ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ডাণ্ডামিছিলের ফল ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
ডাণ্ডামিছিলের ফল ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন

ইংল্যান্ডে সম্প্রতি একটি গোঁড়া ডান দল মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মিছিল করতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তা করতে দেয়নি।

বাধা দিয়ে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন, প্রতিবাদে বাধা দেবার কথা নয়, যদি না সেটা আইনের বিরুদ্ধে যায়। সেখানে বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ আইনত দণ্ডনীয়। কোনও প্রতিবাদ যদি জননিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হয় অর্থাৎ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয় সেক্ষেত্রে কথা বলার অধিকার এই অজুহাতে রাম রাজত্ব কায়েম করতে দেওয়া হয় না। ইংল্যান্ডে ঘটে যাওয়া শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল পুলিশের হাতে এক ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। শুরুটা যেমনই হোক শেষ পর্যন্ত আন্দোলন লুটেরাদের হাতে চলে যায়। একটা যৌক্তিক প্রতিবাদ সহিংসতার কারণে তার নৈতিক সমর্থন হারিয়ে লুটতরাজে পরিণত হয়।

গত সপ্তাহে জামায়াত-শিবিরের যে সহিংস আন্দোলন ছিল, উপরের দুটো উদাহরণের মতোই  সেটারও কোনও নৈতিক ভিত্তি ছিল না। বরং সেটাকে বলা যায় সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠন। প্রথমতঃ যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রতিহত করতে চাওয়ার মাধ্যমে অন্যায়কে সমর্থন জানানো। দ্বিতীয়তঃ রাজপথে সহিংস আচরণ করে জনমনে ভীতি সঞ্চার করা।

এর পরপরই প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে জোটভুক্ত দলগুলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ অন্যান্য নাগরিক ইস্যুতে হঠাৎ করে হরতাল ডেকে বসে। মুখে যে কারণই বলুক না কেন হরতাল যে মূলতঃ জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সেটা সবাই বুঝেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মনের কথাতো কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। পাশাপাশি যে কারণগুলো দেখিয়ে তারা হরতাল ডেকেছে সেগুলোও যৌক্তিক। দেশে দিনে দিনে দ্রব্যমূল্যের মতো সহিংসতা, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, অপহরণের মতো মানবাধিকারের বিপর্যয় ঘটে চলেছে। একই সাথে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা তৈরী হবার আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করারও কোনও উপায় নেই। পুলিশ এবং সরকার দলীয় গুন্ডা লেলিয়ে তাও পণ্ড করে দেওয়া হয়। এভাবে দমন নিপীঁড়ণ চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থ বিরোধী হরতালের বিরুদ্ধে মানুষের কঠোর অবস্থানকে অনেকটা নমনীয় করে দিচ্ছে।

হরতাল এমনই এক তাল যে, বিরোধী দলে থাকলে এর থেকে মধু ঝরে, আর সরকারি দলে গেলে চিরতার রস বের হয়। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় না এলে মধুতো হারানো যাবে না। সে কারণে চিরতার রস খেয়েও মধুর লোভে কেউ কখনো এটাকে বন্ধ করতে আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। হরতাল যেহেতু আইনত অবৈধ নয়, তাই জনগণ যদি স্বতঃস্ফুর্ত হরতাল পালন করে তাতে সরকারের আপত্তি থাকতে পারে না। যতোক্ষণ না তারা রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টি করে। আর সহিংসতা সৃষ্টি করলেও সেটার দেখভালের দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, কোনও দলীয় কর্মীর নয়।

কিন্তু সরকারদলীয় নেতাদের হুমকি ধামকি দেখে সেটা মনে হয় না। তারা প্রতিবার ক্ষমতায় এসে দলের সাথে সরকারকে গুলিয়ে ফেলে। দলকে রাজনৈতিক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভাল। জন নিরাপত্তার কাজ দলের নয়, সেটার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট বাহিনী আছে। কিন্তু হাঁকডাক শুনে মনে হচ্ছে, মির্জা আযম, সাজেদা, জনতার মঞ্চের মখা আলমগীর, এরা সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। এদের বেআইনি, অরাজনৈতিক হুঙ্কারে পুলিশ কমিশনারের আইনি ঘোষণা কানে আসছে না। মখা বলেছেন, যারা হরতালে যাবেন তাদের যেন পাড়ায় ঢুকতে না দেওয়া হয়। এই অধিকার কি তাদের আছে? সহিংসতা কিংবা ভাঙচুর করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে।
 
সাজেদা বেগম একজন বর্ষীয়ান নেত্রী। ইদানিং তার কথাবার্তার বাধ ভেঙ্গে গেছে। বুঝতে হবে উনি একজন দায়িত্বশীল পদে আছেন্। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে গেলে উনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। তিনি হরতালের আগের দিন বললেন, ‘রাজাকারদের হাত থেকে স্বাধীনবাংলা স্বাধীন করতে আজ থেকে যুদ্ধ শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ সবকিছুর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। ’ দেশ এখন তার দল শাসন করছে। রাজাকারদের ঠেকাতে যুদ্ধে যেতে হবে কেন? আইনের মাধ্যমেইতো সেটা সম্ভব। এখন যুদ্ধ মানে তো গৃহযুদ্ধ। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিতো সেটাই চাচ্ছে। সাজেদার কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি দেশে ষড়যন্ত্রকারীরা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে তবে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? তিনি আরো বলেছেন, এবার প্রতিশোধ নেবার পালা। জামাতিরা এরই মধ্যে দেশে বিদেশে বলা শুরু করেছে যে, ট্রাইবুনাল গঠনের মাধ্যমে সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। সাজেদার কথার মাধ্যমে একটা বৈধ প্রক্রিয়া এভাবে সমালোচনার মধ্যে পড়তে পারে। তিনি জেনে বলুন আর না জেনে বলুন, তার কথার মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই উপকৃত হবে বেশি।  

অন্যদিকে, যুবলীগ বলেছে, হরতালে কেউ নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে গণধোলাই দিয়ে তাকে পুলিশে দেওয়া হবে। নেতৃত্ব পর্যায় থেকে এ ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা সমাজে আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেবার প্রবণতা বাড়বে। এভাবে রাজনৈতিক আঙিনার বাইরে সুযোগ সন্ধানীরা ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে পারে। ইতিমধ্যেই যশোরের পৌর চেয়ারম্যানকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মারধোর করেছে, বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপিপন্থি এক শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে। এই সব হামলা এবং হত্যার দায়িত্ব এখন উপরের হুংকার দাতাদেরই নিতে হবে।

জনগণ কখনো এক সন্ত্রাসী রুখতে আরেক সন্ত্রাসীকে সহায়তা করবে না। মনে থাকার কথা, এই ধরনের বাড়তি কথা বার্তার জন্য কিন্তু ৯১ এর নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছিল। নির্বাচনের আগেই প্রচারণা বাদ দিয়ে কাকে মারবে কাকে ধরবে, কে মিনিস্টার হবে কে চেয়ারম্যান হবে এই নিয়ে ব্যস্ত ছিল দলটি। জনগণ এই অতি বাড়াবাড়ি পছন্দ করেনি। ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। আজকের বিরোধীদলও বিভিন্ন সময়ে বাড়াবাড়ির কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

আপনারা প্রথমে নিজ দলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দলকে সন্ত্রাসীমুক্ত করুন। এগুলো আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কি করেছেন ঐ শহীদুলের বিরুদ্ধে যে এই কয়েকটা দিন আগে পার্কে বসে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সালিশ বসিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় বাচ্চা শিশুদের মারধর করেছিল? কোনও ব্যবস্থা নিয়ে থাকলে জনগণ সেটা জানতে চায়। দলের পক্ষ থেকে শহীদুলদের আগে নির্মূল করুন। নিজ দলের সন্ত্রাসী দিয়ে বিরোধী দলের সন্ত্রাসী কর্মকে দমন করা তো যাবেই না বরং সেটা আরো উস্কে দেওয়া হবে।   হরতালে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে হরতাল দমন করা যায় না। বরং দুই দলের রণ হুঙ্কারে জনগণ আরো বেশি আতংকিত হয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকে। আওয়ামী লীগের মনে থাকার কথা, বিএনপির আমলের শেষের দিকে যখন ঠিক একই কাজটি করা হয়েছিল তখন এই আওয়ামী লীগই ‘চোরাগোপ্তা; হামলা হরতালের নতুন হাতিয়ার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বিরোধী দল একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে। হরতাল এরই মধ্যে তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। এমনিতেই তা একদিন ডাইনোসর হয়ে যাবে। লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে মৃত ডাইনোসরকে না জাগানোই ভাল।

প্রসঙ্গত আরেকটা কথা এসে পড়ে। নিজে যে দোষে দুষ্ট সেই কর্ম থেকে অন্যকে বিরত থাকতে বলার কোন নৈতিক অধিকার কারো নেই। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতো হরতাল হয়েছে তার সিংহভাগ করেছে আওয়ামী লীগ। সেই ৯৬ সালের কথা কি দলটি ভুলে গেছে? একটানা কতোদিন হরতাল হয়েছিলো? একবার হরতাল করবেন না বলে অঙ্গীকার করেও তা ভঙ্গ করা হয়েছে। নিজেদের আগে সংশোধন করা প্রয়োজন। এই কথাগুলোর অর্থ হরতালকে সমর্থন করা নয়। যে প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকারি দল হরতালকে মোকাবেলা করছে তার বিরোধিতা করা মাত্র।  

দল যখন সরকারের পেটে ঢুকে যায় সেখানে সরকার আর জনগণের থাকে না। সরকার হয়ে পড়ে নির্দিষ্ট একটা দলের। তখন একদলীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া সরকারের কাছ থেকে কিছু আশা করা যায় না। বাকশাল থেকে শুরু করে প্রতিবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে দলকে সরকারের পেটে ঢুকিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মতো একটা ইস্যু আজ হাতে নিয়েছে সরকার। এই পরিস্থিতিতে তাদের সব কিছু অনেক চিন্তাভাবনা করে করতে হবে। কোন অবস্থাতেই জামায়াত শিবিরের প্রতি জনগণের একটা নৈতিক সমর্থন কিংবা সহানুভূতি সৃষ্টি হয়ে যায় এমন কোনও কাজ করা যাবে না। জামাত শিবিরের মতো একই কায়দায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এক কাতারে চলে এলে জামায়াতের ফাঁদেই পা দেওয়া হবে। সন্ত্রাসী দিয়ে হরতাল প্রতিরোধের চেষ্টার ভিডিও ক্লিপস জামায়াত-শিবির চক্র ফেইসবুক এবং ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে জনগণের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করছে।
 
জামাতের সমর্থনে ডাকা (যদিও ঘোষণায় সেটা ছিল না) হরতাল ডেকে বিএনপি সমালোচিত হবার আগেই তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। রাজপথে দলীয় সন্ত্রাসীদের মারমুখী অবস্থান জামায়াতের প্রতি ক্রোধকে কিছুটা হলেও দমন করেছে। জামায়াত-শিবির মাঠে নেমে যেমন তাদের একটা শক্তির মহড়া দেখিয়েছিল। ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে সরকার আসলে দেখাতে চেয়েছে শিবিরের চেয়ে ছাত্রলীগও কম যায় না।

অন্যদিকে, বিএনপি যে মুহুর্তে হঠাৎ করে হরতাল ডেকেছে মুখের কথা যাই হোক, মনের কথা সবাই বুঝতে পেরেছে। স্কুলে যাবার আগে বাচ্চার পেট ব্যথার রহস্য যেমন বাবা মা বুঝতে পারে, ঠিক তেমনি বিএনপির হঠাৎ হরতাল এবং ছাত্রলীগ যুবলীগের ডাণ্ডা মিছিলের কারণও জনগণ ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে পেরেছে। বিএনপি জামায়াতকে কোলে তুলে যতোটুকু পারেনি.. আওয়ামী লীগের জঙ্গিপনা সমাজে জামায়াতকে তার চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত করবে। জামাতকে বাঁচাতে জনসমর্থনহীন একটা হরতালে আওয়ামী লীগ লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে পরবর্তী সময়ে একটা জোড়ালো হরতাল করার পক্ষে ক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করলো। যে নিজের কবর নিজে খুদবে তাকে বাঁচাবে কে!

mahalom72@yahoo.com

বাংলাদেশ সময় ১২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।