জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় শান্তির রূপরেখা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপর নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলন আর দলীয় সম্বর্ধনা নিতে গিয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ে যে সব কথাবার্তা বলেছেন তাতে শান্তির ছাপমাত্র নেই।
তবে শান্তির একটা ছবি প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে সৃষ্টি করেছেন, তা দেশের নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাসায়। দেশসেরা এই লেখক-ঔপন্যাসিক, টিভিনাটক, চলচ্চিত্রনির্মাতা দূরারোগ্য ক্যান্সারে পড়াতে তার দেশবিদেশের ভক্তকূল যখন উদ্বেগের মধ্যে তখন প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ সবাইকে শান্তি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। শুভেচ্ছার ফুল, চিকিৎসা সহায়তা হিসাবে দশ হাজার ডলারের চেক হাতে তুলে সাহস দিয়ে বলেছেন, আমরা আছি সঙ্গে। পুরো ঘটনাটি যে কত বড় মানসিক শান্তি আর প্রেরণাদায়ক তা এমন একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া হুমায়ুন আহমেদ, তার পরিজন-স্বজন ভক্তকূলই বুঝি সঠিক অনুধাবন করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছেন, তার চিকিৎসার জন্যে সম্ভব সবকিছু করবে সরকার। জবাবে কৃতজ্ঞ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, দেশের মানুষের ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে তাকে দেখতে এসেছেন, সেটিই তার অনেক বড় পাওয়া। পুরো বিষয়টি ছুঁয়ে গেছে তার অন্তর।
এসব কিছুর জন্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরও একজনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। ইনি সিডনিপ্রবাসী লেখক-গবেষক শাখাওয়াৎ নয়ন। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক পৌঁছবার পরপরই সেখানে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে যাবার জন্য অনুরোধ করে নয়ন দৈনিক আমাদের সময়ে লিখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ হয়তো নৈমত্তিক ক্লিপিং’এ সেটি তাকে দিয়েছেন। অথবা তা মনেই ছিল প্রধানমন্ত্রীর। যেভাবে হোক, কাজটা খুব ভালো হয়েছে।
আবার প্রধানমন্ত্রী হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে যাওয়াতে দেশে একদল যার যার মতো প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছেন। খুশি হয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ। বিশেষ করে হুমায়ূনভক্তরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা। আবার এক শ্রেণীর লোক বিরক্তি প্রকাশ করে বলতে চেয়েছেন, তার তো কোনও আর্থিক সমস্যা নেই, তবে টাকাগুলো দেবার কী দরকার ছিল, ইত্যাদি। এদের মনোকষ্টের বিষয়গুলো যে অন্যত্র তা বুঝদাররা সহজে ঠাহর করতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদের সন্তান হুমায়ূন আহমেদ। তিনি এবং তাঁর দু’জন স্বনামখ্যাত ভাই ড. জাফর ইকবাল আর আহসান হাবীব অনেক বছর ধরে দেশকে নিরন্তর যা দিয়ে চলেছেন এর মূল্যমান নিরূপণ সম্ভব না। একটি বিশেষ কারণে লেখক হুমায়ূন আহমেদ অনন্য। একসময় কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের বইয়ের একচেটিয়া বাজার ছিল বাংলাদেশ। এমনকি তাদের অনেকের অনেক বস্তাপচা বইয়েরও পাইরেসি সংস্করণ এখানে বাংলাবাজার থেকে বেরুত। কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের দাপট ছিল একুশের বইমেলাতেও।
কিন্তু বাংলাদেশে যখন হুমায়ূন যুগের সূচনা হয়, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, তসলিমা নাসরিনসহ আরও বিশিষ্ট ক’জন যখন বিপুল লিখতে শুরু করেন, কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের দাপট বিদায় হয়।
অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের সব বই তাঁর প্রথম সৃষ্টি নন্দিত নরকের’র মতো নয়। অনেক লিখলে বা বেশি লিখলে যেন এমনি হয়। কিন্তু পাঠক চাহিদার কারণেই হুমায়ূন আহমেদ লেখেন। নিজের জন্য প্রকাশক বা পত্রিকা সম্পাদকদের অনুরোধে লেখেন। বলা হয়, পত্রিকার কলামে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পর যিনি নিজস্ব একটি পৃথক আসন করে নিয়েছেন, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। শুধু রাজনীতি নিয়ে লিখেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। হুমায়ুন আহমদ ক্রিকেট-ফুটবলসহ জীবনের যখন-যে-গল্প সব লিখেন।
বাংলাদেশের বইমেলা মানে, পত্রপত্রিকার ঢাউস ঈদসংখ্যা মানে এখনও হুমায়ূন ক্রেজ! যেদিন হুমায়ূন আহমেদ একুশের বইমেলায় যান, যেদিন যে স্টলে তিনি বসেন সে স্টলকে কেন্দ্র করে লম্বা লাইন পড়ে ! বাংলাদেশে আগে এমন হুমায়ূন আজাদের আগামী প্রকাশনীর স্টলকে কেন্দ্র করে এমন লাইন পড়ত। এমন লাইনে দাঁড়িয়ে লেখকদের অটোগ্রাফসহ যারা বই কিনতে ভিড় করেন তারা কিন্তু তা পয়সা দিয়ে কেনেন।
প্রতি বইমেলার পর মিডিয়ায় যে কোটি কোটি টাকার কেনাবেচার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বেরোয়, এর সিংহভাগ কেনাবেচার হিসাবটি বুঝি হুমায়ূন আহমেদের বইকেন্দ্রিক। তা আমি-আপনি পছন্দ করি বা না করি তাতে এই হিসাবের কিছুতে কিছু আসে যায় না।
একসময় বাংলাদেশের তরুণরা দস্যু বনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা অথবা নীহার রঞ্জন গুপ্তে মোহাচ্ছন্ন-আসক্ত ছিলো। হুমায়ূন আহমেদের হিমু সমগ্রের মতো আরও কিছু বই, জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাসেলের মতো বই বা হুমায়ুন আজাদের নারী, পাক সার জমিন সাদ বাদ’ জাতীয় বই দেশের তরুণ মানসের রুচিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। জাদুঘরে গিয়ে ঢুকে গেছে রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরের মুনিরা অথবা নূরী কাহিনী!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলনের এক সংগঠক বলেছেন তাদের অনেক সংগ্রামকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে হুমায়ূনের নাটকের একটি ‘তুই রাজাকার’ সংলাপ! পাখির কন্ঠের সেই একটি সংলাপ দেশের মানুষের অন্তর, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, তাদের আণ্ডা-বাচ্চাদের মনে ভয় ধরিয়েছে।
আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অনুসারীদের আন্দোলন কৌশল নিয়ে দ্বিমত থাকাতে একদল লোক মনে করেন হুমায়ূন আহমেদ বুঝি বিএনপিপন্থী লেখক! এরকারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখতে যাওয়াতে এই পক্ষ অবাকও হয়েছেন! কিন্তু আমরা মনে করি, হুমায়ূন আহমেদ বৈষয়িক, কিন্তু দলবাজ লেখক না। কে কী মনে করল না করল তা না দেখে প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখতে গিয়ে একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদটি দেশের। হুমায়ূন আহমেদও প্রধান জনপ্রিয় লেখক বাংলাদেশের। দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগটিও কোনও দল বা মত দেখে আসে না! বরঞ্চ দেশের অনেক মানুষের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের মতো একজনকে এভাবে দেখতে যাওয়ায় লাভটি প্রধানমন্ত্রীর একাউন্টেই গেছে। বিষয়টি দেশের লিবারেল মানুষেরা, বিশেষ করে হুমায়ূনভক্তরা পছন্দ করেছেন।
প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের সঙ্গে সংসার ভেঙ্গে যাবার ঘটনা হুমায়ূনভক্তদের অনেকে বিশেষ করে অনেক নারীভক্ত খুব স্বাভাবিক মেনে নিতে পারেননি। আজ অবধিও না। মানুষের ব্যক্তিজীবনে, বিশেষ করে নামকরা মানুষদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা থাকে। যা তাদের নিয়ে ভক্তদের স্বপ্ন-প্রত্যাশার সমার্থক না। গুলতেকিনের সংগ্রাম আমরা জানি। সন্তানেরা বড় হবার পর আবার পড়াশুনায় ফিরে এসেছিলেন গুলতেকিন। ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে। আজ হুমায়ুনের জীবন ঝুঁকির বিপদে তার নিরব কান্নারও খবরও দিয়েছেন ঘনিষ্ঠ একজন। তাদের সবাইকে আমাদের সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে।
এখন সবার প্রধান কামনা হুমায়ূন আহমেদের সুস্থ হয়ে ফিরে আসা। নিউইয়র্কের ভাড়াবাসায় তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করেছেন। ছবিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাকে খুব সাবলীল স্বাভাবিক মনে হয়েছে। হুমায়ূন আহমদকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তারা জানেন এমন দৃঢ়তাই হুমায়ূন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। লড়তে জানেন। যে কোনও পরিস্থিতি লড়ে জয় করতে জানেন। সে কারণে ঘনিষ্ঠরা আশাবাদী এ পরিস্থিতিও লড়ে জিতে পার করে আসবেন হুমায়ূন আহমেদ। দেশবাসীও সে অপেক্ষায়।
সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক লেখালেখির জীবনে ফিরে আসুন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। আপনাকে আমাদের আরও অনেক অনেকদিন দরকার। আপনার নাটকের পাখি যাদেরকে ‘তুই রাজাকার’ বলে দেশের মানুষকে নতুন করে চিনিয়েছে, তাদের মোটাতাজাগুলো এখন জেলের মধ্যে। বাংলাদেশে আপনার শহীদ পিতার খুনিদের বিচার হচ্ছে। সেখানে আপনারও যে সুস্থ-সবল থাকা দরকার। আবার সুস্থ ফিরে আসুন প্রিয় হুমায়ূন ভাই। আমরা সবাই আপনার জন্য দোয়া করছি।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১২৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১১