‘সীমা লংঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। ’ এ কথাটি আমরা সবাই জেনেও অনেকে মেনে চলি না।
পুরনো ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা গ্রহণ করি না। মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে আজকের বিএনপি-আওয়ামী লীগের শাসনামলেও এ চরিত্রের কোনো হেরফের হয়নি। ওয়ান ইলেভেনের পর জাতি আশা করেছিল এবার হয়তো আমাদের রাজনীতিবিদরা চিরাচরিত সংস্কৃতি পরিহার করে ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে নিজেদের কিছুটা হলেও শুধরাবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।
আসির চেয়ে মসি শক্তিশালী। কেন নির্বোধ মানুষগুলো এটা বোঝে না তা ভেবে পাই না। ১১ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় বাংলানিউজে একটি আপডেট সংবাদ পড়ে তাই মনে হলো।
সিনিয়র করেসপনডেন্ট সংবাদটিতে লিখেছেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২০তম সভায় সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য উপস্থিত হলে তাদের এক প্রকার অপমান করেই অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের করে দেওয়া হয়। করেসপনডেন্ট আরো উল্লেখ করেন, অনুষ্ঠানের সভাপতি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টারও পরে অনুষ্ঠানস্থলে যোগদান করলে আরেক মন্ত্রী শাজাহান খান তার সাথে কী যেন কানাকানি করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সাংবাদিকরা এই সভায় থাকতে পারবেন না। বাইরে যান। এটি সড়ক নিরাপত্তা জাতীয় কমিটির সদস্যদের জন্য বৈঠক। ’
সাংবাদিকরা তার কথার প্রতিবাদ জানালে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো জনসভা নয়, তাহলে তো পল্টনেই করতাম। ’ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণপত্রের ভিত্তিতেই সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে এসেছেন-- জানালে মন্ত্রী আবুল হোসেন এটা তাদের ভুল হয়ে গেছে বলে ব্যক্ত করেন। সাথে বসা অন্য দুই মন্ত্রী আমাদের সাহারা আপা ও টুকু ভাইজানও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে সাংবাদিকদের চলে যেতে বলেন।
ওনারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে বলে মানুষের নাকের ডগায় যা ইচ্ছে তাই করবেন! আবুল আর শাজাহানের মতো মন্ত্রী, এতো অভিযোগ যাদের ওপর, ব্যর্থতার পাল্লা যাদের এতোটাই ভারী, তারা কোন শক্তিতে একটার পর একটা অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছেন?
সংবাদপত্র হচ্ছে জাতির দর্পণ। সেই দর্পণের কারিগর হচ্ছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত মর্যাদার দিক দিয়েও তারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। একটি দেশ ও জাতিকে দিকনির্দেশনা দানের মাধ্যমে সঠিক পথটি দেখিয়ে দেন তারা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের খাতিরে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বললে যদি কারো আঁতে ঘা লেগে যায় তাতে ওই পেশাদার সাংবাদিকদের কিছুই আসে যায় না। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য তাদের বিবেক সদাজাগ্রত।
অথচ তাদেরকেই হেনস্থা করলেন আমাদের সরকারের দুই গুণধর মন্ত্রী। তাদের দাওয়াত করে নিয়ে সভা থেকে গলাধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে বের করে দিলেন আবুল আর শাজাহান। এ যেন অনেকটা আমাদের বাংলা ছায়াছবির ভিলেনদের মতো। ভিলেনরা যেমন কায়দা করে কাউকে আটকে অপমান-অপদস্থ করে বা মেরে-পিটিয়ে খুব মজা পায়, তৃপ্তির হাসি হাসে, মন্ত্রীবৃন্দের আচরণেও অনেকটা সে রকম গন্ধই পাওয়া গেল। দুঃখ হয় আমাদের মন্ত্রীদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সভ্যতা দেখে। আমরা কি কোনোদিনই গুহা যুগের ধাপ অতিক্রম করে বেরিয়ে আসতে পারবো না!
হলুদ সাংবাদিকতা বা নির্ভীক সত্য-স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য অনেক সময় অনেক সাংবাদিককে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। এতে কারো কারো জেল-জুলুম হয়েছে। কিন্তু এভাবে দাওয়াতপ্রাপ্ত সাংবাদিক হিসেবে কোথাও গিয়ে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, এ ধরনের নজির আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
ছেলেবেলার একটি কৌতুক মনে পড়ে। গ্রামের এক ভাতিজা শহুরে চাচার বাসায় বেড়াতে এসেছে। চাচা রেললাইনের ফ্ল্যাগম্যান হিসেবে কাজ করেন। চাচার কী ক্ষমতা দেখতে চাইলে রেড ফ্ল্যাগ উড়িয়ে ট্রেন থামিয়ে দেয়। ভাতিজা চাচাকে বললো, বাহ তোমার এত ক্ষমতা! একটি চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দিলে! এ কথা বলতে না বলতেই চালক নেমে এসে রেল লাইনে কোনো ত্র“টি-বিচ্যুতি আছে কি না জানতে চাইলে চাচা ‘না’ সূচক উত্তর দেন। চালক ঠাস করে একটি চড় দেন চাচার গালে। ভাতিজা অবাক হয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ওমা! ব্যাটা তোমাকে এভাবে চড় মারলো কেন?’ চাচা হাসতে হাসতে বললেন, ‘বোকা কোথাকার! আমার ক্ষমতা আমি দেখিয়েছি। তার ক্ষমতা সে দেখাবে না?’
রাতের পর দিন আসে, পূর্ণিমার পর কালো অমাবস্যা। বাংলাদেশের জনগণ এখন আর আগের মতো এতটা বোকা নয়। দুধ-কলা দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ফায়দা লুটে নেয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। তারা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে জানে। তখন তারা তাদের ক্ষমতা দেখাবে। আজ যারা ক্ষমতাসীন হয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে সীমালংঘন করছেন তখন তারা আফসোস করারও ফুরসত পাবে না।
দেশবরেণ্য অনেক সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট বিভিন্ন সময়ে একান্তই হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে মন্ত্রীদের ভুল-ত্র“টি ধরিয়ে সাবধান করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। গায়ে পড়ে দেওয়া বুদ্ধিজীবীদের ‘শস্তা’ বুদ্ধি নেওয়ার মতো সময় কোথায় তার? উল্টো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ভুল বুঝেছেন তাদের। বলতে দ্বিধা নেই, এ ভুলের মাশুল প্রধানমন্ত্রীকেও একদিন দিতে হতে পারে।
কখনো কখনো সহজ-সরল মা-বাবার কোনো কোনো সন্তান বেশি আদর পেয়ে পরিবারের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। কলঙ্ক ডেকে আনে সমস্ত বংশের। সমাজের চোখে হয় এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
প্রধানমন্ত্রী কি একবারও আঁচ করতে পারছেন না, তার মন্ত্রীদের বেফাঁস কাথাবার্তা, স্খলিত আচরণ, অপরিপক্ক কর্মকাণ্ড তার জন্য, তার দল বা সরকারের জন্য এক ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী বলয়ের অনেক লোকসহ আমজনতার কাছে বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে? ভুলে যাবেন না, যাদের কাণ্ডারী হিসেবে ভাবা হয় তাদের অনেকেই একদিন সুযোগ বুঝে মীরজাফরের মতো মারণকামড় দেয়।
ছোট মানুষের কথাও অনেক সময় কাজে লাগে। তাই বলছি। আপনি প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীদের প্রধান। সরকারপ্রধান। দেশ ও জনগণের প্রধান। রাষ্ট্র ও সরকারের সকল সফলতা ও ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণের ক্ষেত্রেও আপনাকেই হতে হবে প্রধান।
লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী shajed70@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ২১৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১১