ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্যর্থ কুটনীতির ’শিরশ্ছেদ’

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১১
ব্যর্থ কুটনীতির ’শিরশ্ছেদ’

আড়াইশ’ গ্রাম মারিজুয়ানা কিনতে গিয়ে চৌদ্দ বছর বয়সী অজি বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ধরা খেলো ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। বিদ্যুৎ গতিতে খবরটা পৌঁছালো স্হানীয় কনস্যুলেট-হাই কমিশন হয়ে ক্যানবেরার পররাষ্ট্র দফতরে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেভিন রাডসহ অনেকের নিদ্রা চাঙ্গে উঠলো। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক মহল যোগাযোগে সরব হলো। সাত সকালেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেভিন রাড অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকদের ’মোকাবেলায়’নামলেন। জানালেন, কিশোরটি যে কোন অবস্হায় ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।

গেল বছর দেখলাম, বিন অনুমতিতে সীমান্ত পেরুনো দুই মার্কিনি নাগরিককে উত্তর কোরিয়ার কারাগার থেকে মুক্ত করতে চার্টাড বিমানে চড়ে পিয়ং ইয়ংয়ে নামলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। টানা বারো ঘন্টা ’নেগোশিয়শন’শেষে নিজ নাগরিকদের মুক্ত করে ফিরলেন বাড়ি। একই ঘটনা ঘটলো ইরানে। গুপ্তচর বৃত্তির মতো জঘন্য অপরাধের অভিযোগের পরও ইরানে আটক ছয় বৃটিশ নাগরিককে কুটনৈতিক তৎপরতায় ফিরিয়ে নিলো বৃটেন।

যুগে যুগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজ দেশের প্রবাসী নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আইনি সাহায্য সহায়তা দিয়ে আসছে। ইসরাইলতো আটক এক সৈন্য উদ্ধারে লেবাননের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলো। কুটনৈতিক সম্পর্কে ‘চিনি’র প্রলেপ দেওয়ার পাশাপাশি পররাষ্ট্র দফতরের মূল দায়িত্ব এটাই। অন্য দেশগুলো নিজ দেশের পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার জন্যেও নিবেদিত হন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?

বছরের পর বছরের বাঙালিরা ভারতের কারাগারের অন্তরালে আটকে থাকে। ভারতের মাটিতে লুকিয়ে-প্রকাশ্যে থেকে চাঁদাবাজি করে একদল দুষ্কৃতকারী। বাংলাদেশ সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী উদ্যোগ নেয় এদের মুক্ত করে আনতে? দুষ্কৃতকারীদের স্বদেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করতে? এক কথায়, কিছুই করে না।

শুক্রবার সউদী আরবে আট বাঙালির শিরোশ্ছেদ হলো গুরতর অপরাধে। জেদ্দাস্হ বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, ‘ব্যাপক কুটনৈতিক’তৎপরতা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন উনারা। শিরোশ্ছেদ হবার সংবাদটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসার আগে বাংলাদেশের শূন্য দশমিক এক শতাংশ মানুষও জানতেন না সউদী কারাগারে আট বাঙালি শিরোশ্ছেদ হবার ‘অপেক্ষায়’। দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে কখনোই কোনো সংবাদ আসেনি। অথচ একজন ফিলিপিনোর মৃত্যুদণ্ডের খবরটি আমাদের দেশের মিডিয়াতেও ফলাও প্রচার হয়েছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক দেন দরবারে ব্যস্ত। এই আটজনের ব্যাপারে ‘সৌজন্যমূলক’দু’একটা গতানুগতিক চিঠি চালাচালি ছাড়া আর কী কাজটি করেছে দূতাবাস? আন্তর্জাতিক সমর্থন বা জনমত তৈরির জন্যে কোনও প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো কি?

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা ‘আদমমন্ত্রী’ (প্রবাসীকল্যাণ) উচ্চ পর্যায়ের কোনো বৈঠকে কী মিলিত হয়েছিলেন? সংবাদ মাধ্যমগুলো পুরোপুরি ব্ল্যাক আউটে। প্রথানুযায়ী দশ পয়সার কোনো কাজ হলে আমাদের মন্ত্রীরা তিরিশ পয়সা দামি প্রেস কনফারেন্স করে নিজেদের সাফল্যগাঁথা বা অর্জনের বর্ণনা করেন। এই আটজন হতভাগ্য বাংগালীকে নিয়ে কোনো মন্ত্রীর কোনো উচ্চবাচ্য  নজরেই আসেনি। হয়তো মন্ত্রীদের জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি দূতাবাস!

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নায়েবেরা (এক্ষেত্রে দূতাবাস ও কনস্যুলেট) প্রবাসে বাঙালিদের সুখ-দুঃখে থাকেন না। নগদ নারায়ণের বিনিময় ছাড়া উনাদের সাহায্য-সহায়তা মেলে না। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস বছরে কতজন অবৈধ বাঙালিকে ’ট্রাভেল পাস/ পারমিট’ দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে জেল এড়াতে সাহায্য করেছেন? প্রতিবেশী ভারত ও দুর্নীতিগ্রস্ত ‘তালেবানী’পাকিস্তানি দূতাবাস তাদের দেশের নাগরিকের স্বার্থে যে কোনো ‘যমুনায়’ঝাঁপ দিতে পারেন।

বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর পোস্টিং হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ’মিডল ইস্ট’ চাকুরি। দু’হাতে কামাইয়ের মানসিকতায় বিদেশে পোস্টিংয়ে যান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের বেতনের চেয়েও বেশি লাগে চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া, টিএ ডিএ। আট বাঙালির শিরোশ্ছেদের ঘটনা রোধে, আগাম জানানোর ব্যর্থতায়, আন্তর্জাতিক জনমত ও সহানুভূতি অর্জনে অক্ষম এই দূতাবাসের সবাইকে দেশে কলব্যাক করা হোক অনতিবিলম্বে। মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হোক কী কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রজাতন্ত্রের এইসব কর্মচারী! শত অপরাধী হলেও এই আটটি তরতাজা প্রাণ কুটনৈতিক তৎপরতায় বাঁচানো অসম্ভব ছিলো না।

দলমত নির্বিশেষে আমাদের রাজনীতিবিদেরা সউদী বাদশাহদের যাকাতের টাকায় হজ্বে যান নিয়মিত। যাকাতের লেনদেনে থাকা রাজনীতিবিদেরাও যদি নিজের শততম ওমরাহর বদলে একটি করে বাংগালী প্রাণভিক্ষে চাইতেন? মিললেও মিলতে পারতো। কিন্তু ……… ?

ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com

বাংলাদেশ সময় ১০৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।