গণতান্ত্রিক অধিকারের হরতাল একসময় ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। রাজনৈতিক নেতা ও দলের আহ্বানের অপেক্ষায় হরতাল বসে থাকতোনা।
হরতালের ডাক দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার জাতীয়তাবাদী বিএনপি। উপলক্ষ্ দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জনদুর্ভোগ। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, জামায়াতের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদেই এই হরতাল। আগেও দেখেছি, বেগম জিয়ার ‘গৃহহীন’ হবার পর, জিয়া-পুত্র তারেকের মামলার রায়ের তারিখ নিকটে আসার পর বিএনপি’র দেশপ্রেম ও জনগণ প্রীতি চাংগা হয়ে ওঠে।
একেবারে দেয়ালে পিঠ না-ঠেকলে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগী দুনিয়ার মানুষ হরতালে সায় দেয় না। একেতো সরকারি ছুটিজনিত সমস্যায় শুক্র থেকে রবি টানা তিনদিন বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে, তার উপর কারণে-অকারণে হরতাল, জাতীয় অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্হা হারায়, শিক্ষার্থীদের খসে যায় মূল্যবান একটি দিন, দিনমজুরের জীবনে আরেকটি অনাহারী দিন আঁচড় কাটে, অসুস্হ মানুষ চিকিৎসার সুবিধাহীনতায় কাতরায়, দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখা প্রবাসীরা বিমানবন্দরের দালাল-টাউটদের খপ্পরে উদ্বিগ্ন প্রহর পার করে। হরতাল রাজনৈতিক নেতাদের ‘টেনশন লেনেকা নেহি হ্যায়, টেনশন দেনেক্যা হ্যায়’। সুলেখক আনিসুল হক এক লেখায় হরতালের নেতিবাচক ফলাফলের সাবলীল মনোগ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। নেতারা কী জনমতগুলো পড়েন?
প্রিয়তম মানুষ ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের আরেক কাঠি সরস বর্ণনায় হরতালের গায়ে-হলুদের আতঙ্কিত সত্যি উঠে এসেছে। হরতাল সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদের বারোটা বাজায়। কিন্তু আশ্চর্য, এরশাদের পতনের পর থেকে আজাবধি কোনো রাজনৈতিক হরতাল জনস্বার্থে হয়নি, জনগণের প্রত্যক্ষ স্বার্থ সংরক্ষণে ডাকা হয়নি, হয়েছে কোনো ব্যক্তি, পরিবার ও রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নেবার কিংবা টেনে নামাবার চেষ্টায় । রাজনৈতিক দলগুলো সরকারে থাকাকালে হরতালের বিরোধিতায় মাতে, বিরোধী দলে থাকলে হরতালে প্রেমে নিমগ্ন হয়। বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান হয় অযৌক্তিক আর সরকারি দলের ‘ভবিষ্যৎ ও সম্ভাব্য হরতাল আহ্বানের সম্ভাবনা সংজ্ঞায়িত হয়, যৌক্তিক হরতালে। ’ নিজেদের জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম ‘জায়েজ’ করতে রাজনীতিকেরা বারবার নিত্যনতুন সংজ্ঞা হাজির করেন। যৌক্তিক সংজ্ঞায় অযৌক্তিক হরতালের সহিংস তাণ্ডবে লিপ্ত হবেন?
সব রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সরকার কঠোর হাতে হরতাল দমনে সক্রিয় থাকেন। আর বিরোধী দল সক্রিয় হয় ভাংচুরের হরতালে। আইন প্রণয়ন করে চিরকালের জন্যে হরতাল নিষিদ্ধ করতে বাধা কোথায়? হরতাল আহ্বানকারীদের দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড আর পিকেটারদের এক বছরের কারাদন্ডসহ নগদ দশ হাজার টাকা জরিমানার আইন প্রণীত হলে জনগণের স্বার্থ কোথায় ক্ষুন্ন হবে?
আইন করেই হরতাল কালচার বন্ধ করা যেতে পারে। প্রতিবাদগুলো পাঁচ বছরের জন্যে বাক্সবন্দী রেখে নির্বাচনে জনগণের রায়ের মুখোমুখি করা যেতে পারে। জনরায়ের সামনে সাজানো-পাতানো ঠুনকো কিছু টেকে না---এই নির্মম সত্য বিএনপি’র চেয়ে কেউ বেশি জানে না। কিন্তু আইন যেহেতু নেই, সেহেতু বুধবার হরতালের গায়ে-হলুদে পুড়বে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদ।
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময় ২১৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১১