জীবন-জীবিকায় ছদ্মনামে একটি সিনে ম্যাগাজিনে ফিল্ম রিভিউ করতাম। চুরাশি-ছিয়াশি সালে প্রতি মঙ্গলবার সকালে জোনাকীতে সাংবাদিকদের জন্যে আয়োজন করা হতো বিশেষ শো।
সালটা মনে নেই। জনপ্রিয় নায়ক ফারুক অভিনীত ‘জনতা এক্সপ্রেস’ দেখে রিভিউটা সম্ভবতঃ এইভাবেই শুরু করেছিলাম, ‘ছাগল দুই জাতের। এক জাত সাড়ে বারো টাকা টাকায় টিকেট কেটে আমার মতো ঢাকাই ছবি দেখে। অন্যজাতের গলায় থাকে দঁড়ি বাঁধা। ’ পরিচালক ও কাহিনীকারদের কিছু বলতে ইচ্ছা হয়নি। এতোই নিম্ন মানের ছিলো সেই নির্মাণ।
চলচ্চিত্র নাকি সমাজের জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি ও দর্পণ। বলিউডের ছবির গা-হিম করা ভিলেনদের চেয়েও নাকি পাঁচ কাঠি সরস বাস্তবের ভারতীয় ভিলেনরা। ‘স্বপ্নবাজ’ বাঙালিদের চলচ্চিত্রে তাই এক সময় দেখতাম নবাবী জমানার ধুম-ধাড়াক্কা। জায়নামাজে মোনাজাতরত প্রায় অর্ধনগ্ন নায়িকার আকুল কান্নায় সাপ ছুটে আসা। দৌঁড়ে আসা দরবেশ। আকাশ ভেংগে নামা প্রাণঘাতি বজ্র। জমানা পাল্টেছে। এখন ‘হুমায়ূন ফরিদী’দের ‘ভিলেন’ অভিনয় ছাড়িয়ে যায় যুগপৎ ফিল্ম ও বাস্তবের ভিলেন ‘ডিপজল’দের ’নেচারাল’ অভিনয়ে। সেন্সর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞার কারণে পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীদের ‘চরিত্র’ এখনো মূল ভিলেনের মর্যাদা পায়নি। চলচ্চিত্রের মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদেরা এখনো ‘দিলদার’দের মতো ভাঁড়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভাঁড়’ ও ছাগলদের বেশ কদর! গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-যানজটে নাকাল বিব্রত-বিধ্বস্ত বাঙালির জীবনে বিনোদন অতি সামান্য। বোকাবাক্সের ‘নাঁকি-প্রেম, ছ্যাবলামো ও অবাস্তব হাস্যরসের পাশাপাশি থাকে অফুরন্ত হাসির ভাঁড়ার মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদেরা। তাদের ‘উদ্ভাবিত’ তত্ত্ব, তথ্য ও মতবাদে জাতি দারুণ ’উজ্জ্বীবিত’ হয় । বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষক ঢাকা সফরের সময় সাংবাদিকতা বিভাগের এক বাংলাদেশী শিক্ষককে বলেছিলেন, তোমাদের রাজনীতিতো নিজেই এন্টারটেইনিং, তোমাদের পত্রিকায় আবার আলাদা করে বিনোদন পাতা কেন? অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, যারা নিয়মিত রাজনীতির খবরাখবর রাখেন, তাদের অন্য কোনো বাড়তি বিনোদনের খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার জমানায় এক মন্ত্রী বাসস-এর বিশেষ সংবাদদাতাকে সিরিয়াসলি বলেছিলেন, ‘আপনাদের পত্রিকাটি আজোবধি চোখে পড়লো না রে ভাই। ’ বঙ্গবন্ধুর জমানায় বেশ কিছু ভাঁড় গাড়িতে পতাকা উড়িয়েছিলেন। এক মন্ত্রী এক কার্টন ট্রিপল ফাইভের (সিগারেটের নাম) বদলে লিখতেন, ‘স্টপ পুলিশ ভেরিফিকেশন, ইস্যু পাসপোর্ট’। খালেদার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলতাফতো বিখ্যাতই হয়ে গেছেন, ‘আল্লাহর মাল’ নামে। বাবরের খ্যাতি ‘লুকিং ফর শত্রুজ’-এ। সাবেক এক ছাত্রনেতা উপমন্ত্রী হবার পর, মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রকাশ্যে ’স্যার’ ডেকে আমলাতন্ত্রকে দিয়েছিলেন ’মর্যাদা’। প্রয়াত মাহবুব আলম চাষী মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ‘খাকি’ দেখলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে কষে সালাম ঝাড়তেন, কাঁধের ব্যাজের দিকেও নজর দিতেন না। ‘দুই নারীর মিলনে কিছুই হয় না’ মতবাদের প্রবক্তা বেগম জিয়ার আচঁলে মুখ লুকানো শাহ মোয়াজ্জেম এ ব্যাপারে সর্বকালের সেরা চ্যাম্পিয়ন।
হালে বাংলাদেশের মানুষেরা বিভিন্ন নাগরিক অসুবিধায় বিপন্ন-বিপর্যস্ত। দিনের বিশাল অংশ কাটে যানজটে। রাস্তায় গরমে-ঘামে আটকে থাকা মানুষগুলোকে বিনোদন দিতে বাজারে এসেছে বিভিন্ন রেডিও প্রোগ্রাম আর রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীদের ‘গোপাল ভাঁড়’ সুলভ আচরণ। কিছুদিন সরব ভাঁড় ছিলেন সদ্য প্রয়াত ‘পাজামা’খ্যাত দেলোয়ার। মাঠ কখনো ফাঁকা থাকে না। সেই ধারাবাহিকতায় জোকার আবুল একাই মাঠ দখল করার নির্মল আনন্দে কাটালেন কিছু বলে-কয়ে। হালে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন নৌ-শাহাজানকে। দু’জনের বোধশূন্য- ‘বাতচিতে’ পাবলিক বেশ পুলকিত? কিন্তু একই মুখ-একই স্টেরিওটাইপড বিনোদনে বিরক্ত বাঙালির নাগরিক-সামাজিক জীবনে এলো নতুন ব্রান্ডের এক ’ফকির’ । উনার যুগান্তকারী মতবাদের নাম, ‘কোনো মৃত্যুই অকাল নয়। ’ ইনি আবার দেশের স্বাস্হ্য দেখেন। দেখেন ‘পরিবার পরিকল্পনা’। কিন্তু বেচারার কথা-বার্তারই ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’ দরকার আগে।
‘ফকির’ নামের একজন ভাঁড় যে মন্ত্রিসভা আলোকিত করে আছেন এই তথ্যই অজানা ছিলো। ভাগ্যিস তিনি ’বয়ান’ করেছেন! না-হলে জানাই হতোনা শাহ মোয়াজ্জেমের যোগ্য উত্তরসূরীও আছে!
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময় ১৪১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১১