নতুন একটা আল্লাহর মাল পয়দা হয়েছে মন্ত্রিসভায়! ইনার নাম মজিবর রহমান ফকির। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী।
সেই পীরের নাম অবসরযুক্ত এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী! বিএনপি-জামায়াতের কালো আমলের সেই বহুল আলোচিত ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! বেফাঁস কথার কারণে তখন তার চাকরি যায়! বাবার কোলে থাকা ছোট একটি মেয়েশিশু নওশীন ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হবার পর শোকার্ত পরিবার, দেশবাসীকে অবাক করে আলতাফ হোসেনের সেই বিখ্যাত ‘ফাউলটক’ মন্তব্যটি ছিল, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে!’ তখন দেশজুড়ে কথা ওঠে তাহলে, আপনার মতো অকর্মা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আর থাকার দরকার কী, অতএব আল্লাহর হুকুমে আপনি চলে যান। পরে তাকে পত্রপাঠ বিদায় হতে হয়!
এখন আবার আলতাফ হোসেন চৌধুরীর নতুন মুরিদ (!) মজিবুর রহমান ফকির ফতোয়া দিয়ে বলেছেন, ‘ধর্মমতে মুসলমানদের কোনো অকালমৃত্যু নেই। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর তাদের জন্য নির্ধারিত সময়েই মারা গেছে। তাদের জন্য দুঃখ লাগতে পারে। তবে এটাই বাস্তব। ’
সত্যি কী তাই? তাহলে আল্লাহ পাক মানুষকে নিজস্ব ভাগ্য নির্ধারনের জন্যে চেষ্টা-কাজ করে যেতে বলেছেন কেন? তেমন চেষ্টা ছাড়া কী নন্দলালের মতো ঘরে বসে এমপি-মন্ত্রী হয়ে গেছেন মজিবর রহমান ফকির?
ঢাকায় ‘বাংলাদেশে জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগীকরণ জাতীয় কর্মশালা’য় সরকারের স্বাস্থ্য আর পরিবারকল্যাণের দায়িত্বে থাকা এই প্রতিমন্ত্রী আরেকটা ফাউলটক করেছেন! জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ দেশে ওই ফাউলটকের মাধ্যমে তিনি অবাক বলতে চেয়েছেন, সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির সঙ্গেই তিনি একমত না! তাইতো তিনি সেখানে নিঃসংকোচ বলতে পেরেছেন, ‘মা-বাবা শিক্ষিত হলে সন্তান বেশি হলে সমস্যা নেই। তিনি তাঁর মা-বাবার নবম সন্তান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর মা-বাবার নবম সন্তান ছিলেন!’
এমন দায়িত্ব প্রাপ্তদের কী বলা যায়! ডাইরেক্ট পাগল শব্দটি ব্যবহার করলে তার নিয়োগ কর্তৃপক্ষ, পদপদবীর অসম্মান হয়ে যাবে কী? বাংলাদেশের সরকারি অফিসের একটি পিয়নের চাকরি পেতেওতো ঘুষের পাশাপাশি গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স লাগে! সেখানে তার চারিত্রিক আর অপরাধের আমলনামার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি কিনা, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এর চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল কিনা এসবের ডিটেইলস খোঁজা হয়!
কিন্তু এমন ফকিরের মতো লোকজনকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেবার সময়ে দেশের কমন কিছু রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ-পরিকল্পনা-কর্মসূচি সম্পর্কে তার বা তাদের ঈমান ঠিক আছে কীনা তা জানার-দেখার কোন ব্যবস্থাও কী নেই? না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে শেখ হাসিনার, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে খালেদা জিয়ার প্রতি ইস্পাত কঠিন আনুগত্য আছে কীনা, কন্ট্রোলে থাকবে কীনা এসবই কী মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্সের মূল যোগ্যতা?
শেখ হাসিনা আশা করি এ বিষয়টি তথা তার এসব পাগল সামলানোর বিষয়টি সিরিয়াসলি নেবেন। মন্ত্রী-দায়িত্বশীলরা ফাউল টক করার পর মিডিয়ায় আসলে উল্টো মিডিয়ায় কথাটি ঠিকমতো আসেনি অথবা বিকৃত করা হয়েছে, এসব বলে পার পাওয়াটা সেই পুরনো অভ্যাস। এই ডিক্লেয়ার্ড ডিজিটাল সময়েও পুরনো সব এনালগ অভ্যাস চালু থাকা কী ভালো?
তার সংগঠনের সদস্য গাড়ি চালকরা গরু ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দিতে হবে এটি বলেছিলেন নৌপরিহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। দেশের টিভি মিডিয়াগুলোর কাছে তার সেই বক্তব্যের রেকর্ড আছে। আর এখন ফাউল টক নিয়ে সমালোচনা দেখে মন্ত্রী সবাইকে ডাহা মিথ্যা সাজিয়ে বলছেন, তিনি নাকি এমন কথা কোথাও বলেননি! তিনি নাকি বলেছেন রাস্তার পাশে গরু-ছাগলের ছবি থাকতে হবে! তাহলে যেন তার ঘরানার মন্ত্রীরা গাড়িতে যেতে যেতে ছবিগুলো দেখে মনে রাখতে পারবেন, ‘ইহার নাম গরু, ইহার নাম ছাগল!’ এ যেন আজব একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছে আমাদের সবার স্বপ্নের দেশখানি!
তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরদের মৃত্যু সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর ফতোয়া শুনে শাহেদ সাদরুদ্দিন নামের একজন শহীদের সন্তান ফেসবুকে তাঁর মন্তব্যে লিখেছেন, ‘এই ফকির কি এখন পুত্রহারা জাহাঙ্গীর কবীর নানকরে গিয়া এই বয়ান দিতে পারবেন? দিলে পরে, নানক তারে হের গাড়ির ভেতর বোমা মাইরা `মৃত্যুর নির্ধারিত দিন` বুঝায়ে দেবে না! । ফকির এর এই সব শুধু আমগো মতো পাবলিকের সাথে!’ বলাবাহুল্য দায়িত্বশীলদের দায়িত্বকাণ্ডজ্ঞাহীন ফাউলটক সম্পর্কে এসব মানুষের অসহায় ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া।
একদল বলা শুরু করেছেন, তাহলে ফকির প্রতিমন্ত্রীর কথার শ্রী অনুসারে কী বঙ্গবন্ধু নির্ধারিত সময়ে মারা গেছেন? বা শেখ হাসিনার ওপরও কী গ্রেনেডে হামলা হয়েছে আল্লাহপাকের নির্ধারিত সময়ে? মুক্তিযুদ্ধের শহীদেরাও আল্লাহ’র হুকুমে এমন নির্ধারিত সময়ে যেহেতু মারা গেছেন, কাজেই এত ঘটা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করারই বা কী দরকার!
আল্লাহ’র নির্ধারিত সময়ে যেহেতু লোকজন সব মারা যাবে, সেহেতু সরকারি টাকা-পয়সার মচ্ছব করে এত হাসপাতাল চালানো বা সেগুলার দেখভালের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ফকিরের মতো প্রতিমন্ত্রীর পোষারইবা কী দরকার?
জনসংখ্যার ভারে দেশের অবস্থা এমনিতেই ভয়াবহ নাজুক। ছোট্ট পিচ্চি একটা দেশে পনের কোটির বেশি মানুষ! আর বাংলাদেশের চেয়ে পয়ষট্টি গুণ বড় দেশ অস্ট্রেলিয়ায় জনসংখ্যা আড়াই কোটি! এদেশের প্রায় একশভাগ লোক শিক্ষিত, গোল্ড-ইউরেনিয়ামসহ যত মূল্যবান সম্পদ হতে পারে সব এখানে আছে। কিন্তু এসবকিছুর পরেও লোকজনকে টাকা পয়সা দিয়েও জনসংখ্যা বাড়াতে পারে না এদেশের সরকার!
এখানে একটা মায়ের পেটে একটি সন্তানের ভ্রুন তৈরির সাথে সাথে যেখানে সেই অনাগত শিশু আর মায়ের যাবতীয় দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র। বাচ্চার জন্ম উপলক্ষে শুধু মা’ না বাবার জন্যেও প্যাটারনাল ছুটি, পেমেন্টের ব্যবস্থা করে। বাচ্চার জন্মের খবর পাবার পর খুশি হয়ে অটোমেটিক্যালি মা-বাবার ব্যাংক একাউন্টে জমা করে ৬ হাজার ডলার বেবি বোনাস।
এরপর এই বাচ্চাটির ষোল বছর বয়স অবধি দিয়ে যায় বাচ্চার খাবার- বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে ভরনপোষণের সব খরচ, বাচ্চার ৬ বছর বয়স অবধি মা, অথবা কেরিয়ারের প্যারেন্টাল পেমেন্ট, বাচ্চার ফ্রি শিক্ষা-চিকিৎসা, ষোল বছর বয়স হবার পর থেকে ইয়থ অ্যালাউন্স এতকিছু দিয়েও এরা এখানকার মানুষজনকে সন্তান জন্মদান তথা জনসংখ্যা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে না। কারণ সবদিক সামলে চলতে ব্যয়বহুল জীবনের সংগ্রাম তাদের কাছে এতই বিশাল!
আর বাংলাদেশে কিছু দেওয়া ছাড়াই উল্টো সবার এইম ইন লাইফ হলো বাচ্চা পয়দা করা! এর অন্যতম কারণ হিসাবে বলা হয় আসলে স্ত্রী সঙ্গম ছাড়া বাংলাদেশে দম্পত্তিদের সহজ-বৈধ বিনোদন বলতেও কিছু নেই! এখন আবার কল্পনাতীত যানজট, রাস্তায় বেরুলে অ্যাক্সিডেন্ট সহ নানান ভয় বেড়ে যাওয়াতে লোকজনের মুভমেন্টও কমে গেছে! এরপরও শিক্ষিত পরিবারগুলো জীবন সংগ্রাম আর বাচ্চাদের উপযুক্ত মানুষ করার ব্যয়সহ নানা সংকটের বৃত্তান্ত কিছু জানে বলে বাচ্চা বেশি নেয় না। দেশের সিংহভাগ শিক্ষিত দম্পতির পরিবারও তাই অটোমেটিক ছোট হয়ে এসেছে।
আর গ্রামশহরের শিক্ষার আলো বঞ্চিত মানুষ, বস্তিবাসী, চরাঞ্চলের মানুষজন অথবা মোল্লা প্রভাবিত পরিবারগুলো ‘মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি’ নীতিতে বেশি সংখ্যক বাচ্চা নিয়ে বিপদে পড়ছেই।
বাংলাদেশে ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগানটি কোন আইনও নয়! বা এটিকে বাধ্যতামূলক আইন করার মতো ধর্মীয়-সামাজিক অবস্থাও নেই! চীনে এর মাঝে আইন করে একসন্তান নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক ধবংস থেকে বাঁচাতে তেমন আইনের জরুরি দরকার। কিন্তু সে অবস্থা দেশে নেই। মোল্লারা আজান দিয়ে সরকার ফেলে দেবে!
আর যেখানে অলরেডি ফকিরের মতো খোদ একজন দেশের পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ই আলো(!) করে বসে আছেন, সেখানে মোল্লারই বা আর দরকার কী! ইনিতো দেশের শিক্ষিত দম্পতিদের পরিবারগুলোর নয়টা দশটা বাচ্চা নেয়ার পক্ষে!
বাংলাদেশের ফতোয়াবাজ মোল্লারা যেমন বিবি তালাকের মন্ত্র ছাড়া আর কিছু পড়ে না বা জানে না, তেমনি ইনি রবীন্দ্র সাহিত্যের আর কিছু না জানলেও রবীন্দ্রনাথের পিতামাতার নয় সন্তান ছিল এটিই কী শুধু জেনেছেন-পড়েছেন! আবার রবীন্দ্রনাথের সময়টি সম্পর্কে কাণ্ডজ্ঞানের যে তার যথেষ্ট অভাব, সেটি প্রকাশ পেয়েছে তার পরবর্তী মন্তব্যে! তেমন একটি নয় সন্তানভূক্ত পরিবারের সদস্য দাবি করার মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রী ফকির হয়ত ভেবেছিলেন এতে করে তিনি নিজেকে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারবেন! কিন্তু এর মাঝে যে প্রকাশ পেয়ে গেল সন্তান বেশি হলে প্রয়োজনীয় যত্মআত্তির অভাবে যে এর কোনটি এই ফকিরের মতো আনব্যালেন্সড, কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়, তা তাঁকে কে বোঝাবে?
সরকারের সময় যত কমছে তত যেন বাড়ছে এসব আনব্যালেন্সড কথাবার্তার মন্ত্রীদের সংখ্যা! এদের একজন আবুল মন্ত্রীর এখন আকাশে মেঘ দেখলেই ডর করে! এতে নাকি ধুয়েমুছে যাবে তার সাজানো সব রাস্তা! মৌসুমী বায়ুর প্রচন্ড শক্তিশালী প্রভাবের কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত কবে কম হয়েছে? বা বৃষ্টিপাত কম হওয়াটাই কী অস্বাভাবিক না? আর আগে যখন ধুমসে বৃষ্টি হতো, অতিবৃষ্টির প্লাবনে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যেত না? এখন যেন অন্য ভয় আবুল মন্ত্রীর! নিম্নমানের মেটারিয়েলস দিয়ে দুর্নীতির কাজের রাস্তাঘাটের সারবৃত্তান্ত ধরা পড়ে যাবার ভয়! কিন্তু এসবের দুর্নীতি দেখা হয় না!
আরেকজন ফারুক খান বাজার সামলাতে পারেন না আর ভোটার পাবলিককে নসিহত করে বলেন, কম খান, কম খান! বিনা পরীক্ষায় চালকের লাইসেন্স দেবার বেআইনি আবদারটি প্রতিবাদের মুখে পড়লে রাস্তার পাশে গরু-ছাগলের ছবি লাগানো অদ্ভূত দাবি তোলেন শাহজাহান খান। আর লেটেস্ট স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলে দিলেন ৯-১০ টা করে বাচ্চা নাও, নো চিন্তা, সবার নির্ধারিত সময়েই মৃত্যু হবে! এমন একটি অস্বস্তিকর প্রতিকারহীন অবস্থায় পড়ে গেল আমাদের দেশ?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময় ১৩২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১১