পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ কবুল তথা আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, সে জন্যে তাকে ধন্যবাদ। সরকারের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্যে এ রকম একটি সাহসী সিদ্ধান্তের দরকার ছিল।
কারণ স্বপ্নের সেতুটি আমাদের বাস্তবের জন্যে জরুরি দরকার। কথা ছিল সেতুর কাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে শেষ হবে। কিন্তু এখন সেটির কাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে শুরু করা যায় কিনা সেটি নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। এমনভাবে ঝুলে পড়েছে মেট্রোরেলসহ আরও অনেক লম্বা স্বপ্ন দেখানো সব প্রকল্প! যানজটসহ হাজার সমস্যায় নাকাল দেশের মানুষজন সরকারের দেখানো এসব স্বপ্নে আস্থা আনতে চেয়েছে! কিন্তু নানান বাস্তবে সেসব স্বপ্নের অনেক কিছু এরই মাঝে ধুসর-পাণ্ডুর!
যদিও এখন অবধি এ সরকারের সময়ে এর আগে পদ্মাসেতুর মতো বড় কোন প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। আর এখন পদ্মা সেতুর টেন্ডারসহ প্রাক-প্রস্তুতির দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’এর লোকজন সোজা ঢাকা এসে আঙ্গুল উঁচিয়ে অভিযোগ তুলে সব বলে যাচ্ছে! এ নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে কানাডায়! আর এসব নিয়ে এখানে-ওখানে যত কথা হচ্ছে, সব অভিযোগ-সন্দেহের তীর যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের দিকে! উইকিলিকসের নথিতেও বেরিয়েছে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারিয়ার্টি এই যোগাযোগমন্ত্রীর সততা প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে ওয়াশিংটনকে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।
এখানে নানা কারণে দেশের মানুষও এর মাঝে লোকটাকে মন থেকে মাইনাস করে ফেলেছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও কী অদৃশ্য কারণে তাকে প্লাস অথবা নিরাপত্তা দিতে আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে, তা দেশের মানুষকে জানানো সম্ভব কী? পদ্মা সেতু অথবা দেশের স্বার্থের চেয়ে এই একটা লোকের মন্ত্রিত্বে থাকা না থাকা কী বড়? এসব প্রশ্নের সাফ সাফ জবাব দিতে দেরি করলে পরে কিন্তু আম ছালা দুটোই যাবে।
কারণ এখনও কিন্তু দেশের মানুষ মনে করে এবং বিশ্বাস করে আগের সরকারগুলোর তুলনায় এখনও দেশের সরকারের আপার লেভেলে দুর্নীতি কম হচ্ছে। কিন্তু এই বিশ্বাসের পলেস্তরায় যদি কোনও কারণে একবার ফাটল দেখা দেয়, তবে তার জরুরি মেরামত করার বা সেটি ভেঙ্গে ফেলে সবকিছু নতুন করে বানানো বা গড়ার কোনও বিকল্প আছে কী?
বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ প্রসঙ্গে আবুল মন্ত্রী এক মিডিয়াকে বলেছেন, দেশে তার বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে। সে কারণে হয়ত সন্দেহ করা হচ্ছে তাকে । এখন সারা দুনিয়াজুড়ে কোথাও কাউকে নিয়ে মিডিয়ার তথা জনগণের সন্দেহ দেখা দিলে কী করতে হয়, এভাবে বেহায়ার মতো পড়ে থাকতে হয়? না নিজের থেকে মান-ইজ্জত নিয়ে সরে যেতে হয়? অথবা এমন বেহায়া লোকজনকে সরিয়ে দিতে হয়, প্রযুক্তি আর ডিজিটাল এই যুগে কী সেটি কাউকে কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে দিতে হয়? এখন আমি সারাদিন সবকিছুতে ডিজিটাল ডিজিটাল চিল্লালাম, কিন্তু আমার কাজকর্ম সব পুরনো এনালগ স্টাইলেই চলল, তাহলে এমন নিয়ত করা চলনেওয়ালাদের কাছে পৃথক-ব্যতিক্রমী কিছু আশা করার আছে কী?
এখন যেখানে একজন মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কাজকর্ম তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হলো, কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ মন্ত্রী যথারীতি বহাল স্বপদে! এটি মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীকে হাতপা বেঁধে মন্ত্রণালয়ের কর্নধারের দুর্নীতি খুঁজে বের করতে বলার ধৃষ্টতার নামান্তর নয় কী? বা এমন তদন্ত কী বিদেশি গৌরিসেন যারা টাকা দেবে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? সাধারণত বিদেশে এমন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা প্রশ্ন উঠলে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সে লোকটি নিজের থেকেই সরে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু আমাদের হায়াজ্ঞানের অভাব আছে, সেখানে অন্তত অভিযোগের তদন্ত বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে প্রিয় আদরের মন্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য ছুটিতে বা অন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কী যেত না?
এখন দাতারা পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এখন দেশে মহাসমারোহে চলা দুর্নীতি নিয়ে তাদের টাকায় চলা ট্রান্সপারেন্সিসহ নানা সংস্থাকে দিয়ে ফি-বার্ষিক বলার ব্যবস্থা করলেও এখনই এই মূহুর্তেতো কিছু বলছে না! সারাদিন বলছে দেশের মানুষ। কিন্তু একবার ক্ষমতায় চলে যেতে পারলে সে সব কে কেউ আর আমল-পাত্তা দিতে চায় কী? বা পাত্তা না দিয়ে উপায় কী আছে?
এমনিতে দুর্নীতির রোগটি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসাবে আমাদের ব্যক্তি আর সমাজ জীবনের বেশ গভীরে প্রোথিত। আমাদের যার যে যোগ্যতা নাই তাই আমরা চাই। আত্মীয়তা, তদবির অথবা ঘুষ যে কোনও কিছুর বিনিময়ে হলেও তা চাই ই চাই! নিজের আয় যদি মাসে কুড়ি হাজার টাকা হয় জীবন সাজাই পঞ্চাশ-ষাট হাজার বা এর চেয়েও বেশি টাকায়। অতএব বাকিটা আমরা দুর্নীতির মাধ্যমে ম্যানেজ করতে গিয়ে ফাঁকি দিই নিজেকে, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে। নিজের পাওয়ার অথবা আরও চাই আরও চাই’র তাগিদে বঞ্চিত করি আরেকজনকে তার প্রাপ্য থেকে। এসব আশেপাশের লোকজনের কাছে মোটামুটি ওপেন-সিক্রেট হলেও থোড়াই কেয়ার করি! এসবের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রবাহের মূল ইস্যুটিই দুর্নীতি।
সাবেক বিএনপি-জামায়াতের সরকারের আজান দিয়ে দুর্নীতির প্রতিবাদ হিসাবেই কিন্তু গত নির্বাচনে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। সেই ২০০১-২০০৬’র বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলেও দেশে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচবছর নির্বাচন করতে পারেননি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। সাজা উপভোগের পরও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কয়েক কোটি টাকা জমা দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে গারদের বাইরে।
কিন্তু সর্বশেষ তারেক-কোকোকেন্দ্রিক দুর্নীতির মচ্ছবে এরশাদও যেন হয়ে যান শিশু! সে কারণে মামুন-ফালুরাও অবিশ্বাস্য অংকের টাকার মালিক হতে পেরেছেন! সর্বোপরি তারেক-কোকোদের দুর্নীতি, দেশের বাইরে অর্থ পাচারের যে ঘটনা-ঘটেছে তা এর আগে কখনো শোনা যায়নি।
বর্তমান সরকার এসবের প্রতিকারের শপথে ক্ষমতায় বসলেও দেশটিতো আর ফেরেস্তায় ভরে যায়নি! শাসকদলের নিচের স্তরের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতার প্রথমদিন থেকেই সাবেক ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির পকেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করেন। ছাত্রলীগের নামে শুরু করা হয় টেন্ডারসহ নানান সন্ত্রাস! যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামেও চলেছে একই কাজ।
একটা দল ক্ষমতায় আসার পর ভূঁইফোড় নানান সংগঠন পয়দা হয়। ছাত্রদল-ছাত্র শিবিরের সুযোগ সন্ধানী সুযোগ সন্ধানীরাও বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা স্লোগান দিয়ে হালুয়া রুটির ভাগাভাগিতে সামিল হয়ে যেতে দেরি করেননি। সরকার এসবের সম্মিলিত দুর্নীতি সন্ত্রাস কখনো শক্ত হাতে দমন করেছে। কখনো এড়িয়ে গেছে অথবা দমন করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সত্য হলো এখন আর শুধু মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না। ক্ষমতাসীন দল না করলে চাকরি বা টেন্ডার-ব্যবসা বা কাজ পাওয়া যায় না (কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবশ্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির নামে ঐকমত্যের ভিত্তিতেও চুরি-ভাগাভাগির কাজ চলে)।
আবার শুধু দল করলেই এখন আর চাকরি বা ব্যবসা পাওয়া যায় না। সঙ্গে নগদ নারায়ণ তথা ঘুষ অথবা উপঢৌকনও লাগে! ব্যবসার বিনিয়োগের মতো একটা চাকরি বা ব্যবসার জন্যে দলের কর্মী-সমর্থকরা ঘুষও দিতে রাজি! কিন্তু টাকাটা এমন জায়গামতো দিতে চান যাতে কাজ হয়। সে আশ্বাস-বিশ্বাসের জায়গাটিও এখন আর দেশের মানুষের করায়ত্ত নেই! রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যুগে অসহায় হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষজন!
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর নবগঠিত মন্ত্রিসভার কচিকাঁচাদের নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও আশা করতে চেয়েছে নতুনদের অনেকে অন্তত ১৯৯৬-২০০১’র আওয়ামী লীগ সরকারের কারও কারও মতো অথবা বিএনপি-জামায়াত জমানার মতো টানা দুর্নীতিতে নেমে পড়বেন না। এখনতক শেখ হাসিনার এই সরকারের বেশিরভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে দৃশ্যত দুর্নীতির তেমন অভিযোগ নেইও।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কিছু কিছু অপক্ক অথবা বেফাঁস কথা নিয়ে সমালোচনা হলেও সাহারা খাতুন দুর্নীতিগ্রস্ত, এমন সরাসরি অভিযোগ কেউ করেন না বা করতে পারবেন না। অথচ আমজনতা জানে বাংলাদেশের দুর্নীতির অন্যতম উৎকৃষ্ট ডিপোর নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার মন্ত্রী দুর্নীতি না করলেও সেখানে দুর্নীতি হচ্ছেনা বা পুলিশের সবাই ফেরেস্তা বা জনগণের সেবক হয়ে গেছেন, এমন দাবিও বুকে হাত রেখে কেউ করতে পারবেন না। এরকারণে সাহারা খাতুনকে বলা চলে তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করতে ব্যর্থ।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বিরুদ্ধেও সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কিন্তু তারা যেসব অফিস চালাচ্ছেন সে সব আর প্রশাসন কী দুর্নীতি্মুক্ত? মোটেই না।
শিক্ষাভবনে হাতেনাতে দুর্নীতি ধরেছেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু সেতো একবার মাত্র! আমরা যারা মফস্বলের স্কুল-শিক্ষকদের কাছ থেকে পড়াশুনা করে এসেছি, আমাদের সেই সব শিক্ষক, যারা আমাদের দুর্নীতি না করতে শিখিয়েছেন, নিজেরা দুর্নীতি করেননি, কিন্তু ঢাকায় শিক্ষাভবনে কোনও কাজের জন্য এসে সিন্ডিকেট দুর্নীতির হাতে জিম্মি হয়ে কেঁদেকুটে ঘুষ না দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নিতে পেরেছেন বা পারছেন, এমন ঘটনা খুব বেশি আছে কী?
কৃষি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন কয়জনের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র তাতো উভয় মন্ত্রী আর দেশের মানুষজন জানেন ভালো! আবার শেয়ার কেলেংকারির মতো দিনে দুপুরে মানুষের পকেট কাটার হোতাদের ধরে বিচার এড়িয়ে যাবার দায়মুক্তির কোনও সুযোগ অর্থমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর আছে কী?
ঠিক এভাবে প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর বাণিজ্য, যোগাযোগ আর নৌপরিবহন মন্ত্রীদের দুর্নীতিমুক্ত মনে অথবা দাবি করতে চান তাহলে পাবলিক কিন্তু মনে মনে তাঁকে গাল দেবে। এখন মনে মনে গাল দিলেও ভোটের সময় কিন্তু শোধ নিতে সত্যি সত্যি বিরুদ্ধে ভোট দেবে! তখন ভোটটি সে কাকে দিচ্ছে বা এর পরিণতি কীভাবে ভোগ করতে হবে তখন সে হিতাহিতজ্ঞানও তাদের আর থাকে না। এমন জিম্মি বাংলাদেশের মানুষ! সে আওয়ামী লীগের ওপর রাগ করে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসায়, আবার বিএনপির ওপর রাগ করে ক্ষমতায় বসায় আওয়ামী লীগকে। তেমন নির্ভরযোগ্য কোন থার্ড চয়েসের কেউ তাদের সামনে নেই।
এখন যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর জাতীয়-আন্তর্জাতিক শ্যেন দৃষ্টি যেটি পড়েছে সেখানে বিষফোঁড়া অপসারণে দেরি করলে কিন্তু সরকারের ক্ষতিই শুধু বাড়বে। আর এখানে সরকারের লাভের কোন চান্সই নেই। শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি! অতএব পাবলিক ছাড়াও দাতাদের সন্তুষ্ট তথা পদ্মাসেতু চাইলে আবুল মন্ত্রীকে অতিদ্রুত সরাতেই হবে।
ভোটার পাবলিকের মন জয় করতে চাইলে দ্রুত বিদায় করতে হবে এই ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রী আর মিডিয়াবিদ্বেষী গণবিরোধী নৌপরিবহনমন্ত্রীকে। আর প্রধানমন্ত্রী এসবের কোনকিছুকে আমল-পাত্তা না দিয়ে যদি এই তিনজনকেই শুধু চান,তাহলে সে ওপেন চয়েসটিও তার আছে।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৩১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১১