ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ভোটের হাওয়ায় জোটের রাজনীতি

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১১
ভোটের হাওয়ায় জোটের রাজনীতি

‘দশের লাঠি একের বোঝা’ কথাটা হয়তো সব ক্ষেত্রে ভাল অর্থ বহন করে না, বিশেষত আমাদের জোট রাজনীতির ক্ষেত্রেতো নয়ই। দশ জনকে মিলিয়ে জোটের রাজনীতিতে ভোটের বোঝাটা কমিয়ে, ক্ষমতার ফসল ঘরে আনা গেলেও, আখেরে লাঠির বাড়িটা যে জনগণের মাথায় পড়ে সেটি এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার।



জোটের রাজনীতি প্রতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল নব্বইতে এরশাদকে হঠিয়ে একানব্বাইর নির্বাচনের মাধ্যমে। তখন বিএনপি জামায়াত সরাসরি জোটভুক্ত না হলেও একটা গোপন সমাঝোতা ছিল বলে বাজারে গুজব ছিল। এরপরে জামাতের সাথে মন কষাকষির কারণে ছিয়ানব্বাইতে সেই জোট ঘোট পাকিয়ে ওঠে। সেবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামিলীগ। এভাবে একানব্বাই এবং ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচন দুটো ছিল জোট রাজনীতির পরীক্ষামূলক সময়। যার পুরো বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০১ এর নির্বাচনের মাধ্যমে। সেবার বিএনপি এবং আওয়ামিলীগের অধীনে দুই জোটই বেশ জোড়ালোভাবে নির্বাচনে প্রচারনা চালায়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো পুরোদমে আছে।

বিগত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির হালচাল পর্যালোচনা করলে খুব ভাল কিছু আচ করা যায় না। এখন থেকেই বড় দুই দল আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। জোটের রাজনীতির হিসেব নিকেষও শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি তার শেষ জনসভাকে জোটের জনসভায় পরিণত করে সামনের নির্বাচনে তাদের জোটের একটা ছবি তুলে ধরেছে যেখানে জামায়াত এবং আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোটের মতো প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো রয়েছে।
অন্যদিকে, রাজনীতির প্লেবয় এরশাদকে নিয়ে বরাবরের মতো সংশয় থাকলেও গত সপ্তাহে সে তার অবস্থান পাকা করে ফেলেছে। সে আবারো আওয়ামিলীগের অধীনে মহাজোটে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছে। এরশাদ প্রতিজ্ঞা করেই সব সময় সেটা ভাংগার জন্য। শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা এক সেকেন্ড আগেও বলা সম্ভব নয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান যেমন আন প্রেডিক্টটেবল দল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ তেমনই আনপ্রেডিক্টটেবল একটা চরিত্র।
 
যে এরশাদ এক সময় দুই দলের কাছে স্বৈরাচার এবং ‘লম্পট’ হিসেবে পরিচিত ছিল, জোটের রাজনীতি তার সব কলঙ্ক ধুয়ে মুছে দিয়েছে। জোটের রাজনীতির তীব্র হাওয়ায় শেখ হাসিনা হয়তো ভুলে গেছেন এরশাদ আমলের সেই নির্যাতনের কথা, সেই ১৯৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারির কথা। ঐদিন চট্টগ্রামে এক মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তৎকালীন এরশাদের গু-াবাহিনী এবং পুলিশ মিলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঝাকে ঝাকে গুলিবর্ষণ করেছিল। দলীয় কর্মী বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে না রাখলে ঐদিন তার মৃত্যু হতে পারতো। তাকে বাঁচাতে সেদিন দলের চল্লিশ জন কর্মী জীবন সপে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার কি মনে পড়ে না নূর হোসেনের কথা? বুকে গণতন্ত্রের শ্লোগান লেখা সেই নূর হোসেন? এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য যে জীবন দিয়েছিল?
 
কারো কথাই হয়তো এখন মনে নেই। ক্ষমতার লোভ এতই দুর্নিবার যে অনেক কিছুই ভুলে যেতে হয়। সেই চল্লিশ জন কর্মী এবং নূর হোসেনদের কথা ভুলে গিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। যেমন করে খালেদা জিয়া ভুলে গেছেন লাখ লাখ শহীদদের কথা। হাসিনা এবার ক্ষমতায় এসে ২১শে আগস্টের ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলার বিচার করছেন। অথচ তার আগে ঘটে যাওয়া চল্লিশজন কর্মীর হত্যার বিচারের ব্যপারে কোন স্বিদ্ধান্ত নেই। কারন  ৮৮র ২৪শে জানুয়ারি যারা নিহত হয়েছিলেন তারা ছিলেন নিতান্ত সাধারণ কর্মী এবং সেই নাটের গুরু এরশাদ ভোটের রাজনীতিতে এখন আওয়ামিলীগের সহচর। অন্যদিকে, একুশে আগস্টে কর্মীদের সাথে নেতারাও নিহত এবং আহত হয়েছিলেন। যে কর্মীদের নিঃস্বার্থ আতœত্যাগে দল এবং নেতারা টিকে থাকে তাদের মৃত্যুর কোন দাম নেই। মনে হয় জন্মই হয়েছে এদের দল এবং নেতাদের সেবার জন্য। এতো বেঈমানীর পরেও দুই নেত্রীর ডাকে জীবন বাজী রেখে লাখ লাখ মানুষ ছুটে আসে তাদের মুখের দু কথা শুনার জন্য। জনগণের এই অতি আবেগ এবং দল ও নেতাদের প্রতি শর্তহীন ভালবাসাই তাদেরকে অবিবেচক এবং স্বার্থপর বানিয়েছে।

খবরে আরো দেখলাম খুলনার দৌলতপুর কলেজের সাবেক ভিপি নুরু যে কিনা ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগকে দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে সে মহা সাড়ম্বরে আওয়ামিলীগে যোগ দিয়েছে। দৌলতপুরে তার বাসায় খুলনার আওয়ামিলীগের বড় বড় নেতারা নিয়মিত যাতায়াত করেন। শুধু তাই নয়, গত ১লা জুন খুলনার এক সময়ের র‌্যাব পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্নদ হোসেন মুক্তা একই কায়দায় আওয়ামিলীগে যোগ দিয়েছে। আতঙ্কের খবর হচ্ছে, তাকে দলে ভোট বাড়ানোর দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। একজন ডাকাত, খুনী কিভাবে ভোট বাড়াতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।

প্রধানমন্ত্রী যখন জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলে তাদেরই লোক নিজ দলে নিয়ে দল ভারী করে কিংবা সন্ত্রাসীদের আমার দলে ঠাঁই নেই বলে মুক্তার মতো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীকে নৌকার যাত্রী করে, তখন আর কি বলার থাকে। রাজনীতিবিদদের সব কথাই যে কথার কথা সেটা না বুঝে উপায় আছে? আসলে ভোটের রাজনীতেতে কে রাজাকার আর কে স্বৈরাচার ছিল তা এখন বাস্তব অর্থে আপেক্ষিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পক্ষে থাকলে গোলাম আযম, নিজামীরাও ধোয়া তুলসী পাতা, আর এরশাদও চরিত্রবান হয়ে যায়। মাঝখানে আন্দোলনের নামে জীবন দেওয়াটা পুরোটাই মাটি।

আজকে আমরা জামাতকে রাজনীতিতে মাইনাস করতে বলছি, স্বৈরাচার এরশাদকে দূর দূর করছি। কিন্ত বাস্তবতায় সেটা কিভাবে সম্ভব? প্রধান দুই দল ক্ষমতায় যাবার জন্য এতো বেশি উতলা থাকে যে, তারা ক্ষমতায় যেতে যে কোন উপায় নিতে প্রস্তুত। ক্ষমতায় গিয়ে গণ বিচ্ছিন্ন হবার কারনে ভোটের সময় কেউ আর নিজের একার উপরে ভরসা রাখতে পারে না। আশেপাশে যাকে পায় তাকেই লুফে নেয়। কে রাজাকার, কে স্বৈরাচার, কে সন্ত্রাসী সেই হুশ আর  থাকে না। যে কারনে এরশাদ আজ আওয়ামিলীগের ছাতার নীচে, ঠিক একই কারনে জামাত বিএনপির বগলে আশ্রয় নিয়েছে। আজ আওয়ামিলীগ এরশাদকে ঠেলে ফেললে সে যেমন বিএনপির বড়শীতে গেথে যাবে ঠিক একইভাবে জামাতকে ছাড়লে আওয়ামিলীগ সেই সুযোগ নিতে একটুও দেরী করবে না। অতীতের ঘটনাবলী সেই আশংকাকেই মনে করিয়ে দেয়।

রাজনীতি থেকে এই অশুভ শক্তিগুলোকে তাড়াতে হলে জোট রাজনীতি নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। জোট রাজনীতি আর কিছু না হোক দেশে জামাত শিবির এবং স্বৈরাচারী এরশাদকে আবারো প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজনীতিতে এই জোটের গুরুত্ব যতোদিন থাকবে ততোদিন পরগাছার মতো জামাত, এরশাদ উভয়েই বেঁচে থাকবে। মাঝখানে আমরা কলমবাজরা ওদের বিরুদ্ধে কিছু লিখে সাময়িকভাবে বাহবা পাবো।
 
এইতো সেদিন খালেদা জিয়া জামাতের সমালোচনা করেছিল আওয়ামিলীগের সঙ্গে যুগপত আন্দোলন করার জন্য। ঠিক একইভাবে হাসিনা এরশাদকে গালি দিয়ে ফালি ফালি বানিয়েছিল। ক্ষমতার ম্যাজিকে বিএনপি জামাত এবং আওয়ামিলীগ এরশাদ কতো কাছাকাছি, কতো বন্ধুত্ব! বড় দুই দল তাদের আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হয়নি। ওনাদের আদর্শ হচ্ছে, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই’। জনগণও দলের স্বার্থে জীবন দেবার আদর্শে পিছিয়ে নেই। আগেও অনেকে জীবন দিয়েছেন, এখনো হাজার হাজার কর্মী জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। কি বিচিত্র এই রাজনীতি, কি বিচিত্র এই আমরা!
mahalom72@yahoo.com

বাংলাদেশ সময় ০৫১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।