আল্টিমেটামের পুরনো রাজনীতি আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দেশে! একেকজন সম্প্রতি সময়-ক্ষণ জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, চলতি সংসদীয় সরকার অমুক সময়ের পর আর থাকবে না! মহাজাতকও যেন ফেল! এখন আবার খেলাধুলার ঘোষণা দেয়া শুরু হয়েছে। লীগ ম্যাচ-ট্যাচ না।
বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু তথা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর পর যেন বিএনপি হঠাৎ অলআউট অ্যাকশনের কথাবার্তা বেশি বলছে! আওয়ামী লীগের নেতারা পালটা হুমকি দেবার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করছেন তারা ডরাননি! একদম না!
অনেকে মনে করছেন সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের আরও বেশি সক্রিয় করতে এটা খালেদা জিয়ার কৌশলও হতে পারে। কারণ নিজামীসহ দলের চিহ্নিত প্রধান যুদ্ধাপরাধী নেতাদের গ্রেপ্তারের পর বহুল প্রচারিত বিস্ফোরণের বদলে উল্টো এক রকম ঘরে ঢুকে গিয়েছিল জামায়াত-শিবির। ঈমানের কমজোরি থাকলে যা হয়।
কারণ দলের আজকের নেতা-কর্মীদের বেশিরভাগের জন্ম মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে। কিন্তু মাথার ওপর এমন নেতাদের মেনে নিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির সরাসরি সশস্ত্র বিরোধিতা করেছে। গ্রামে-শহরে লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের খুন-ধর্ষণ-লুটতরাজ-রাহাজানির গল্প। এসবের আবার দালিলিক প্রমাণ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পনের খণ্ড আর দলের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের একাত্তরের ফাইলে আছে।
আবার তাদের অনেককে পথেঘাটে লোকজন বলে অমুক রাজাকারের ছেলে বা নাতি! `না উনারা রাজাকার না, ইসলামের পক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে আছিলেন`--, এমন বলে লোকের মুখ কত আর বন্ধ করা যায়!
এমন একজন বলার চেষ্টা করেন, ভারতের সহযোগিতা নেওয়ায় বাংলাদেশ পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারেনি। এর জন্যে ভারতের ওপর তার এখনও রাগ! পাকিস্তানের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ করা সম্ভব ছিল কিনা জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করেন। আসলে এদেরকে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস শেখানো পড়ানো হয়েছে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই তাদের কমজোরি ঈমান টল টলায়মান হয়!
এবার এই সরকারের বিরুদ্ধে আবার আলটিমেটামে `দেখে নেব` জাতীয় ঘোষণা বিএনপির সাবেক একজন নেতা, একজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে শুরু হয়। ইনি এলডিপির নেতা কর্নেল (অবঃ) নেতা অলি আহমদ! বিএনপির সাবেক আমলে জামায়াতের সঙ্গে বেয়াদপির দায়ে কোনঠাসা ছিলেন। মন্ত্রিত্বও জোটেনি। এরপর রাগে-দু:খে বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার এলডিপি নামের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন দোকানটি খোলেন। কিন্তু সে দোকান জমেনি! এরপর আবার বিএনপির নেতৃত্বে ফিরে এসে অলি আহমদ ঘোষণা দেন আগামী বাজেট অবধি এই সরকার আর টিকবে না!
তাহলে কী এর মাঝে কোনও সামরিক অভ্যুত্থান হবে? সেই সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হবে শেখ হাসিনাকে? সে প্রক্রিয়া সম্পর্কে কী ওয়াকিফহাল জনাব অলি আহমদ? আওয়ামী লীগ নেতারা এমন কথাবার্তা পালটা হুমকির সুরে বলাবলি শুরু করার পর কিন্তু অলি আহমদ চুপ মেরেছেন!
অতঃপর নতুন আল্টিমেটামের ঘোষণা এসেছে সরাসরি ‘হর্সেস মাউথে’! তথা খালেদা জিয়ার মুখে! সবশেষ ফাইন্যাল খেলার ঘোষনা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, বর্তমান সরকার আগামী সেপ্টেম্বরের আগে পড়ে যাবে! এরপর খেলাটি নিয়ে ক্রিকেটীয় মন্তব্য করেন সাবেক ডাকসাঁইটে আমলা, বর্তমান বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার। ভদ্রলোক বলেছেন বর্তমান সরকার এখন নার্ভাস নাইন্টিজে আছে! নার্ভাস নাইন্টিজ বলে একটি কথা চালু আছে ক্রিকেটে। নার্ভাসনেসের কারণে তীরে এসে তরী ডোবার মতো সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষমান অবস্থায় অক্কা পান!
ইদানিং প্রায় গরম কথাবার্তা বলেন এম কে আনোয়ার। বলা হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তার রাগের কারণটিও ঐতিহাসিক! এরশাদের কুখ্যাত দোসর আমলাদের রাজনৈতিক আশ্রয় না দেবার সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী লীগ প্রভাবিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আর বিএনপি প্রভাবিত ছাত্র ঐক্যজোটের। আওয়ামী লীগ তখনও আজকের মতো এতটা সুবিধাবাদী ছিল না। তাই এরশাদের দোসর আরেক কুখ্যাত আমলা কেরামত আলীকে নিয়ে দলে যোগ দেবার জন্য ধর্না দিতে এম কে আনোয়ার বত্রিশ নম্বরে গিয়ে বসে থাকলেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আপত্তির কারণে শেখ হাসিনা তাদের সাক্ষাৎ দেননি।
এরপর বত্রিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দু’জনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগ দেন। মওদুদ আহমদসহ বিএনপির সুবিধাবাদী নেতাদের এরশাদ ভাগিয়ে নেওয়াতে খালেদা জিয়া আর বিএনপির তখন একরকম বেহাল হালত!
যেই যাচ্ছিলেন তাকেই নেয়া হচ্ছিল দলে! শেখ হাসিনা দেখা না দেওয়াতে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে না পারাতে অবশ্য তখন এম কে আনোয়ার-কেরামত আলীর লাভই হয়!
বিএনপিতে যোগ দিয়ে দু’জনেই পরে এমপি-মন্ত্রী হয়ে যান। সারাজীবন আমলা হিসাবে ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে থেকে দু’জনেরই অবশ্য ভালো কেটেছে দিন!
কেরামত আলী মারা গেলেও ২০০১-২০০৬ জমানায় আবার মন্ত্রী হন এম কে আনোয়ার। সারাদেশের কৃষি সেক্টরে দলের লোকজন ঢুকাচ্ছেন টের পেয়ে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে এম কে আনোয়ারকে কৃষিমন্ত্রী করা হয়। সবশেষ ইলেকশনে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরতে না পারাতে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত ক্ষমতার কাঠামোর বাইরে থাকায় মেজাজ-মর্জি এম কে আনোয়ারের যে বিশেষ চটে-তেতে আছে তা তার প্রতিদিনের গরম কথাবার্তা স্ক্যান করলেই আঁচ করা যাবে!
খালেদা জিয়া ফাইনাল খেলায় আগ্রহ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, `আমরাও ফাইনাল খেলব। তবে সেই খেলা হবে নেক্সট ইলেকশনে। `
আজকাল খালেদা জিয়ার নানা বক্তব্য একটু আউট অব অর্ডার বা বিধি বর্হিভূত মনে হলে তা একটু সম্পাদনা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর! এ বক্তব্যটিও একটু সম্পাদনা করে মি. আলমগীর বলেছেন ফাইনাল খেলা বলতে খালেদা জিয়া পরবর্তী ইলেকশনকেই বুঝিয়েছেন। তবে নিরপেক্ষ রেফারি ছাড়া বিএনপি খেলবে না। নিরপেক্ষ রেফারি বলতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
এখন বর্তমান ও ভবিষ্যত রাজনীতিক মূল বাহাসের নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার! মজার ব্যাপার আমাদের বিরোধীদলগুলো বরাবর এ ব্যবস্থার পক্ষে থাকে। সরকারে গেলে উল্টো আচরণ করে! এটা আগে বিএনপি করেছে। এখন করছে আওয়ামী লীগ। অনেকটা যেন মিডিয়া আর মত প্রকাশ্যের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে থাকার মতো!
বিরোধীদলে থাকা আবস্থায় বিরোধীদলের টপ টু বটম নেতাকর্মীরা এমন সুশীল মিডিয়াবান্ধব থাকেন যে তা দেখেশুনে মুগ্ধ হতে হয়! যেমন আজকের বিএনপি নেতাকর্মীরা করছেন! কিন্তু সরকারে থাকতে কী করে তারা দেশের প্রথম জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল একুশে টিভি বন্ধ করেছিলেন, জনকন্ঠের সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছিলেন পুরো পাঁচ বছর, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, সেলিম সামাদ, এনামুল হক চৌধুরী, প্রিসিলা রাজদের গ্রেফতারের পর টর্চার করেছিলেন, তা কী এখন মনে পড়ে?
বা সেসব অপকর্মের জন্য আজ অবধি মিডিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন কী কখনো মনে করেছেন?
যেমন দেশের প্রায় প্রধান পত্রিকা-মিডিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকলেও সরকারের একটু সমালোচনা দেখলে ক্ষেপে যায় আওয়ামী লীগ! এর নেতা-কর্মীরা মিডিয়া-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যা খুশি বলেন। যেন মিডিয়া-সাংবাদিকরাই তাদের এক নম্বর শত্রু! এই সরকারের আমলে চ্যানেল ওয়ান বন্ধ হয়েছে। প্রকাশনা বাধাগ্রস্ত হয়েছে আমার দেশ’এর। সবশেষ জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা যেটি করা চেষ্টা হচ্ছে, আজকের আওয়ামী লীগ মনে করছে না যে আগামীতে বিরোধীদলে যাবার পর তারা এর ভিকটিম হবে না?
বিরোধীদল সরকারিদলের পাল্টাপাল্টি ঘোষণা, বিরোধীদলের আল্টিমেটামে অনেকের আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের সেই বহুল আলোচিত বিতর্কিত ৩০ এপ্রিলের আলটিমেটামের গল্পটি মনে পড়েছে। বিএনপি তখন গোয়েন্দা লাগিয়ে এর নেপথ্য মাজেজা খুঁজতে চেয়েছে। যেমন এখন আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ওয়াচে রাখতে! কারণ তার নাকি মতিগতি ভালো না!
একটি সংসদীয় সরকারকে পার্লামেন্টে অনাস্থা ছাড়া এমন আল্টিমেটাম দিয়ে যে ফেলা যায়স না তা কী আব্দুল জলিলের আল্টিমেটামের ফুটো বেলুন থেকে বুঝল না বিএনপি! না খালেদা জিয়া বিএনপির সংগঠনকে আন্দোলনে নামাতে না পেরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মাঠে নামাতে এই জঙ্গি হুঙ্কারের পথ নিয়েছেন! জামায়াত-শিবির সবশেষ যে পুলিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী আক্রমণ চালিয়েছে তাতে তার পক্ষে মানুষের-প্রশাসনের সহানুভূতি বেড়েছে না কমেছে? না জাতিসংঘ বাহিনীতে পুলিশ-র্যাবকে না নিতে বলার পর? দেশের মানুষের যে এত সমস্যা তা নিয়ে তারা ক’দিন রাস্তায় নেমেছেন বা কর্মসূচি দিয়েছেন? বা এসব অব্যবস্থার পালটা কোন সমাধান কর্মসূচি আজ অবধি দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে কী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকায় বলে এসেছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কোন বৈঠক হবে না। শনিবার দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করেও একই ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ, তার ছেলেদের দুর্নীতির মামলার বিচার বন্ধ করতে বলবেন! এ দুটি বিষয় বাদ দিয়েতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা পরবর্তী ইলেকশন সবাইকে নিয়ে করার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হতে হবে। যা প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংশোধনের সময় পার্লামেন্টে একাধিকবার বলেছেন। তাই বৈঠক হবে না বা অপ্রয়োজনীয় এমন কথাতো সরকারি দল বলতে পারে না। গত ২০ বছরের বেশিরভাগ সময় বিরোধীদলের নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। বিরোধীদল কী বলতে পারে বা করতে পারে, এ বিষয়েতো ঢের অভিজ্ঞতা তার আছে।
বিরোধীদল ডাকলেই কিন্তু দেশে হরতাল হয়ে যায়। সরকারি দল মাঠে থেকে বা পুলিশ দিয়ে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে-রাখতে পারে না। বিরোধীদল দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে অনেক কথাই বলতে পারে। সরকারিদল সেখানে ঘৃতাহুতির ব্যবস্থা করতে পারে না। এসবে কখনোই জেতে না সরকারি দল।
এবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, সরকারে থাকলে গায়ের চামড়া গণ্ডারের মতো করতে হয়। অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সে কথাগুলো কী ভুলে গেছেন বা এখন আর দরকার মনে করছেন না শেখ হাসিনা? নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে বিরোধীদল কী করল না করল এর চেয়ে জনগণ দেখতে চাইবে সবাইকে আইনানুগ সঙ্গে নিয়ে চলতে সরকারের সদিচ্ছা। বিরোধীদলকে আলোচনার কথা সরকারি দলকে বলতে হবে। কে কোন বাহানায় আলোচনা এড়িয়ে গেল বা যেতে চাইল তা বিচার-বিবেচনার সামর্থ্য জনগণের ঢের আছে।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময় ১৪২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১১