আর এদিকে মহিষের লেজের আগুন লেগে শত শত ঘর পুড়লো। ক্ষেতের শস্য নষ্ট হলো।
মিয়ানমারের (বার্মা) অবাধ্য সেনাবাহিনী যেন এমনি এক "ছায়া" চরিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তে মাদক চোরাচালান চলে। আর এ চোরাচালানের সাথে মিয়ানমার এর সামরিক বাহিনী জড়িত। সুতরাং প্রায় সময়ই তারা নানাবিধ কাণ্ড কারখানা করে থাকেন। আর এদিকে বাংলাদেশের ভেতরেও আছে একটি মহল, যারা নানাভাবে এই কর্মকাণ্ডে জড়িত।
দুর্নীতির বিশ্বায়নে জাতি, রাষ্ট্র, জাতিসংঘ সব স্তরেই ব্যক্তি, সমাজ ও সংস্কৃতি ভুক্তভোগী। আমি মনে করি, মানুষের পক্ষেই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আশাবাদী ও ইতিবাচক মনোবৃত্তি। প্রয়োজন সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকা, ধারাবাহিক অনুশীলন ও দক্ষতা অর্জন।
আরাকানের মুসলিম সম্প্রদায় মিয়ানমারের অনেকগুলোর মধ্যে প্রাচীন রোহিঙ্গা জাতিসত্তা। ওরা শত শত বছর ধরে সেখানেই বাস করছে। সাধারণত কয়েক প্রজন্মেই ছোট জাতিসত্তা দেশের মূলধারায় মিশে যায়। কিন্তু এখানে তা ঘটে নাই। যদিও তাদের রাজ্যের রাজসভায় সুদূর অতীতে বাংলা সাহিত্যচর্চার নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থায় ওরা বাঙালি নয়।
নানা মুনি নানা কথা বলেন। প্রত্যেকেই তাঁর অবস্থান থেকেই দেখছেন। আমিও তাই।
রোহিঙ্গাদের বিষয়টি দয়া বা সহানুভূতি নয়, সহমর্মিতার জায়গা থেকে দেখা দরকার। ধর্মীয় আবেগের মধ্যে অন্ধ সমর্থন রয়েছে। এই মুহূর্তে অন্ধ সমর্থনের চেয়ে যুক্তির প্রয়োজন বেশী। তাই ধর্মীয় আবেগ নয়, মানবতা-বোধ থেকেই পুরো বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা প্রয়োজন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকার আর আরাকান-মুসলিম ছোট জাতিসত্তার প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও পদক্ষেপ একাধারে মানবিক ও বন্ধুসুলভ। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিজ রাষ্ট্রের দায়িত্ব, জনগণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিষয়েও সম্পূর্ণ সচেতন থাকা। বাংলাদেশের এমনিতেই পাহাড় কম। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবার অধিকার রাখে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন যতো সংখ্যক শরণার্থী সমাগম হচ্ছে, এটা একটা দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে ভারতে বাংলাদেশের যে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর সমাবেশ হয়েছিলো, তা কি ভারতের উপরে একটা চাপ ছিলো না? অবশ্যই সেটা একটা চাপ ছিলো। ভারতের উপর এই চাপ কমাবার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ করেছিলেন, একই সাথে তেমনি বিশ্বময় বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাঁর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব ছিলো দৃঢ়, লক্ষ্যে অবিচল ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশরও এই রকম একটি নেতৃত্ব দানের সুযোগ রয়েছে। আর বাংলাদেশের স্বপক্ষে এমনই একটি দৃঢ় ও যুগান্তকারী নেতৃত্বদানের জন্য আমি মনে করি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকা।
আজ মিয়ানমার সরকারের সাথে আরাকান-মুসলিম (রোহিঙ্গা) জাতিগোষ্ঠীর যে সংঘাত, তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে দেশটি যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, মিয়ানমার সরকারকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সংহত হতে সহায়তা করার মাধ্যমে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সূক্ষ্ম রাজনৈতিক মেধা এবং সৃজনশীল নেতৃত্বের পরিচয় দেবেন। বন্ধুত্বপূর্ণ, দৃঢ় ও সৃজনশীল কূটনৈতিক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবার থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ ট্রফি জয় করে নিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য সম্ভব। যদিও এখন ঘোর সংকট। কিন্তু এই ঘোর সংকটে আমি সে সম্ভাবনাটিই দেখতে পাচ্ছি।
শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন চলছে। সেদেশে উদ্ভূত এই পরিস্থিতির ফলে প্রতিদিন প্রাণভয়ে মানুষ সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার মুখে সারাবিশ্বকে বলছে, তাদের দেশে কোনো সমস্যা নাই।
এমন একটি অবস্থা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। আর এ কারণেই জাতির পক্ষে বাংলাদেশ সরকারকে কৌশলী হতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে জনমত তৈরি করে বিশ্বের জাতিসমূহকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে আগাতে হবে। বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দমন-নিধন রাজনৈতিক অবস্থার কারণে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য উপস্থিত। বিনা আমন্ত্রণে উপস্থিত এত এত অতিথি বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তাই কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সুষ্ঠু "শরণার্থী ব্যবস্থাপনা" গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে। বাংলাদেশের জনগণ প্রায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে থাকে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি। শুধু তাই নয়, বাঙালির বিশাল হৃদয়ের পরিচয় ইতিহাসে বিদ্যমান। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ সরকারের দক্ষতা ছোট করে দেখবার উপায় নাই।
আমরা জানি, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকে প্রায় অর্ধ কোটি বিহারী শরণার্থী ব্যবস্থাপনা করেছে। ভারত ও পাকিস্তান কেউই এই মানুষগুলোকে তখন স্থান দেয় নাই। বাংলাদেশের জনগণ যেমন বীর, সাহসী ও সৃজনশীল, তেমনি অতিথি পরায়ণ ও মমতাশীল। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ একসাথে ঠিকই বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি এবং শরণার্থী-ব্যবস্থাপনা একাধারে দুটো কাজই সমান তালে চালিয়ে যেতে পারবে। এই মুহূর্তে শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত জরুরি:
১) পরিকল্পিত জেন্ডার বান্ধব আশ্রয়স্থল স্থাপন
অবিলম্বে শরণার্থী আশ্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা জরুরি। যেখানে পর্যাপ্ত পয়:ঘর ও পানির ব্যবস্থা থাকবে। যেখানে থেকে শরণার্থী গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে বা হারিয়ে গিয়ে নিজে বিপদে পড়বে না বা অন্যের বিপদের কারণ হবে না। আশ্রয়স্থল স্থাপনের আগ পর্যন্ত নিরাপত্তার প্রয়োজনে শরণার্থীরা যেন উখিয়া ও টেকনাফ এ সীমাবদ্ধ থাকে।
২) শরণার্থী রেজিস্ট্রেশন ও ডকুমেন্টেশন
অতি দ্রুত ছবি, নাম, ধাম, গ্রাম, পরিবার, রক্তের গ্রুপসহ শরণার্থী রেজিস্ট্রেশন করা জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে - এই রেজিস্ট্রেশন রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন নয়। এই রেজিস্ট্রেশন হলো বর্তমান ঢেউয়ে (Latest Forced Migration Wave) পালিয়ে আসা অস্থায়ী শরণার্থীর হিসাব রাখা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ। এই দলিল তৈরি অত্যন্ত জরুরি। কারণ যদি এখন অন্য কোনো দেশ এই ঢেউয়ে আগত কোনো শরণার্থী বা শরণার্থীদের নিয়ে যেতে চায়, বা কোনো শরণার্থী তার আপনজনদের খুঁজে পেতে চায়, বহুবিধ কারণেই এই সাময়িক রেজিস্ট্রেশন ও পরিচয়পত্র দরকার হবে।
৩) জরুরি-ব্যবস্থাপনা জারি
অবিলম্বে খাবার-দাবার, পানি ও পানীয়, জরুরি ওষুধসহ স্বেচ্ছাসেবী ও সহমর্মী সেবক, চিকিৎসক, সমাজকল্যাণ-কর্মী, চিকিৎসা-সমাজকর্মী, মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী সহকারে জরুরি-ব্যবস্থাপনা ও সেবা স্থাপন জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক।
৪) জরুরি অবস্থা জারি
প্রয়োজনে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকাকে সীমাবদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে জরুরি অবস্থা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫) জরুরি মানব পাচার ও অপচয় প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা জারি
জরুরি মানব-পাচার ও অপচয় প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা জারি করা অত্যাবশ্যক। কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, ধর্ম, কোন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থে যেন শরণার্থী জনসাধারণকে অপব্যবহার করতে না পারে।
৬) সরকারি প্রশাসন স্থাপন
অবিলম্বে একটি কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে দক্ষ কর্মকর্তাদের মাঠে পাঠিয়ে দেয়া জরুরি। সেনাবাহিনী ও সীমান্ত-রক্ষা বাহিনীসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষ জরুরি সরকারি ও বেসরকারি জনবল সমন্বয়ে যোগ্য-দল গঠন ও উপ-প্রশাসন স্থাপন।
৭) শিশু ও জেন্ডার বান্ধব বাজেট
সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সমস্ত শরণার্থী-ব্যবস্থাপনা-বাজেট শিশু ও জেন্ডার বান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এই মানুষগুলোর জন্য জরুরি প্রকল্প স্থাপনের আগ পর্যন্ত তাদের টিকে থাকা জরুরি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকল্প স্থাপনের পর নিরাপত্তার খাতিরে আমরা সরাসরি এসব মানুষের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করবো না। জেলা প্রশাসক এর দপ্তরে অথবা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে আমরা যে যা পারি দান করবো।
সেলিনা শিরীন শিকদার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
জেডএম/