আনন্দবাজার পত্রিকার রোববারের ইস্যুতে (১৮-০৯-২০১১) তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পেরেশান বাংলাদেশের নানা তৎপরতার কথা ছাপা হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে চুক্তি করার জন্য প্রয়োজনে কলকাতাও চলে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! এমনকি সেটি তা তাঁর নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফেরার পথেও হতে পারে!
এমনিতে খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতার কারণে কিছু কিছু ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা পত্রপত্রিকার রিপোর্টিং’এর বস্তুনিষ্ঠতা বিষয়ে ব্যক্তিগত ইমান একটু দুর্বল! প্রয়োজনে তারা গল্প লেখার বিষয়ে আমাদের অনেকের চেয়েও সিদ্ধহস্ত যথেষ্ট! এরপরও ঢাকার ডেটলাইনে লেখা আনন্দবাজারের জয়ন্ত ঘোষালের সবশেষ রিপোর্ট অথবা গল্পকে একটু আমলে নিতে মন চাইল।
আর আমাদের এখানকার আমলা কর্মকর্তারাও নিজের দেশের মিডিয়া অথবা সাংবাদিকদের যা বলেন না বা তথ্য তেমন দেন না, বিদেশি মিডিয়ার লোকজন পেলে তা আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন বা বলে কৃতার্থ হন! পারলে সব তথ্য উজার করে দিয়ে দেন! আর আনন্দবাজার বা কলকাতার বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক পেলেতো কথাই নেই! সুবিধা তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলা যায়। কষ্ট করে ইংরেজি বলা লাগে না!
সবশেষ মনমোহনের সফরে বহুল প্রত্যাশার তিস্তা চুক্তি না হওয়াতে বাংলাদেশকে হতাশা গ্রাস করেছে বেশি। ওই সফরকেও আর ঐতিহাসিক তকমাও পরানো যায়নি। তিনবিঘা করিডোর চব্বিশ ঘন্টা খোলা, তৈরি পোশাকের বড়সড় লটের ভারতীয় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলেও সবকিছু যেন তলিয়ে গেছে তিস্তার প্রাপ্য হিস্যা না পাবার হতাশার পানিতে!
কিন্তু এরপর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্য সরকারের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে বাংলাদেশের তরফে যতসব আদিখ্যেতা দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সোজা বাংলায় তা বাড়াবাড়ি! ভাটির দেশ হিসাবে অভিন্ন নদী তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের হক ন্যায্য। ভারতকে বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা চালাতে হলে, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ট্রানজিট পেতে হলে আজ হোক কাল হোক তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা তাদের দিতেই হবে। এর জন্যে আমাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে শক্ত কূটনৈতিক দরকষাকষি গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু মনমোহনের সফরের পর ঢাকার মিডিয়ায় সরকারি ব্যক্তিদের বরাতে যেসব কথাবার্তা এসেছে তাতে মনে হবে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বকীয়তার বিষয়টি জলাঞ্জলি দিয়ে তিস্তার পানির জন্য প্রতিবেশী দেশের একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে উল্টো তোয়াজের নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ! দিদি এই দিদি সেই... ইলিশ কূটনীতিসহ আরও যেসব খবর বেরিয়েছে তা একটি স্বাধীন দেশের জন্য এককথায় অসহ্য এবং অপমানকর!
এক্ষেত্রে মমতা যা দেখিয়েছেন তার কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের স্বার্থ। তিস্তা চুক্তির খসড়ার যা খবর বেরিয়েছে তাতে শুরুতে শুকনো মওসুমে নদীর ৪৬০ হাজার কিউসেক পানি মজুদ রেখে বাকি পানির ৭৫ ভাগ ভারত ২৫ ভাগ বাংলাদেশকে দেবার কথা হচ্ছিল। কিন্তু এরপর যখন সমান শেয়ারিং’এর বিষয়ে দিল্লির সাউথব্লককে ঢাকা রাজি করাতে পারে, তখনই বেঁকে বসেন মমতা ব্যানার্জি!
এসবের কারণে এখন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অফিস উল্টো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে তোয়াজের নীতি নিয়েছে তা কী ঠিক হচ্ছে? আনন্দবাজারের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ নাকি এখন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বহাল রেখে চুক্তিতে রাজি! তাহলে কী সমান শেয়ারিং ছাড়াই যেনতেন চুক্তি একটা করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে? তাই যদি হয় তাহলে এখানকার প্রতিক্রিয়া, বিএনপির সো-কল্ড ভারত বিরোধী পপুলার কার্ডের শক্তি কত শতগুণ বেড়ে যাবে, তা কী ভেবে দেখা হয়েছে?
মনমোহনের সফরের পরপর আবার বাংলাদেশের দায়িত্বশীল লোকেরা বলা শুরু করলেন তিনমাসের মধ্যে তিস্তা চুক্তি হয়ে যাবে! এই তিনমাসের ডেটলাইন তারা কোথায় পেয়েছেন? বাঁচোয়া যে, এদের সঙ্গে গলা মেলাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! তিনি বলেছেন চুক্তিটি হবে তবে তা কবে হবে তা ডেটলাইন দিয়ে বলা সম্ভব না। আরেকটি কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। তাহলো, এভাবে চুক্তি না হওয়াতে বাংলাদেশের ভালো হয়েছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। সত্যিইতো তাই নয় কী?
এখন যদি একটা যেনতেন চুক্তি করে ফেলার নিয়তে মমতার দাবিমতো পশ্চিমবঙ্গকে ৭৫%, বাংলাদেশকে ২৫% শেয়ারিং মেনে নিয়ে সাইনিং সেরিমনিটা ঢাকায় হয়ে যেত এর প্রতিক্রিয়া কী দাঁড়াত এখানে? সে কারণে দায়িত্বশীলদের আমরা অনুরোধ করি, একটু ধীরে সাবধানে চলুন। সবার আগে মাথায় রাখুন দীর্ঘ মেয়াদি জাতীয় স্বার্থ চিন্তা।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ঢাকায় মনমোহনের মুখের ওপর বাংলাদেশ বলে দিতে পেরেছে তাহলে ট্রানজিট চুক্তিও নয়। ভারতীয়রা একতরফা দাম নির্ধারণ করবে শুনে বহুল প্রত্যাশার বিদ্যুৎ চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়নি। এসব কিন্তু বিরল, অসামান্য অর্জন। বাংলাদেশ এর আগে কখনও কোনও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তথা ভারতকে মুখের ওপর এমন বলতে পেরেছে সে নজির নেই।
দেশে একটি ইলেকটেড ডেমোক্রেটিক সরকার থাকায় আর অপরপক্ষ ড. মনমোহনের মতো ভদ্রলোক থাকাতে এসব সম্ভব হয়েছে। আর মনমোহন শিক্ষিত, গণতন্ত্রমনা, একোমডেটিভ হওয়াতে যেমন তার অধীনস্ত একজন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নাখোশ করে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তি করে ফেলতে চাননি, পাশাপাশি তাদের ভীষণ দরকারি ট্রানজিট চুক্তি না করার বিষয়ে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকেও সম্মান দেখিয়েছেন। এ নিয়ে কোনও জোরাজুরি বা মানঅভিমানে যাবার চেষ্টা করেননি। মনমোহনের সফরে বাংলাদেশ নিজস্ব স্বার্থের প্রশ্নে সাহসী বার্গেনিং এর নিজের যে অবস্থান সৃষ্টি করেছে তা ধরে রাখতে হবে।
ভবিষ্যতে মনে রাখতে হবে তিস্তার পানির বিনিময়ে ট্রানজিট নয়। অভিন্ন নদী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের অধিকার। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইলে এটা আজ হোক কাল হোক তা তাদের দিতে হবে। সম্পর্ক খারাপ হলে এখানে ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের অব্যাহত বিশাল বাজার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এতে ভারতেরই ক্ষতি।
আর ট্রানজিট যেমন ভারতের দরকার, এটি আমাদের মুনাফার স্বার্থ সংশ্লিষ্টও। এতে আমাদের কত মুনাফা হবে না হবে তা দেখে আমরা শুধু ভারত না, দরাদরিতে যার সঙ্গে পোষাবে তেমন যেকোন দেশকে আমরা ট্রানজিট দেব। চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে রওয়ানা দিয়ে আমাদের জাহাজ যেমন একদেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়। এর জন্যে সংশ্লিষ্ট দেশকে পরিশোধ করে ট্রানজিট শুল্ক। বাংলাদেশ বিমানও ঢাকা থেকে রওয়ানা দেওয়ার পর গন্তব্যে পৌঁছতে যে সব দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যায় তাদেরকেও নির্ধারিত অংকের শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। ডিম না আন্ডা বিতর্কের মতো ট্রানজিট না করিডোর নিয়ে সো-কল্ড অ্যান্টি ইন্ডিয়ান ক্যার্ডের নামে ফাজলামোকে আমল দেবারও কিছু নেই।
ফাইন্যাল ফুটনোট: তিস্তা চুক্তি না হওয়াতে পাণ্ডুর হয়ে যাওয়া মনমোহনের সফরের ‘খলনায়িকা’ মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে আমাদের নেতৃত্ব কথাবার্তায় যে দায়িত্বশীল একোমডেটিভ ভূমিকা দেখিয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। আমাদের দুই নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনার বা শেখ হাসিনার প্রতি খালেদা জিয়ার কথাবার্তাও এমন যদি হতো!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১২৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১১