ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮
জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

এই বছরটা আমার জন্য খুব ভালো একটা সংবাদ দিয়ে শুরু হয়েছে। বছরের শুরুতেই জানতে পেরেছি যে এই বছর থেকে ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে না। সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। আমি রাষ্ট্রপতির কাছে কী ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাবো, বুঝতে পারছি না, তিনি যদি এই ব্যাপারটি নিয়ে আগ্রহ না দেখাতেন, এই দেশে সেটি কখনও ঘটতো বলে মনে হয় না।

আমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে একেবারে গোড়া থেকে জড়িত ছিলাম। কয়েক বছর যাওয়ার পর যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগল তখন থেকেই আমি টের পেতে শুরু করলাম যে, এই ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে অমানবিক বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা সারারাত বাসে বসে অন্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিতে আসে, তাদের একটা বাথরুমে পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ থাকে না। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে তারা কী ভর্তি পরীক্ষা দেয় আমি জানি না।

এক বছর ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে বাস থেকে নামার সময় অন্য একটি বাসচাপায় একটা ছেলে মারা গেলো, আমার মনে হচ্ছিল, এই ছেলেটির মৃত্যুর জন্য কোনও না কোনোভাবে নিশ্চয়ই আমরাই দায়ী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিটের জন্য দেশের ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো চেষ্টা করে। যে ছেলে বা মেয়ে যত বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারে, কোনও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তার তত বেশি বেড়ে যায়। ভর্তিপরীক্ষা দিতে অনেক টাকার দরকার, শুধু যে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য টাকা দিতে হয় তা নয়, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় অভিভাবকদের সঙ্গে যেতে হয়, গাড়ি ভাড়া-ট্রেন ভাড়া দিতে হয়।

হোটেল ভাড়া করে সেখানে থাকতে হয়, খেতে হয়। এত টাকা খরচ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। তাই ঘুরেফিরে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে, গরিবের ছেলেমেয়েরা শুধু বাড়ির কাছের একটি-দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারলেই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে। কাজেইভর্তি পরীক্ষা শেষে দেখা যেত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়েছে, এই কলুষিত সিস্টেমে গরিবের ছেলেমেয়েরা ছিটকে পড়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মেয়েদের। বাবা-মা অনেক সময় ছেলেদের দেশের নানা জায়গায় একা একা পরীক্ষা দিতে দিয়েছেন, মেয়েদের সেভাবে যেতে দিতে সাহস পাননি। তাই মেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেয়েছে কম।

শুধু যে পরীক্ষা দেওয়ার খরচ তা নয়, দেশে এখন ভর্তি কোচিং নামে বিশাল একটা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। যদি কেউ স্কুল-কলেজে লেখাপড়া না করে শুধু ভর্তি কোচিং করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেতে পারে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সিস্টেমে একটা বিশাল গলদ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে ভালো ছেলেমেয়েদের বেছে নেওয়া, যদি কোচিং সেন্টারগুলো তাদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গছিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ আছে।

সত্যি সত্যি এই ভর্তি কোচিংয়ে কোনও লাভ হয়, তার কোনও প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমার কাছে বরং উল্টো প্রমাণ আছে যেখানে একজন শুধু আমার মুখের কথাকে বিশ্বাস করে নিজে নিজে পড়াশোনা করে ভর্তি পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো করেছে। কিন্তু এই কথা কয়জন বিশ্বাস করবে?
পথে-ঘাটে পর্যন্ত পোস্টার লাগানো থাকে, যেখানে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করা ছেলেমেয়েদের ছবি দিয়ে কোচিং সেন্টার বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।

আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে আরও একবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন ডক্টর প্রাণ গোপাল দত্ত ভাইস চ্যান্সেলরদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি ছিলেন। মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া যায়, তার ওপরে একটি বক্তব্য দিতে। আমি নেহায়েত বোকাসোকা মানুষ বলে সেখানে বক্তব্য দিতে রাজি হয়েছিলাম। বক্তব্য দেওয়ার সময় দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলররা অল্প সময়ের জন্য এসে চেহারা দেখিয়ে চলে গেলেন এবং যাওয়ার আগে বলে গেলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা যথেষ্ট ভালোভাবে চলছে সেটা পরিবর্তন করার কোনও প্রয়োজন কিংবা সুযোগ নেই। কয়েকজন ভাইস চ্যান্সেলর বললেন তাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরীক্ষা নেওয়া হলের মান নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

আমি ভেবেছিলাম সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষকদের যে একটা বাড়তি উপার্জন কমে যাবে সেই কথাটি হয়তো অন্তত ভদ্রতা করে কেউ মুখ ফুটে বলবে না। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সেটা বলেই ফেললেন! তিনি জানালেন যে ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে তিনি যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে রাজি হয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান, তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেবেন না। অর্থলোভের এ রকম সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমি এর আগে আর কারও মুখে শুনিনি।

আমি তখনই বুঝেছিলাম যে, এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কখনোই নিজের উৎসাহে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য এগিয়ে আসবেন না। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা শুরু করার একটি মাত্র উপায়, সেটি হচ্ছে তাদের জোর করে রাজি করানো! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত তাই তাদের জোর করে রাজি করানো কাজটি সহজ নয়! সেটি করতে হবে অনেক ওপরের মহল থেকে চাপ দিয়ে। আমার ধারণাটি ভুল ছিল না, শুধু রাষ্ট্রপতি বিষয়টি উত্থাপন করার পরই প্রথমবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথমবার রাষ্ট্রপতির ইচ্ছেটুকুর প্রতি সম্মান পর্যন্ত দেখায়নি। এই বছর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে, আমি এখনও নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি, যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যি সত্যি বিষয়টি না ঘটবে, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো না।

আমার আশঙ্কাটুকু মোটেও অমূলক নয়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আলোচনাটি শুরু হওয়ার পর আমি নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বক্তব্যের কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছি! বক্তব্যগুলো এ রকম; ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কী মুখের কথা নাকি? বললেই হলো?’ কিংবা ‘এটা কোনোদিন কাজ করবে না! নেভার’ কিংবা, ‘মেডিক্যাল নিচ্ছে বলেই আমাদের নিতে হবে কে বলেছে? মেডিক্যাল আর আমরা কি এক জিনিস?’ ইত্যাদি ইত্যাদি!

আমি আশা ছাড়তে রাজি নই। আমি জানি প্রক্রিয়াটাকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হবে, অর্থলোভ খুবই ভয়ঙ্কর। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন খুব কম ছিল। মনে আছে একজন লেকচারারের বেতন কত কম, সেটা একবার একটা কলামে লিখে ফেলেছিলাম। পরদিন আমার সহকর্মী লেকচারার মাথায় থাবা দিতে দিতে আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, ‘স্যার আপনি করেছেন কী? আমার বিয়ের কথা হচ্ছিল, বিয়েটা ভেঙে গেছে!’

যাই হোক, সেগুলো অতীতের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন এখন অনেক বেড়েছে, শুধু টাকার লোভের জন্য এই দেশের ছেলেমেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করে যাবে আমি সেটি বিশ্বাস করি না!
আমি আশা করে আছি, এর পরের ভর্তি পরীক্ষাটি হবে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা! বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের আর কখনও অতীতের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এনএইচটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।