লেখার শুরুতেই বাংলানিউজকে ছোট্ট করে হলেও গভীর একটা ধন্যবাদ দিতে চাই পাঠক মন্তব্যের আয়োজন করার জন্য। হঠাৎ করে এই আয়োজনটা দেখে এবং পাঠকের মন্তব্যগুলো পড়ে আমার কয়েকটি জিনিসের সূত্র এক সংগে মাথায় এসে ভর করলো।
প্রথমত: এভাবে পাঠকের সঙ্গে লেখকের একটা সরাসরি যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন। এক পাক্ষিক যোগাযোগের পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক একটা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক (ধারণার আদান প্রদান অর্থে) তৈরি হলো যেটা বহু আগে গ্রিক দার্শনিকেরা প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য করেছিলেন। পাশ্চাত্যের সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলতঃ এই গ্রিক ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠার চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত; লেখকের লেখার উদ্দেশ্য সমাজটাকে সচেতন করা। তার অর্থ এই নয় যে, লেখক মাত্রই ‘সবজান্তা শমসের’। পাঠকের গঠনশীল মন্তব্যের মাধ্যমে যারা লিখছেন তারাও তাদের ভ্রান্তিগুলো জানতে পারবেন।
এবার আমার আগের লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্যের জের ধরে বর্তমান লেখায় ফেরা যাক। না বললেও পাঠক বুঝতে পারছেন ইতিবাচক নেতিবাচক দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই পেয়েছি আমার নিজস্ব মেইলে এবং বাংলানিউজের নতুন মন্তব্যের ঝোলায়। কিন্তু আজকে শুধু কিছু চুম্বক এবং গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের উপরই আলোকপাত করবো। কেউ কেউ বলেছেন, স্বাধীনতার এতো বছর পরে রাজাকার ইস্যুতে দেশকে বিভক্ত কেন।
কথাগুলো আমি সমর্থন করি। কিন্তু সমর্থন করি না দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্বান্তগুলোকে। দেশ শুধু এক ব্যক্তির কিংবা এক দলের নয়। কারো নেতৃত্বে কাজ সম্পন্ন হওয়া মানে এই নয় যে, সে সকল অধিকার পেয়েছে যা কিছু তাই করার জন্য। একজন ব্যক্তি তখনই নেতা হন যখন তার পিছনে জনসমর্থন থাকে। জনসমর্থন তখনই তৈরি হয় যখন মানুষ দেখে উক্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। এই আস্থাটাই একজন নেতার তৈরি করে নিতে হয়। অনেক যোগ্য লোক আছেন যারা শুধু এই আস্থাটা তৈরি করতে পারেননি বিধায় নেতা হতে পারেন নি। স্বাধীনতার সংগ্রামকে এই যুক্তির বাইরে দাঁড় করালে ভুল হবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া যারা অপরাধের সংগে যুক্ত তাদের এক তরফা নিজের সিদ্ধান্তে ক্ষমা করার অধিকার জনগণ কাউকে দেয়নি। তাই ঐ ক্ষমার কোন নৈতিক ভিত্তি ছিল না। তাছারা ভুল কোন সিদ্ধান্তকে ভিত্তি করে কারো অপরাধকে বৈধতা দেওয়া যায় না।
আমরা আরো দেখেছি, কিভাবে যুদ্ধের শেষের দিকে ভারতীয় সেনারা ঢুকে হঠাৎ করে কামান নিয়ে হৈ হৈ রব তুলে প্রায় স্বাধীন হবার পথে দেশটার স্বাধীনতার কৃতিত্ব ছিনতাই করে নিলো। একই সাথে ছিনতাই হলো আটককৃত পাকিস্তানী সেনারা এবং তাদের ফেলে রাখা গোলা বারুদ। এর বিনিময়ে দরকষাকষিতে ভারত পাকিস্তানের সংগে নিজেদের বন্দী সেনা বিনিময় করে আপন স্বার্থ হাসিল করলো। ওদের ফেলে রেখে গেলে নাকি মুক্তিযোদ্ধারা আক্রোশে মেরে মুরে সব শেষ করে দিতো। কই, তারাতো রাজাকারদের কচুকাটা করেনি।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, এতো বছর পরে কি রাজনৈতিক দল বা দলগুলো সেই ঐতিহাসিক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের কোনও `হ্যাঁ-না` উত্তর নেই। এর উত্তর পেতে প্রক্রিয়ার মোটিভ বিশ্লেণের দরকার আছে। এক পথ দিয়ে হাঁটলেই সবার উদ্দেশ্য এক থাকে না। একই পথে হেঁটে কেউ বাজারে গিয়ে দুধ কেনে কেউ অন্য কিছু। আওয়ামী লীগ পুরাতন অপরাধগুলোর বিচারে প্রথমেই অগ্রাধিকারভিত্তিক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যারা লক্ষ লক্ষ লোকের হত্যা, ধর্ষণ, জালাও পোড়াও এর সাথে জড়িত ছিল- সেই বিচার প্রক্রিয়াটা তাদের আগে করা উচিত ছিল। আগের লেখায় আমি বলেছিলাম, যুদ্ধপরাধীদের বিচার কোনও দলেরই রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নয়। এটা নতুন সময়ের নতুন স্বার্থের হিসেব। গত নির্বাচনে জামাতের সমর্থন পেলে হয়তো এরকমটি হতো না। যেমন এরশাদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে বেঁচে গিয়েছেন তার অপকর্মের বিচার থেকে। মাঝে মাঝে পিছলে যেতে চাইলে পুরাতন অপরাধ স্মরণ করিয়ে আবারো তাকে বাধ্য ছেলে করা হচ্ছে।
এর মানে দাঁড়ালো এরশাদের অপরাধের বিচার কোনও উদ্দেশ্য নয়, তার কখনো বিচার হলে সেটা হবে পূর্বের অপরাধকে ক্যামোফ্লেজ করে মূলতঃ তার বর্তমান অবাধ্যতার। ড. ইউনূসের বেলাতেও তাই ঘটেছিল। তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের নামে তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ভাবেসাবে প্রকাশ করেছিলেন তার টান আওয়ামীলীগের চেয়ে বিএনপির দিকে একটু বেশী। তারই খেসারত দিলেন তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রামীণ চেক খুলে ফেলে। দেখবেন যখনই সরকার কাউকে তার পথের কাঁটা ভেবেছে তখনই তার অপরাধকে সামনে এনে তাকে দমন করার একটা চেষ্টা হাতে নিয়েছে। উপরের দুটো বিশ্লেষণের আলোকে যারা জাতিকে বিভক্ত না করার পরামর্শ দিয়েছেন তাদের যুক্তি হয়তো ঠিক। কিন্তু সিদ্ধান্ত কি দু একটি দলের স্বার্থের খেলার উপরে ভিত্তি করে হবে নাকি সিদ্ধান্তের মালিক জনগণ?
স্বার্থের খেলায় বেঁচে গেলেও কিংবা ভুল সিদ্ধান্তে ক্ষমা পেলেও জনগণ তো কখনো জামায়াতকে ক্ষমা করেনি। মুক্তিযুদ্ধে যে সন্তান তার বাবা হারিয়েছে, যে স্ত্রী তার স্বামী হারিয়েছে, যে মা তার সন্তান হারিয়েছে তারা তো কেউ ক্ষমা করেনি ওদের!
দেশটা আমরা পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীন করে কোনও দলের কাছে বেচে দিইনি যে তারা যা ইচ্ছে তাই করবে। কিসের ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে এখন? রাজাকারের সাথে জনগণের ঐক্য? বীজগণিতে প্লাস মাইনাস এক হলে প্লাস হয়। কিন্তু রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কের ‘মানব গণিতে’ সেটা সব সময় মাইনাসই থাকে। তা না হলে ক্ষমা পাওয়া অপরাধীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে এই সুযোগে নিজেদের শুধরে নিত। মনে পড়ে স্বাধীনতার কতো বছর পরে জামায়াত বলতে বাধ্য হয় (ইচ্ছাকৃতভাবে বলেনি) যে, একাত্তরে পাকীদের সমর্থন ছিল একটা রাজনৈতিক ভুল। কিন্তু তারা নরহত্যার মতো অপরাধ স্বীকার করে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি আজো। তাদের হিংস্রতাকেও তারাও ধরে রেখেছে আজ পর্যন্ত। সেই সত্তরের দশকের শেষ থেকে আজো পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের হত্যালীলা থামেনি। রগকাটার মতো জিঘাংসাগুলো তারা রাজনীতিতে আমদানি করে যাচ্ছে।
অনৈক্য কারা চাচ্ছে? যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছে তারা, নাকি যারা তাদের পক্ষে সময়ের (চল্লিশ বছর পার হয়েছে) যুক্তি দিয়ে অপরাধীদের অপরাধ আড়াল করতে চাচ্ছে তারা? এই জামায়াত একবার ধানের শীষে শীস মারছে আবার নৌকায় উঠে পাল তুলছে। এই জামায়াতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় দুই দলের মধ্যে নিজেদের চর ঢুকিয়ে নোংড়া বিভেদ তৈরি করে রেখেছে। রাজনৈতিক স্বার্থের গুটি চালাচালি করেইতো এই জামাত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার দলকে বিভক্ত করে পুরো জাতিটাকেই বিভক্ত করে রেখেছে।
পরগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই হায়েনাদের বিলুপ্তি এখন সময়ের ব্যপার। এরা কখনো মূল গাছের উপকারে আসে না। বরং রস খেয়ে নিজের বৃদ্ধি ঘটিয়ে আশ্রয়দানকারী গাছের সৌন্দর্য নষ্টসহ মাঝে মাঝে দুর্বল করে ফেলে। জামায়াতি পরগাছাকে আশ্রয় দিয়ে বড় দুই দল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে তাদের সৌন্দর্য হারিয়েছে। এবং বর্তমানে বাংলাদেশে বহুদলের প্রবক্তা প্রধান বিরোধী দল জামায়াতি সংঘের কারণে জনবিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করছে। জামাতের মতো একটা ফরেইন বডির কারণে দেশ নামক দেহের ভিতরে রেখে সুস্থতা আশা করা যায় না। অচিরেই এর অপারেশন করা দরকার। এই অপারেশন হচ্ছে তাদের অপরাধের বিচার। সেটা হতেই হবে এবং এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এবার আসবো অন্য একটা যুক্তিতে। কেউ কেউ বলছেন, সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবিরকে কেন শুধু দোষা হচ্ছে? ছ্ত্রালীগ ছাত্রদল কি কম যায় দুর্বৃত্তপনায়? প্রশ্নটা সত্য এবং দুইয়ের ভিন্নতাও সমানভাবে সত্য। সব সহিংসতাই সহিংসতা এবং এর বিচার হওয়া উচিত। তবে এই যুক্তির মাধ্যমে জামাত-শিবির নিজেদের অপরাধ লুকিয়ে মূলধারায় ফেরার একটা দুর্বল চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। অপরাধ এবং যুদ্ধ অপরাধ গুরুত্বের দিক থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন। দুটোকে একই লেন্সে দেখার কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুকৌশলে যুদ্ধ অপরাধকে সাধারণ অপরাধের মাত্রায় নামিয়ে আনা। ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের অপরাধ মোটিভ হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। জামায়াত-শিবিরের মোটিভ হচ্ছে উল্লেখিত দুটোসহ যুদ্ধপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টাসহ দেশটাকে আবারো বিভক্তির পথে নিয়ে যাওয়া। সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা করার জন্য বড় দুই দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের অবশ্যই বিচার হওয়া দরকার; কিন্তু একই অপরাধ সৃষ্টিসহ একাত্তরের যুদ্ধপরাধের জন্য জামায়াত শিবিরের (পূর্বের ছাত্র সংঘ) বিচার হতে হবে অবশ্যই।
সবশেষে, বুঝতে হবে দুর্বৃত্ত আর রাজাকারের মধ্যে বিভাজনটা কোথায়। এই বিভাজন অপরাধের মোটিভে, অপরাধের মাত্রায় এবং অপরাধের গুরুত্বে। এই তিনটাতেই জামাত শিবিরের রেটিং অনেক উচ্চে।
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ১২৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১১