লন্ডনের হাসপাতালে জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার খবর পড়ে চোখ ভিজে আসে। তাঁর চিকিৎসার জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা দরকার! লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন গ্যারান্টার হচ্ছেনা বলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠকের চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছেনা! বোধগম্য কারণেই হাইকমিশনের এই নির্লিপ্ত অমানবিক স্বরূপ! কারণ হাইকমিশন জানে শেখ হাসিনার কাছে প্রবীন নেতার পরিচয় সংস্কারবাদী! কাজেই তাঁর ব্যাপারে আলগা আগ্রহ (!) দেখিয়ে চাকরির বিপদ ডেকে না এনে হয়ত নিরবে কামনা করা হচ্ছে সহজ মৃত্যু! (দূঃখিত)।
এরপর বিশেষ তদারকিতে তাঁর লাশ দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেবে হাইকমিশন! দেশে বিরল বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে গলায় ধরাধরি করে আমরা কাঁদব কিছুদিন! রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী অভিধান ঘেঁটে শোকবানীতে নেতার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে এমন কিছু শব্দের চমক দেখাবেন, যা এর আগে তাঁরা কখনও ব্যবহার করেননি! রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ দাফন করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান নেতার মরদেহ। এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় হবেন একজন ‘সংস্কারপন্থী বিপদ’! তোফায়েল আহমেদসহ সংস্কারপন্থী অপর কয়েক নেতারও বয়স হয়েছে। ইনশাল্লাহ প্রাকৃতিক নিয়মে তাঁরাও একে একে সবাই বিদায় হয়ে যাবেন। তখন সংস্কারবিহীন চলতি অবিরাম শাসন স্বপ্ন চিরদিনের জন্য নিরাপদ নিরুদ্বেগ হয়ে যাবে! (দূঃখিত)।
আব্দুর রাজ্জাকের করুণ অবস্থার অভিজ্ঞতার শিক্ষায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি যারা করতে চান বা ভবিষ্যতে করার ইচ্ছা রাখেন, এই জীবনে তাদের কেউ আর কোনদিন ‘সংস্কার’ নামের শব্দটিও মুখে আনবেননা! কারন আওয়ামী-বিএনপি অভিধানেতো এখন বিপজ্জনক ‘গালি’র নাম এই সংস্কার! সংস্কার শব্দটা আর কেউ একবার মুখ ফুটে বলেছেতো তাদের পরিণতিও আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার পর আব্দুর রাজ্জাকের মতো হবে। লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালের আইসিইউতে অসাঢ় শুয়ে থাকবেন একা একা। জীবনরক্ষার আবেদন জানিয়ে স্ক্রল যাবে চ্যানেল আইতে। চাকরির ভয়ে হাইকমিশনার তাকে দেখতেও যাবেননা!
আব্দুর রাজ্জাক ভাই’র সঙ্কটজনক অবস্থায় খবর পেয়ে প্রথমে টিঙ্কু ভাইর কথা মনে পড়েছে। ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিঙ্কু। বোধকরি তিনিও এখনও অসুস্থ, চিকিৎসাধীন। মোজাম্মেল বাবু, ইউসুফ হাসান, আনিসুল হক, তারিক সুজাত, নুরুল ফজল বুলবুল, আব্দুর রাজ্জাক, ওয়াহিদুজ্জামান চাঁনসহ আরও অনেকের কথা খুব মনে পড়েছে।
আশির দশকে এরশাদ স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে এরা সবশেষ অনুপম সৃষ্টি সংগঠক আব্দুর রাজ্জাকের। এদের অনেকে আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিতে-দেশে প্রভাব আছে। রাজ্জাক ভাইর সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁরা কে কী করছেন জানিনা। হয়ত করছেন। সে যোগ্যতা তাদের আছে। দায়িত্বতো বটেই! টিঙ্কু ভাইরা দেখুন শেখ হাসিনার মন নরম করে রাজি করিয়ে কিছু করা যায় কিনা। স্বয়ং শেখ হাসিনাওতো তাঁকে রাজ্জাক ভাই ডাকতেন। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এখন তাঁর সেই এক সময়ের প্রিয় রাজ্জাক ভাই।
বাকশালের বংশাল অফিসে দেখা রাজ্জাক ভাইকে মনে পড়ছে খুব। ঝিকাতলার বাড়িতে দেখা তাঁর সাদামাটা জীবন। টিঙ্কু ভাইর নেতৃত্বাধীন জাতীয় ছাত্রলীগের টিমটির সাংস্কৃতিক প্রতিভার কারনে তখন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের, জাতীয় কবিতা পরিষদের পোস্টার-প্রকাশনা সমূহ বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। সে কারণে পটুয়া কামরুল হাসানের অভাবিত-আকস্মিক মৃত্যুর পরপর মঞ্চে বসে আঁকা তাঁর শেষ সৃষ্টি ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার কবলে’ ছবিটি ছড়িয়ে যায় সবখানে। এরশাদের বিশ্ববেহায়া নামটিও স্থায়ী হয়ে যায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সঙ্গে শুরু থেকেই অঙ্গাঙ্গি জড়িত ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগের অন্য অনেক নেতা এসব কর্মসূচিতে সুবিধামতো, বিশেষ করে শেখ হাসিনা থাকলে গেছেন, কিন্তু শহীদ জননীর মিছিলে-কর্মসূচিতে একদিনের জন্যেও আব্দুর রাজ্জাককে গরহাজির দেখা যায়নি। তাঁর তরুণ অনুসারীদের কারণে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আজমের বিচারের এপিসোডটিও ঐতিহাসিক হয়। বিচারে গোলাম আজমের অপরাধ ফাঁসিতূল্য ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় প্রজন্মের টেলিগ্রাম ইস্যু ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। দেশে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। সে বিচারের রায়-সাজা উদযাপনে রাজ্জাক ভাই থাকবেন না, তা কী হয়!
১৯৯৬-২০০১’র শেখ হাসিনার সরকারে আব্দুর রাজ্জাক পানি সম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশকে বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে তা আজ বাতিলের দাবি উঠেছে ভারতে। অনেকে মনে করেন আব্দুর রাজ্জাক এখন পানি সম্পদ মন্ত্রী থাকলে এভাবে তীরে এসে ডুবত না তিস্তা চুক্তির তরী! প্রনব মূখার্জী থেকে শুরু করে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সে রকমের একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে।
এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংস্কারপন্থী বদনামে একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি, প্রস্তাবিত-বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ পরিদর্শন টিম ছাড়া আর কোন কাজই তাঁকে কখনো দেওয়া হয়নি। সারাজীবন কাজ করেছেন সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক। এবারের মতো জীবনে আর কোথাও কোনদিন অপাংক্তেয় বসে থাকেননি।
ঘনিষ্ঠরা জানেন, এমন দায়িত্ব-কর্মহীন অলস বসে থাকার কারণেই সারাজীবন অবহেলার শরীরে একে একে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে! রোগের কারণ তাঁর মতো একজন সংগঠককে নিদারুণ অবজ্ঞা-অবহেলা!
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’এর রিপোর্টে এসেছে কথিত চিহ্নিত সংস্কারপন্থী নেতার চিকিৎসার খবর নিতে গিয়ে পাছে যদি আবার দল বা সরকারের আক্রোশে পড়েন, সে ভয়ে বিলাতের আওয়ামী লীগের নেতারাও প্রকাশ্যে তাঁর হাসপাতালের আশেপাশে ঘেঁষছেন না!
হায় বাংলাদেশ! তোমার মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের এই বুঝি শেষ পরিণতি! এখন লন্ডনে বসবাসরত শেখ রেহানাই বুঝি নিজে তাঁকে দেখতে গিয়ে নেতা-কর্মীদের এ ভয় ভাঙ্গাতে পারেন। বাংলাদেশ সরকার আর বিলাতের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা উদ্যোগ নিলে আব্দুর রাজ্জাকের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতার জীবন বাঁচাতে এ অর্থ কিছুই না। জীবনের মালিক আল্লাহ। আমরা সবাই মিলেতো একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আব্দুর রাজ্জাক ভাইর স্বজনদের প্রতি প্রানের সহানুভূতি ও দোয়া।
ফজলুল বারী, সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময় ০৭৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০১১