বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকায় এক পিকেটারের বুকে পা চেপে ধরেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবারের হরতালের সবচেয়ে সাড়াজাগানো, স্পর্শকাতর ছবি! বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’এর ফটো ফিচারের বর্ণনায় বলা হয়েছে আটক পিকেটার জামায়াত-শিবিরের কর্মী।
গত চব্বিশ ঘন্টায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বীভৎস ছবিটা ব্যবহার করে নানান পোস্ট রিলিজ করেছে জামায়াত-শিবিরের লোকজন। এনটিভিসহ কিছু টিভি চ্যানেলের ভিডিও ক্লিপিংসও সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ড করার নিয়তে লিপ্ত মরিয়া সংগঠন জামায়াত-শিবির এর মাধ্যমে এরা নানান জায়গার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে। করবে এটাই স্বভাবিক।
এমন ছবি ভীষণ আবেদন সৃষ্টি করে বিদেশে। কারণ এই জামায়াত-শিবির কারা, কী বীভৎস কায়দায় এদের মুরব্বিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে নিরীহ মানুষ খুন করেছে এর ডিটেইলস তারা জানে না। কিভাবে গত ৩৯ বছর ধরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচার ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে বা এখনও ছলেবলে কৌশলে বিচার ভণ্ডুল করার চেষ্টা হচ্ছে তা-ও আমাদের মতো করে জানে না বিশ্বজনমত! অতএব জেনেশুনে খুনিদের দোসরদের হাতে এমন অপপ্রচারের অস্ত্র তুলে দেবেন না প্লিজ!
এখন এই ছবির বৃত্তান্ত নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চয় পুলিশের তরফে করা হবে। তদন্ত রিপোর্ট যাতে জনগণের সামনে আনএডিটেড প্রকাশ করা হয়। পুলিশের যে সদস্য বেআইনি কাজটির সঙ্গে জড়িত, যারা দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলেন তাদের সবাই এমন একটি বেআইনি তৎপরতায় অংশগ্রহণের জন্য দায়ী। এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পুলিশের যে সদস্য লেটেস্ট হরতালের সবচেয়ে আলোচিত ছবিতে পোজ দিয়েছেন, তিনি বিএনপি আমলের সেই কুখ্যাত পুলিশ অফিসার কোহিনুর মিয়ার উত্তরসূরী! কোহিনুর মিয়াদের যেমন আমরা নিন্দা করি, এদেরও তেমন প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।
আমাকে এক শহীদের সন্তান বলেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন পুলিশের ওই সদস্যটিও হয়ত মুক্তিযুদ্ধের কোন শহীদ পরিবারের সন্তান। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে তিনি এতটা আক্রোশি ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারেন। অথবা ক’দিন আগে জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডাররা পুলিশের উদ্দেশে গ্যাসগ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে, সংঘবদ্ধ আক্রমণে রক্তাক্ত-জখম করেছে পুলিশের সদস্যদের, পরিকল্পিত কয়েক ঘন্টার তাণ্ডবে রাষ্ট্রের শতকোটি টাকার ক্ষতি করেছে, আক্রোশটি হয়তো সে কারণেও।
কিন্তু যে কারণেই হোক এমন ভূমিকাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। এ ভূমিকা আত্মঘাতী। যা মূল লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একাত্তরের শহীদ স্বজনদের হত্যার দীর্ঘ অপেক্ষার পথে সৃষ্টি করতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বাধার। এটি কারো কাম্য নয়।
কারণ এ বিচারের আশায় দীর্ঘদিন ধরে আমরা আইনের শাসনের কাছে কাতর আবেদন করে এসেছি। রাষ্ট্রকে বিচারের পক্ষে আনার চেষ্টা করছি। তা না করে `খুন কা বদলা খুন` নীতিতে চাইলে চিহ্নিতদের ধরে এতদিনে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হতো। হাটের দিন দেখে দেখে তাদের প্রশ্রয়দাতাদের ধরে ধরে তোলা যেতো জনতার আদালতে। কারণ এসব খুনি আর তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের সবাই গ্রামে-শহরে আমাদের চেনা-জানা।
আজকাল ফেসবুকসহ নানান স্যোশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও এদের চিহ্নিত করার সুযোগ বেড়েছে। পরিচয় গোপন করে ফ্রেন্ডলিস্টে ঢুকে নানাকিছুতে প্রথম প্রথম নানান নিরপেক্ষ ভাব করবে। এ কথায় সে কথায় আসল পরিচয় বেরিয়ে পড়তেও সময় লাগে না। এটা যে কোনও অপরাধীর নেচার। অপরাধটি যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, ইতিহাস চেপে গিয়ে তাদের পক্ষে থাকার অপরাধ। বহুত খতরনাক এই অপরাধ, এসব অপরাধীর রকমফের!
আমার শহর কুলাউড়ার ঘাতক রাজাকার নেতা ইউসুফ মোক্তার, মাহতাব চৌধুরী, আতই মিয়াসহ অনেককে যেমন এলাকার লোকজন একনামে চেনেন, এমন সব এলাকার ঘাতক যুদ্ধাপরাধীরাও স্থানীয়ভাবে লোকজনের চেনাজানা। এদের সংখ্যাও আহামরি কিছু না। গুনে গুনেই শেষ করা যায়। কিন্তু তা না করে আমরা নিয়মতান্ত্রিক আইনের শাসনের কাছে প্রতিকার চেয়েছি। ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গোলাম আজমের প্রতীকী বিচারের পরেও আনুষ্ঠানিক বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিয়েছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বলেননি।
আমরা সেই শহীদ জননীর সন্তানেরা, সৈনিকদল তাঁর আন্দোলনের । আমাদের আপাত স্বস্তি, দীর্ঘ অপেক্ষার পরে হলেও রাষ্ট্র এ বিচারের দায়িত্ব নিয়েছে। কাজ শুরু করেছে ট্রাইবুন্যাল। এখন এ বিচারের বিপক্ষে যাকে যেখানে পাওয়া যাবে আমরা বড়জোড় তাদেরকে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করব। তাকে-তাদেরকে তুলে দেব আইনের হাতে। আইন নিজের হাতে তুলে নেবো না। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াকেও সমর্থন করবো না।
এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া, বাংলাদেশের লাখো শহীদের আত্মত্যাগ থেকে পাওয়া শিক্ষার শপথ। আমরা আমাদের শপথের অবমাননা করবো না। করতে দেবো না কাউকে। এমন পবিত্র শপথের বাইরে যাওয়া মানে শহীদদের অপমান করা। তাদের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া। শহীদদের রক্তের উত্তরসূরী হিসাবে আমরা কী তা করতে পারি? কখনোই না।
এখন এই বাংলাদেশে কেউ থাকতে চাইলে বাংলাদেশের যুদ্ধের শহীদদের পক্ষে থাকতে হবে। সোজা হিসাব। পাকিস্তানে বসেও কারো বাংলাদেশের পক্ষে থাকার সুযোগ নেই। সেখান আসমা জাহাঙ্গীর, হামিদ মীরের মতো যে গুটিকয় মানুষ বিবেকের দংশনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেন, তাদের সেখানে নানা গোয়েন্দা হয়রানির ঘটনাবলি আমরা জানি। খালেদ সাঈদ নামের একজন সাংবাদিক একসময় করাচি থেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করতেন। গোয়েন্দা হয়রানি সহ্য করতে না পেরে তাকে কাজটি বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়।
এখানে বাংলাদেশের ‘নিমকহারামরা’ পাকিস্তানের পক্ষের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিতে চাইলে সে দরজাও খোলা। উড়োজাহাজ অথবা সমুদ্রপথে পাকিস্তান যাওয়া যায়। সেখান থেকে তালেবানদের সঙ্গে যোগ দেবারও সুবন্দোবস্ত আছে। এখানে পুলিশকে গ্যাস গ্রেনেড মেরে কাবু করার চেষ্টাটি তালেবানি শিক্ষা। এমন তালেবানি ক্যাডার বাংলাদেশের দরকার নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ড করার ষড়যন্ত্রের তালেবানি শিক্ষার বিশদ তদন্ত রিপোর্ট জনগণকে জানাতে হবে। এদের বিচার করতে হবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে। যা যা করার দরকার সব করতে হবে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে।
কাউকে মাটিতে শুইয়ে বুকে পা রেখে নয়। এ ধারা আত্মঘাতী। তেমন আত্মঘাতী পথে হেঁটে আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, করতে দেবেন না প্লিজ!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৩২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১