সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশির শিরোশ্ছেদ নিয়ে আমরা সবাই হতবাক, শোকার্ত এবং ক্ষুব্ধ! কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি বা জামায়াতেরও কোন রা’ নেই! দেশে যখন ফতোয়ার একটি সালিশের বিচারের নামে গরিব নারী-পুরুষদের দোররা মারা, গ্রামছাড়া করা বা আত্মহননের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা কিছু লোক যখন এ নিয়ে হা-হুতাশ-হৈচৈ লেখালেখি করি, তখনও দেশের ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লা কিসিমের লোকজন চুপ মেরে থাকে! মানুষের মনের ক্ষোভ ধারণ করে দেশের হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট যখন ফতোয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন প্রধান দলগুলোর আশ্রয়ে থাকা ফতোয়াবাজরা উল্টো মুরতাদ বলে তাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছোঁড়ে! রাষ্ট্রও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না বা ঘাঁটাঘাঁটিতে যেতে চায় না। দেশেবিদেশে এমন একটি ‘না কিছু কইতে পারি না কিছু সইতে পারি’ গোছের বর্বর সমাজ-সময়ে আমরা আছি!
বলা হচ্ছে ‘সৌদি আরবে এমন ৮ বাংলাদেশির গর্দান গেল, তাদের আইনের নামে তারা লাশ পর্যন্ত দিল না’ তাহলে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস করলটা কী? এটাও যেন সব জেনেশুনে এক ধরনের অক্ষমের আর্তনাদ আর কী! দূতাবাসগুলো নিয়ে দেশের ভুক্তভোগী মানুষজনের অনেক বিরূপ অভিজ্ঞতা আছে।
আমাকে তেমন একজন ভুক্তভোগী ছাত্র জানালেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান ফটকের রিসেপশনে যেতেই একজন তার কাজ থেকে কাগজপত্রের সঙ্গে ভিতরের স্যারদের খরচাপাতি হিসাবে ১৮০০ টাকা রাখেন। তার সামনে আরেকজন দিচ্ছেন দেখে তিনিও নিয়ম মনে করে তা দেন। তার কাগজপত্রও বিনা ঝঞ্ঝাটে সত্যায়িত হয়ে চলে আসে! বিদেশের দূতাবাসগুলোয় যারা নানান কাজের জন্য যান, এমন অভিজ্ঞতা তাদের বিস্তর। এসব নিয়ে বাহাস করার সময়ও ভুক্তভোগীদের তেমন বিশেষ যেন করণীয়ও নেই! দেশের দূতাবাসগুলো নিয়ে যেখানে বেশিরভাগ প্রবাসী মানুষজনের এমন সাধারণ ধারণা, সেখানে প্রাত্যাহিক এসব ব্যস্ততার বাইরে গিয়ে সৌদি আরবের ঘটনায় দূতাবাসও ঘটনাটিতে এই করে ফেলত, সেই করে ফেলত, এমন সেখানকার ক’জন বাংলাদেশি ভেবেছেন বা ভাবতে পেরেছেন?
দূতাবাসগুলোর সব স্টাফ হয়ত সমান দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা অকাজের না। ভালো ও কাজের অনেক কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু সাধারনভাবে দূতাবাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে প্রবাসীদের এমন একটি ধারণা কী অসত্য? বুকে হাত রেখে তারা তা প্রকাশ্যে বলতে পারবেন কী?
৮ বাংলাদেশির গর্দান যাবার পর সেখানকার দূতাবাস ফিরিস্তি দিয়ে বলেছে প্রথম থেকে বিষয়টি নিয়ে তারা কি কি করেছে না করেছে। একটা গাফিলতি অথবা দুর্বলতা যেটি তাদের কথাবার্তায় বেরিয়ে এসেছে তাহলো, মিশরের কায়রোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত না থাকাতে মিশরীয় পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগটি তারা নিজেরা করেছেন। কায়রোর দূতাবাসের মাধ্যমে করেননি। সেটি করলে কি সমস্যা হতো তা রিয়াদের বাংলাদেশ হাইকমিশন স্পষ্ট করতে পারেনি।
সবশেষ সমস্যাটিতো দেখানো হয়েছে মিশরীয় পরিবারটি ক্ষমা না করাতে ওই ৮ জনের গর্দান বাঁচানো যায়নি! সেখানে সমঝোতার চেষ্টাটি যদি কায়রোর দূতাবাসের মাধ্যমে করা হতো, কায়রো দূতাবাসের কর্মকর্তারা যদি সশরীরে পরিবারটির বাড়ি চলে যেতেন, বা পরিবারটিকে দূতাবাসে নিয়ে আসতেন, বা স্থানীয় প্রভাবশালী মিশরীয় কারো মধ্যস্থতায় একটা সমঝোতার চেষ্টাতো করা যেত, তাই নয় কী? দুর্ভাগ্য আমাদের যে বিষয়টি নিয়ে আমরা এমন এক সময়ে কথা বলছি যখন ৮ প্রবাসীর গর্দান অলরেডি চলে গেছে। আমরা এখন এসব কথাবার্তা বলে তাদের ফেরতও আনতে পারব না। আর গর্দান চলে যাবার আগে পর্যন্ত দূতাবাস বা বাংলাদেশ সরকার তা আমাদের জানতেও দেয়নি। আর দূতাবাস বলেছে সবশেষ গর্দান হয়ে যাবার পর তা তারা জেনেছে!
আরেকটি বিষয়, গর্দানের ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটল যখন প্রধানমন্ত্রী দূত হিসাবে সৌদি আরব সফর করেছেন জেনারেল এরশাদ! সৌদি আরব আর মিডল ইস্টে তার নাকি অনেক প্রভাব! মরুর রাজা-বাদশাহ’রা তার কথায় এটা করেন সেটা করেন, এমন অনেক কিসসা-কাহিনী আমাদের শোনানো হয়েছে। তা এ ইস্যুতে সকল কাজ-অকাজের কাজী এরশাদ কি করেছেন না করেছেন বা আদৌ করেছেন কীনা, তা দেশের মানুষকে জানানো হবে কী? না মধ্যপ্রাচ্যে কথিত দূতিয়ালগিরির প্রথম অ্যাসিড টেস্টেই তিনি ফেল? সবশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার সফরের সময় নাকি তাকে বোন ডেকেছিলেন সৌদি বাদশাহ, তা বোনের প্রতি এই বুঝি শুভেচ্ছা বাদশাহ নামদারের! তা শুভেচ্ছা হিসাবে বাদশাহ নামদার বোনের কাছে লাশগুলোও হস্তান্তর করতে পারতেন কী?
বা আমরা শুনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে খুব পেয়ারের সম্পর্ক সৌদি রাজপরিবারের? ঘটনাটিওতো তার ক্ষমতার জমানার! এখনওতো সৌদি রাজকীয় অতিথি হিসাবেই লাটবহর নিয়ে ওমরাহ হজ করতে তিনি সৌদি আরব যান। তা এই কিছুদিন আগেও যে তিনি সৌদি আরব গেলেন, তার এত প্রভাবের কানাকড়ি দিয়ে তিনি দেশের মানুষগুলোর জীবনরক্ষার কোনও চেষ্টাও কি তিনি করেছেন? না ভেবেছেন ভালোয় ভালোয় এদের গর্দান হয়ে গেলে এ ইস্যুতেও সরকারকে আরেকটু দোষারূপ, গালি দেওয়া যাবে!
এই সবকিছুই অক্ষম আমাদের ৮ স্বজনের গর্দানের আগেপরের পরিস্থিতির এলোমেলো ভাবনার সংকলন। ঘটনাটি এমন এক দেশের সঙ্গে ঘটেছে, আল্লাহ’র ঘর থাকাতে যে দেশের সরলপ্রাণ মুসলমান অনেকে বিসমিল্লাহ না বলে দেশটির নাম মুখে আনেন না! নিজেরা যত গরিব-মজলুম হোন না কেন, জমি-জিরাত বেচে হলেও হজের টাকা সেই ধনকুবের সৌদিয়ানদের হাতে তুলে দিয়ে আসেন। সে দেশটি আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়ে গেলেও পাকিস্তান বা গোলাম আজমের মতো বাংলাদেশের কিছু শত্রু পাকিস্তানপন্থী নরককীটের তদবিরের প্রভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের দেশটিকে স্বীকার করে নেয়নি বা স্বীকৃতি দেয়নি!
আল্লাহ’র ঘর থাকাতে সেই দেশেই সব ভুলে আমাদের হাজিরা এখনও প্রতি বছর হজ করতে যান। প্রতিবছর এমন হাজিদের সংখ্যা আর এ থেকে তাদের আয়-রোজগার শুধুই বাড়ছে। সে টাকা তারা বিনিয়োগ করে আমেরিকায়! মউজ ফূর্তি করতে ড্রাইভ করে পাশের দেশ বাহরাইন বা একটু ফ্লাই করে দুবাই-বৈরুত চলে যায়! আর আমাদের যেহেতু দেশে কাজের ব্যবস্থা নেই, অবিরাম রাজনৈতিক হানাহানিতে যেহেতু কাজের ব্যবস্থা হবার সুযোগও নেই, সেখানে অল্প মজুরির ম্যানপাওয়ার হিসাবে আমাদেরও সহজ গন্তব্য সৌদি আরবের মতো কিছু জংলি আইনে শাসিত বর্বর দেশ।
যেগুলোয় মুসলমান বা মানুষ হিসাবেও আমাদের কোনও দাম নেই। আমাদের কম টাকায় খাটিয়ে ব্যবহার করে তারা মিসকিন নামে ডাকে! সৌদি বাসাবাড়িতে কাজ করা পরিচারিকা নামের বুয়াদের এসব আরব জোব্বাধারী বাবা-ছেলে ধারাবাহিক ভোগ করে। বাবা বেরুবার পর গৃহচারিকার কক্ষে ঢুকে তারই প্রাপ্ত অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন ছেলে। আর এসবের প্রতিবাদ করলে ইন্দোনেশিয়ার সেই গৃহপরিচারিকার মতো গর্দান যায়! গর্দানের আদেশ দেয় জংলি আইনের প্রতিভূ শরীয়া বিচারকের নামে তেমন কোনও একজন, যে হয়তো নিজেও তেমন পিতা-পুত্রের ধারাবাহিক এনজয়-উপভোগের শরিক কেউ।
এরপরও আমাদের মানুষ কাজের জন্য সৌদি আরব যায় বা যেতে হয়। কারণ দেশে উপায় যে নেই আমাদের! এখানে অস্ট্রেলিয়া আসতে একজনের আইএলটিএস স্কোর আর বিশেষ কোনও শাখায় স্কিল্ড থাকা লাগে। সৌদি আরবে তা লাগে না। গতর খাটতে পারলেই হয়। সে কারণে আমাদের দেশের ম্যানপাওয়ারের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। রেমিটেন্স আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সৌদি আরব! এই যে বর্বর একটি আইনে আমাদের দেশের ৮ জনের গর্দান তারা নিল, এরপরও আমরা কসম খেটে বলতে পারব না আমরা সৌদি আরব যাব না, তারা বর্বর-জংলি তাদের দেশে যাব না! কারণ আমরা যে গরিব। দেশে যে আমাদের কাজ নেই!
সৌদি আরবে আজ পর্যন্ত কোনও মার্কিন অথবা ব্রিটিশের এমন গর্দান গেছে শোনা যায়নি। কারণ ওই দেশগুলোতো তাদের আব্বা-প্রভু লাগে! আমাদের মতো গরিবদেশগুলোর মানুষের হজের টাকার আয় তারা ওই দেশগুলোতে বিনিয়োগ করে! সৌদি রাজপরিবারও মধ্যপ্রাচ্যে লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করে ওই দেশগুলোর! সে কারণে আরব জাহানের গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও সৌদি আরব বা বাহরাইনের ব্যাপারে তারা কিছু বলে না! সেখানে যে গণতন্ত্রের গ’ বলতেও নেই, আমাদের দেশের গরিব মানুষেরা সেখানে নিত্য নিগ্রহের শিকার, যা নিয়ে টু-শব্দটিও করেন না আমাদের হাসিনা-খালেদা-এরশাদ বা জামায়াতিরা!
তাই সব জেনেশুনে কাজের জন্য, জীবনে বাঁচার বা ভালো একটা জীবনের জন্য আমাদের যেসব মানুষজন এরপরও যারা সৌদি আরব যাচ্ছেন, সেদেশে যারা আছেন, তাদের সবার প্রতি বিনীত আবেদন, দেশটির জংলি আইন-কানুন নিয়ে আরও একটু বেশি সতর্ক থাকবেন। কারণ আপনাদের সেখানকার সব পরিস্থিতি আপনাদেরই সেখানে সামাল দিয়ে চলতে হবে। মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে সব অন্যায়। তা যদি না পারেন তাহলে বর্বর দেশটিতে যাবেন না বা থাকবেন না। সেখানে থাকতে যেহেতু হবেই, দূতাবাস, দেশ বা রাষ্ট্র বা সৌদিদের সো-কল্ড রাজকীয় অতিথি আমাদের নেতারা যেহেতু কিছু করবেন না বা করতে পারবেন না, তাই সেদেশের আইন কানুনের নামে অবিচার সব জেনেশুনেও সাবধানে থাকতে হবে। কারণ সবার আগে জীবন বড়। গর্দান হারানো ৮ জনের পরিবারের জীবনে-সংসারে যে কান্না আর দুর্ভোগের অভিশাপ নেমে এসেছে, এরপর আর কোনও পরিবারে পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা কেউ আর চায় না ।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক!
বাংলাদেশ সময় ১১০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১১