ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এই বর্বরতাকে ধিক্কার!!

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১১
এই বর্বরতাকে ধিক্কার!!

ঢাকা: মধ্যযুগ, ঘোর মধ্যযুগ! না হলে কী প্রকাশ্যে মানুষের ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার প্রথা টিকে থাকে কোনো সমাজে?  যখন দুনিয়ার দিকে দিকে আধুনিকতা, গণতন্ত্র  আর মানবাধিকারের ধ্বজা উড়ছে, যখন মানুষ হয়ে উঠছে তার স্বপ্নের সমান বড়, তখন গাড়ি চালানোর , একাকী বাইরে বেরোবার অধিকারটুকুও পাচ্ছে না সৌদি নারীরা। ইসলামে রাজতন্ত্রের তিলার্ধ স্থানটুকুও নেই অথচ সেখানে পতপত করে উড়ছে রাজতন্ত্রের পতাকা।



সমাজ-সভ্যতার বিপরীতে, মানবতা ও করুণার বিপরীতে রাজতন্ত্রকে আঁকড়ে থাকা দেশ সৌদি আরবে চলছে প্রকাশ্যে মানুষের শিরশ্ছেদ করার বীভৎস নারকীয় (অপ)বিচার!!!

যেহেতু পুরোটা বিচারই লোকদেখানো। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। তাই এককথায় এটি বিচারের নামে নৃশংস রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ মাত্র। প্রাচীন সমাজের অশ্বমেধ, গোমেধযজ্ঞের মতো একুশ শতকে এসেও দেশটি আঁকড়ে আছে ‘মানবমেধযজ্ঞের’ মত্ততাকে।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দূতাবাসকে পর্যন্ত জানানো হয় না। লাশও পাঠানো হয় না তলোয়ারের কোপে কতল হওয়া হতভাগ্য মানুষগুলোর স্বজনদের কাছে।   সভ্য সমাজের কোন্ মানদণ্ডে পড়ে এমন বিচার?

এবার বলির পাঁঠার মতো তলোয়ারের এক কোপে প্রকাশ্যে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ’হত্যা’ করা হলো একজন দু’জন নয়, ৮ বাংলাদেশিকে। শত শত মানুষের চোখে সামনে, প্রাচীন রোমে সিংহের খাঁচায় মানুষকে ফেলে দিয়ে হত্যার বীভৎস উল্লাসকেও হার মানায় জুমার দিনে দণ্ডিতের কল্লা কাটার এই যজ্ঞ। প্রাচীন রোমের কলোসিয়ামের ধ্বংসাবশেষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে অতীতের স্মৃতি হয়ে।   আর সৌদি আরবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আধুনিক কলোসিয়াম যেখানে জুমার নামাজ পড়তে আসা মানুষজনকে বাধ্যতামূলকভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে হয় আদম সন্তানের কল্লা কাটার গা শিউরে ওঠা, বিবমিষা জাগানো দৃশ্য।

আমরা প্রতিবাদ জানাই বিচারের নামে এই প্রহসনের, ধিক্কার জানাই প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এই নৃশংস বীভৎস অমানবিক আসুরিক প্রথার। এই প্রথা, এই অপযজ্ঞ বরং সৌদি সমাজে বিরাজমান ডুয়াল সিস্টেমকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় ইসলামের পাশাপাশি সামন্তবাদী-রাজতন্ত্রী ব্যবস্থার কী বিপরীত সহাবস্থান সেখানে।

উইকিলিকসের গোপন ফাইলে বর্ণিত অসংখ্য হেরেমে আকীর্ণ এই মরুময় দেশটিতে একদিকে চলছে ভোগ আর বিলাস-ব্যসনের মোচ্ছব, উটের দৌড় আর বাজপাখি শিকারের নেশায় মত্ত যুবরাজদের প্রমোদবিহারে কেচ্ছা কাহিনি। অন্যদিকে পশ্চিমাদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে, তাদের অঙ্গুলি হেলনে টিকে আছে আরবশাহীর তখত-এ-তাউস।

তাই কোনো আমেরিকান অপরাধী হলেও তার জন্য সেখানে সাত খুন মাপ। বিমানবাহী রণতরী আর ক্রুজ মিসাইলের শ্যেনচক্ষুর ভয় বলে কথা! ঢিলটি মারলে যে পাটকেলটি খেতে হবে। অতএব পশ্চিমাদের আলগা খাতির দেখিয়ে সমঝে চলার নীতি।

কিন্তু বাংলাদেশ, ফিলিপাইন , ইন্দোনেশিয়া, সুদান লাইবেরিয়ার মতো দরিদ্র দেশের নাগরিক হলে? পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই!!!

এসব দরিদ্র দেশের শ্রমিক-মজুরদের জন্য নেই সুবিচার পাওয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যূনতম সুযোগও। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবি-না-জানা অসহায় বিপন্ন এসব গরীব ভিনদেশি শ্রমিক ও মজুর শ্রেণীর মানুষের অনেক সময়  লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের দেশের দূতাবাসও খোঁজ নেয় না।   আবার অনেক সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না পেয়ে, ভুল বিচারের  ফাঁদে পড়ে মুত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হয় অনেকে। নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুদণ্ডিত হওয়ার আশংকা এবং নজিরও কম নয়।

 এই চোখে-ঠুলি-পড়া বিচারে মোটেই প্রমাণ হয় না দণ্ডিতরা আসলেই দোষী। ৮ বাংলাদেশির বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। কেননা আমরা মনে করি, স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নিয়মের বাইরে কাউকে বিচার করার, শাস্তি দেবার এক্তিয়ার কারোরই নেই। এই ৮ বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করার ঘটনা রাষ্ট্রীয় বর্বরতার নগ্নরূপকেই তুলে ধরে।

ধিক! শত ধিক! মরুভূর ধূ-ধূ বালির চেয়েও রুক্ষ-নির্মম পাষাণের উপমা হয়ে আছে যে সমাজ, যে রাষ্ট্র ---  সেই  সমাজ-রাষ্ট্র, আমরা চাই, সভ্য পৃথিবীর কাতারে এসে দাঁড়াক; আমরা চাই  বন্ধ হোক প্রকাশ্যে মানুষের ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার পাশব ব্যবস্থা।   বন্ধ হোক পশ্চিমাদের তল্পিবহন আর দরিদ্র দেশের মানুষের প্রতি আকাশচুম্বি লাঞ্ছনা-অবিচারের অশেষ কাহিনির যবনিকাপাত।

কিন্তু সেদিন কবে আসবে? সেতো দূর আস্ত্ , হনুজ দূরআস্ত্---সে অনেক , অনেক দূরে!!!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।