শুনতে চায় না! কথা বললে বা কথা একটু পছন্দ না হলে, পারিষদবর্গসহ ক্ষেপে যায়, অথবা মুখে যা আসে তাই বলে। প্রশ্ন তুলে, এমন করে কথা বলার কারন কী? বিএনপি-জামায়াতের আছর নাতো! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-বানচালের ষড়যন্ত্র নাতো, বা এই সুশীল নামধারীরা আগে অমুক অমুক সময়ে কোথায় ছিলেন, ইত্যাদি।

আরে বাবা এই সুশীলরাতো আগে সবকিছুতে আওয়ামী যা করেছে বা বলেছে সে পক্ষে থেকেছে। এমন কী শায়খুল হাদিসের সঙ্গে যখন ফতোয়া চুক্তি হয়, কবীর চৌধুরী, শাহরিয়ার কবীরদের মতো কয়েকজন ছাড়া আওয়ামী লীগ মনে কষ্ট পাবে মনে করে কিছুই বলেননি। এরপরও সবাই চেয়েছেন বিএনপি আর যাতে ক্ষমতায় ফিরতে না পারে। আশা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে অন্তত বিএনপির মতো স্বেচ্ছাচারী আচরণ করবে না।

কিন্তু এবার ক্ষমতায় ফেরার পর মূলত শেয়ার বাজারের ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন চেহারার শুরু! এরপর লিমন, এরপর আবুল মন্ত্রী, `কম খান` ফারুক খান, গণবিরোধী ও সবশেষ দেশের সাংবাদিক-মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী  শাহজাহান খান ইস্যুতে পাবলিক সেন্টিমেন্ট সরকার জানার-বোঝার চেষ্টা করেছে, ‘জনগনের সেবক সরকারের’ এমন আচরণ-প্রমান যেন পাবলিকের সামনে নেই। উল্টো নানাকিছুতে যেন শুরু হয়েছে পাবলিককে ভুল বোঝা, কটাক্ষ অথবা ভয় দেখানোর বিপদজ্জনক প্রবনতা!

আগেরবার আওয়ামী লীগ সরকার বিপদে পড়ার বড় একটি কারণ ছিল শেয়ারবাজার কেলেংকারি! এবারেও কী তাই ঘটল! এবার সরকার ক্ষমতায় আসার পরের কিছুদিন থেকে শেয়ারবাজার ফুলেফেঁপে ওঠা শুরু করে। দেশে যার সঙ্গে যখন কথা বলি সে শেয়ার বাজারে লগ্নির জন্য টাকা চায় বা সেখানে টাকা লগ্নি করার পরামর্শ দেয়। ওখানে টাকা তিনদিন রাখলেই নাকি ফুলেফেঁপে তিনগুন!

এমনিতে নিজে শেয়ার মার্কেট বুঝিনা, এর উপর আবার একটা ডিক্লেয়ার্ড করাপ্ট ইকনমির দেশে যেখানে নিজস্ব স্থিতিশীল শিল্পও যথেষ্ট নেই, সেখানে একটা সুষ্ঠু, মোটাতাজা শেয়ার মার্কেট কী করে চলা সম্ভব, তাও কোনদিন মাথায় কুলোয়নি। ঢাকার প্রিয় একজন একটি ব্রোকার হাউসের নোয়াখালী অফিসের দায়িত্ব নিয়ে সেখানে চলে গেছেন, তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও সরল-কনভিন্সড বললেন, হ্যাঁ, এবার সবকিছু এমন সুষ্ঠু সতর্ক চলছে যে কারও কোন দুই নম্বরী করার সুযোগ নেই!

সেই শেয়ার বাজারেই আবার ঘটে গেল মহা দুই নম্বরীর ঘটনা! নানামহল থেকে বলা হলো নতুন কেলেংকারি-জালিয়াতিতে ফতুর হয়ে গেছেন কমপক্ষে ৩৩ হাজার বিনিয়োগকারী। সেই ফতুর বিনিয়োগকারীদের আহাজারি-কান্না নিয়ে একটা লেখা ছাপার পর সরকার সমর্থক প্রিয় একজন বললেন, আপনার তথ্য ঠিক না। ক্ষতিগ্রস্তদের পরিমান ১০-১২ হাজারের বেশি হবেনা। বল্লাম, ঠিক আছে, ক্ষতিগ্রস্ত মনে করুন দশ হাজার। এদের সিংহভাগ নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের সমর্থক, দল ক্ষমতায় আছে, হাতে একটু টাকাপয়সা আছে বলে, আরেকটু লাভের আশায় শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে এসেছিলেন। কিন্তু এই ক্ষতিগ্রস্ত-ফতুর ১০ হাজার পরিবার কী আর কোনদিন আওয়ামী লীগগে ভোট দেবে?

যিনি আওয়ামী লীগের বা সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব নিয়ে লেখাটি বস্তুনিষ্ট না দাবি করতে এসেছিলেন, তিনি জবাব দিতে পারেননি বা এসবের কোন জবাবও এদের কারও কাছে নেই।

এরপর শেয়ার কেলেংকারি নিয়ে একেরপর এক আরও যত ঘটনা ঘটল বা এখনও ঘটছে এর কোনটাতেই বলা যাবেনা যে সরকার জনগণের সেবকের কাজ বা আচরণ করছে! কেলেংকারি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হলো দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে মোটামুটি সবার কাছে গ্রহনযোগ্য, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম খালেদের নের্তৃ্ত্বে। কিন্তু কেলেংকারির সরকার সমর্থক নায়করা প্রকাশ্যে সরাসরি পিছু নিল তার বিরুদ্ধে!

ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্ট জমা দেবার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বললেন, ওদের হাত অনেক লম্বা। তিনি কিছু করতে পারবেন না। রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হবে। এভাবে এবারের সরকারের আমলের বৃহত্তম অর্থনৈতিক কেলেংকারির প্রতিকারের সমুদয় দায়-দায়িত্ব সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীকে চাপিয়ে দিয়ে যেন গা বাঁচাতে চাইলেন অর্থমন্ত্রী! আর পাবলিক দেখল কিছুই করলেন না প্রধানমন্ত্রী! অথবা পারলেন না!

উল্টো কথিত দরবেশ চাচার নেতৃত্বে চিহ্নিত মুনাফা লুটেরারা পিছু নিয়েছে ইব্রাহিম খালেদের! তারা জোটবদ্ধ হয়ে উল্টো তার বিরুদ্ধে মামলা দিল। পারলে রাস্তাঘাটে ধরে মারে আর কী!

কটি গণতান্ত্রিক সরকারের দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইব্রাহিম খালেদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, আগামিতে তার মতো কোন ভদ্রলোক আর এ ধরনের দায়িত্ব নেবেন কিনা সন্দেহ! কী কারণে জনগণের সেবক সরকার শেয়ার কেলেংকারির হোতাদের ধরলোনা, বিচার করলোনা, এ প্রশ্নও তাই কারও মন থেকে আজ অবধি যায়নি। যে প্রশ্ন আগামি নির্বাচনের ভোটের বাক্সে গিয়ে পৌঁছবে জেনেও কেন তা আমলপাত্তা দেওয়া হলোনা, সে প্রশ্নের উত্তরও জানলোনা কেউ! সুষ্ঠু পরিবেশ আজ অবধি ফিরলোনা শেয়ার বাজারেও!

দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা ছিল বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। দশটাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলা না হলেও, মানুষ অন্তত আশা করেছে চালসহ নিত্য ভোগ্যপণ্য সব তাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে থাকবে। গত তত্ত্বাবধায়কের আমলে বিডিআর’এর দোকানের মাধ্যমে চালসহ নানাকিছু নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির চেষ্টা হয়েছে। বিডিআর’এর দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনেছেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যা মতিয়া চৌধুরী। সে ছবিও দেশি মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে।

তেমন নির্দিষ্ট নির্ধারিত মূল্যে চাল বিক্রি এখনো চালু থাকলেও বাজারের আগুন অবস্থা আমজনতার নাগালের বাইরে কেন সে ব্যাপারে আজও যৌক্তিক ব্যাখ্যা সরকারের কাছ থেকে আসেনি। বানিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান সরকারের বাকবাকুম তথা বেশি কথা বলা মন্ত্রীদের অন্যতম। শেয়ার কেলেংকারির পিছনে মন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের নাম আসলেও আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানীতে তার কোন সমস্যা পোহাতে হয়নি!

বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন বানিজ্যমন্ত্রী! কিন্তু সিন্ডিকেট কেন তিনি ভাঙ্গতে পারেননা, তার সমস্যা কোথায়, তা কখনো বলেননি বা স্পষ্ট করতে পারেননি। উল্টো একবার ফাউলটকের মতো বলে বসলেন, বাজার পরিস্থিতির জন্য মিডিয়া দায়ী, সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লিখে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান ইত্যাদি!

আর পাবলিক দেখল এই বানিজ্যমন্ত্রী এমন কুফা যে তিনি যেদিন বাজারের যে পথ দিয়ে হাঁটেন সেদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। অতএব তেলের দাম, চিনির দাম সহ নিত্য ভোগ্যপণ্যের একটিও এখন আর পাবলিকের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নেই!

এখানে এখন বাজারে ঘোষনা দিয়ে চিনি-তেলের সংকট তৈরি করা হয়! সরকার এসব পণ্যের দাম ঠিক করে দেয়, কিন্তু ব্যবসায়ীদের কেউ মানে না। এসব নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে কঠিন সমালোচনার মুখে বানিজ্যমন্ত্রী হঠাৎ একদিন যা বলে ফেললেন তা অবশ্য বাংলাদেশের বানিজ্যমন্ত্রীদের ইতিহাসে ‘ফারুক খানের বানী’ হিসাবে এরমাঝে জায়গা করে নিয়েছে!

বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ বানিজ্যমন্ত্রী হঠাৎ একদিন পাবলিককে কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বসেন! যেখানে পাবলিকের স্বাভাবিক খাবার-দাবারের কোন ব্যবস্থাই নেই, সেখানে বানিজ্যমন্ত্রী বললেন, কম খান, কম খান! এই ঐতিহাসিক বানী সূত্রে এরমাঝে তার নামও হয়ে গেছে ‘কম খান ফারুক খান’! বিষয়টি নিয়ে সরকারি লোকজনের বিব্রত অবস্থায়, আরও এক বিব্রত হবার মতো ওহী নাজেল হয়! দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ওহিতে বলা হয়, বানিজ্যমন্ত্রীকে সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে, কারন তিনি নাকি সৎ ব্যক্তি! অতএব আর ‘তাহারে কে পায়’? ‘অতএব এখন এমন একজন সৎ বানিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে পাবলিকের পকেটকাটার কাজ মহাসমারোহে চলিতেছে’!

ঝালকাঠির রাজাপুরের গরিব কলেজ ছাত্র লিমন র্যাবের ভুলের গুলিতে পা হারাবার পর থেকে যা ঘটল তাতে দেশের সব মানুষতো অবাক! যেখানে পুরান ঢাকার নিমতলীর আগুনে পোড়া সর্বস্ব হারানো তিনকন্যাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেয়ে হিসাবে গণভবনে ধুমধাম করে বিয়ে দেন, সেখানে লিমনের মতো শতশত ছাত্র বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের টাকায় পড়াশুনা করে, সেখানে লিমন ইস্যুতে কেউ আর যেন আওয়ামী লীগের সরকারকে চিনতে পারেন না!

এ ইস্যুতে একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, একবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মিডিয়ার সামনে জনগণের উদ্দেশে মিথ্যা বলেন, তাতে পাবলিক আরও অবাক-বিস্মিত হয়ে ভাবে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সরকারকে! তাহলে যে পরবর্তনের আশায় গত নির্বাচনে পাবলিক বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল সে পরিবর্তন তথা বিএনপির সঙ্গে পার্থক্য কোথায় থাকল আওয়ামী লীগের?

উল্টো প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মিডিয়াকে দায়ী করে বললেন, যারা লিমনের বিষয়টি নিয়ে বেশি হৈচৈ করছে তারা র্যাবকে ধংস তথা র্যাব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত! সত্যি কী তাই মিঃ উপদেষ্টা? সেই র্যাব কী এখন আছে না নেই? তাহলে লিমন ইস্যুতে বিবেকের দংশনে প্রধানমন্ত্রী কেন বিবৃতিটি দিয়েছিলেন? দেশের প্রধানমন্ত্রীর যে বিবৃতি পরে আপনারা তাকে প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিলেন?

প্রত্যাহার করা বিবৃতিটি পরে বিশিষ্ট সাংবাদিক এ বি এম মুসার লেখার মাধ্যমে পড়ে ফেলেছে দেশের মানুষ! সেটি প্রত্যাহারের মাধ্যমে আপনারা কী দেখাতে চেয়েছেন যে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও আপনারা বেশি শক্তিশালী? লিমন ইস্যুতে ব্যক্তি শেখ হাসিনা হয়তো প্রত্যাহার করা বিবৃতির গুনে একদিন ইতিহাসের দায়মুক্তি পাবেন। কিন্তু প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী পাবেন? যে দায় তাঁকে তাঁর এসব উপদেষ্টা ভারবাহীরা কাঁধে তুলে দিয়ে রেখেছেন!

বাজারে জিনিসপত্রের অকল্পনীয় আগুন দাম, শেয়ারবাজার কেলেংকারির পর যে ইস্যুটি দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থাটি মানুষজনকে নাড়া দিয়েছে। সারাদেশ জুড়ে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে পার্লামেন্টে আলোচনা হয়। কিন্তু না যোগাযোগ মন্ত্রী,  না প্রধানমন্ত্রী তা কানে তোলার বা আমলপাত্তা দেবার চেষ্টা করেছেন! কিন্তু গত ঈদের আগ মূহুর্তে যখন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, সড়ক দূর্ঘটনায় তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের অভাবনীয় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেঁপে-কেঁদে উঠল জনগণ, পার্লামেন্টে আর্তনাদ করে উঠলেন সরকার দলীয় এমপিরা, অযোগ্য-অথর্ব, ব্যর্থ  যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠল সংসদে, তখন যেন আর তা অবজ্ঞা-অবহেলা করা গেলনা!

এরপর সবাই দেখলেন দেশের রাস্তাঘাট ঠিক করতে বৈঠকে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী! জরুরিভাবে তিনি বাজেটের বাইরে অতিরিক্ত ৬৯০ কোটি টাকা ছাড় করালেন! যেন এসব দোষ একটাও যোগাযোগমন্ত্রীর না! তার! এরপর কাজ শুরু হয়ে গেল রাস্তা মেরামতের! যে মন্ত্রী কোনদিন সচিবালয়ের বাইরে কোন একটা রাস্তা দেখতেও বের হননি, তিনি চলে গেলেন কালিয়াকৈর সড়ক দেখতে। তিনি কমলাপুর রেলস্টশনে মানুষ দেখতে যান, যেখানে যেদিন যান সেখানে একটা উল্টাপাল্টা কথা বলেন, তা নিয়ে নিউজ হলে উল্টো ভয় দেখিয়ে বলেন, তাকে যারা ধাক্কা দিতে চেয়েছে তাদের পরিণতি ভালো হবেনা! সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থা নিয়ে দেশজুড়ে আগুন এক পরিস্থিতিতে ঘি ঢালার মতো কাজ করেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো ‘গরু ছাগল চিনলেই তাকে লাইসেন্স দিতে হবে’ দাবি করেন সরকারের নৌমন্ত্রী! এরপর যোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে তার পদত্যাগের দাবিযুক্ত হলে তিনিও মিডিয়ার বিরুদ্ধে এমন অসহিষ্ণু ভূমিকা নেন যেন, তাকে অ্যাসাইনমেন্টটি সরকারই দিয়েছে! সত্যি কী তাই?

নতুবা কোন সাহসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দাওয়াত করা মিডিয়ার লোকজনকে তিনি সেখান থেকে বের করতে নেতৃত্ব দেবার ধৃষ্টতা দেখান? এরপর এই নব্য আওয়ামী লীগার পরিবহন শ্রমিক নেতার পক্ষ নেন সেখানে উপস্থিত আরও সব মন্ত্রী? সেখানে সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাবারই কী দরকার ছিল?

বা এমন একটি অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টির কী দরকার ছিল বা এসবের প্রতিক্রিয়া কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে তা কেউ ভেবে দেখেছেন কী? কই শেখ হাসিনার ধানমণ্ডি অফিস বা আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গেতো মিডিয়ার এমন সমস্যা কখনোই সৃষ্টি হয়না অথবা হয়নি! সাংবাদিকদের সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম, এমন কী সবার প্রিয় মৃণাল দা’রা কিভাবে বড়ভাই, বন্ধুর মতো সম্পর্ক বছরের পর ধরে রক্ষা করে চলেছেন, তাদের কাছেও যদি এই কচিকাঁচার মন্ত্রীদের কোচিং’এর ব্যবস্থা করা হতো তা সরকারের ভালো করতো না কী?

সবশেষ উইকিলিকসের নথিতে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের স্বচ্ছতার প্রশ্ন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তারবার্তার সূত্রে প্রকাশের পর ক্ষমতা ধরে রাখতে আবুল যে মরিয়া ভূমিকায় নেমেছেন, এর পিছনে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের সমর্থন আছে কী? আবুল মন্ত্রী প্রথম দাবি করে বললেন তিনি সৎ, কারন দুদকের সার্টিফিকেট তার পকেটে আছে! এরপর দুদক সূত্রে খবর বেরুল এমন সার্টিফিকেট তারা কাউকে কখনো দেয় না।

অথবা এরপর যদি প্রশ্ন আসত দুদকের সার্টিফিকেট আর কোন কোন মন্ত্রীদের পকেটে আছে বা প্রধানমন্ত্রীর আছে কী? তাহলে পুরো বিষয়টি কেমন দাঁড়াত? বা প্রশ্নের জবাব সঙ্গে রাখতে অন্য মন্ত্রীদের যদি আবুলের মতো সার্টিফিকেট যোগাড়ে দুদকের সেগুনবাগিচা অফিসে লাইনে দাঁড়াতে হতো তা একটি উৎকট আন্তর্জাতিক খবর তৈরি করতো কীনা? এমন ক্ষমতা পাগল একজন মন্ত্রীকে থামানোর দায়িত্ব কার?

সরকারের এই ক্ষমতা পাগল মন্ত্রীর পাগলামো সবশেষ গড়িয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পর্যন্ত? হঠাৎ মন্ত্রী বললেন, তাঁর কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ঢাকা অফিসে জমা দিয়েছেন! সেখান থেকে সার্টিফিকেট আসার পর জানা যাবে তিনি গোলাপ ফুলের মতো কত পবিত্র! এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সির জবাবে কী বলা হয়েছে,  তা খেয়াল করা হয়েছে কী?  ট্রান্সপারেন্সি বলেছে তারা যদি সবকিছু পরীক্ষা করে দেখতে যায় তাহলে তারা যখন যে নথি চাইবে তা দিতে হবে এবং তারা প্রয়োজন মনে করলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মেও হস্তক্ষেপ করবে!

তা এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভার কোন সিদ্ধান্ত আছে কী? বা এমন আগামীতে যদি অন্য সব মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রও চাহিবা মাত্র ট্রান্সফারেন্সিকে দেবার দাবি বা প্রশ্ন ওঠে তা করতে সরকার প্রস্তুত কী? পুরো বিষয়টিবা কী চেহারা-সুরত তৈরি করবে বা করছে সরকারের? এই ট্রান্সফারেন্সি না প্রতিবার দূর্নীতি রিপোর্ট দেবার পর সরকারি তরফে না বরাবর বলা হয় মিথ্যা মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!

এখন হয়তো আবুল মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করায় পার্লামেন্টের সরকার দলীয় সিনিয়রদের শেখ হাসিনার হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী বলে থামানো যাচ্ছে, শহীদ মিনারের নিরীহ ভদ্রলোক প্রতিবাদকারীদের গোয়েন্দা হয়রানির মাধ্যমে তাদের কষ্ট দেয়া, কাঁদানোর কাজটাও সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু এই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে পাগল হয়ে ওঠা আবুল-শাহজাহানদের থামাতে পরে কোন গোয়েন্দার সংস্থার দরকার হবে? চিহ্নিত ব্যর্থ গণবিরোধী এসব মালকে আঁকড়ে ধরে রেখে শেখ হাসিনার সরকারের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ আড়াই বছর মানুষকে আস্থায় রেখে যথাযথ কাজ করে যাওয়া সম্ভব কী? না তার দরকার আছে? এসব প্রশ্নের জবাবতো সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই চাইবেন, তাই নয় কী? এসবের কে কে তাঁর জন্য আর্শীবাদ অথবা অভিশাপ প্রমানিত, কে কে তার কাছে রত্ম আর কে কে বোঝা প্রমানিত, পাবলিক কী ভাবছে তা বুঝেশুনে দ্রুত সিদ্ধান্তটি তাকেইতো নিতে হবে তাই নয় কী? আর কিন্তু হাতে সময় মাত্র আড়াই বছর! গুরুত্বপূর্ণ এই আড়াই বছর সময়--!

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।