বাইরে থেকে পড়াশোনা করার কারণে গ্রামের বাড়িতে তেমন একটা থাকা হয়ে ওঠে না। একবার গ্রামের বাড়িতে শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হতেই রাস্তার পাশে মানুষের জটলা দেখতে পাই।
এটা গ্রামের এক সাধারণ দৃশ্য। বেশি মানুষ দেখে সেখানে যেতে ইচ্ছা করলো। কেউ ব্রাশ করছে, কেউবা মুড়ি খেতে খেতে খোশগল্পে মেতে আছে। তাদের গল্পের বিষয় দেখে একটু বিস্মিত হলাম। বিস্মিত হওয়া যেমন ঠিক ছিল, তেমনি না হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিল না। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু দেশের রাজনীতি।
প্রথমে বিস্মিত হওয়ার কারণটা বলা যাক। গ্রামের খেটে খাওয়া দিনমজুর, দিন-এনে-দিন-খাওয়া মানুষের মুখে রাজনীতি আর রাজনৈতিক নেতাদের বুলি নিতান্তই বিস্ময়ের। দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলই তাদের কথা বলার বিষয়। খেয়ে-না-খেয়ে থাকলেও তারা যে তাদের পছন্দের দল আর দলনেতাদের কতোটা ভালোবাসেন সেটাই ছিল সেদিন আমার বিস্মিত হবার কারণ।
নিজ দল আর নেতাকর্মীদের গল্পের ভিতরে একেকজনের এমনই মনোনিবেশ যে, একজন তো কামলা খাটতে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসা সন্তানকে বলেই বসলো: `আজ আর কাজে যাবো না। ` কারণ তার দলের নেতার বিরুদ্ধে অপর দলের এক সমর্থক কটূক্তি করেছে।
নেতা আছে নেতার জায়গায়, আরাম আয়েশে; আর খেয়ে- না-খেয়ে-থাকা কর্মীটি নেতার প্রতি অন্ধ ভালোবাসায় সিক্ত-গদগদ হয়ে কামলা খাটতে না যাবে না বলে পণ করেছে আর মাজায় গামছা বেঁধে নেতার সম্মান রক্ষায় নেমেছে তর্কযুদ্ধে। এ ব্যাপারটি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
এক পর্যায়ে প্রচন্ড বিএনপিপ্রেমী সদুকে (গ্রামের বিকৃত নাম) প্রচণ্ড আওয়ামীপ্রেমী নাদু (গ্রামে সংক্ষিপ্ত নামে ডাকতেই বেশি পছন্দ করে) প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো, সদু যদি তার দলনেত্রীর বাপের নাম বলতে পারে তাহলে তাকে নাদু পাঁচশ টাকা দেবে। ওমনি সদুও এক হাজার টাকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নাদুকে তার দলের নেতার নাম বলতে বলে। কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর তাদের দুজনেরই মুখে আর কথা সরে না। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আলোচনার ঝড়ও গেল থেমে। কেউ কাউকে প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলো না। তাতে কী! প্রিয় দল আর দলের নেতাদের তারা যে কতোটা অন্ধভাবে ভালোবাসে সেটা বোঝা গেল এ বিতর্কের মধ্য দিয়ে।
যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ অক্ষরজ্ঞানহীন, সে দেশের সাধারণ জনগণের মনের প্রচ্ছন্ন ভালোবাসাকে পুঁজি করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। এতে তাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ।
নানা সমস্যার যাঁতাকলে পড়ে জীবন ধারণ করলেও প্রিয় দলের প্রতি অতি সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের যে প্রশ্নাতীত উচ্ছ্বসিত ভালোবাসা চোখে পড়লো --সে কারণেই লেখাটি এভাবে শুরু করতে হল।
কিছুদিন আগে নয়া পল্টনে বিএনপির ডাকা সমাবেশে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তা চোখে পড়ার মত। জনসমুদ্রের নিরানব্বই ভাগই ছিল অতি সাধারণ মানুষ। যাদের অনেকে এক বা দু’বেলা খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছে। আর তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া খুশিতে বাকবাকুম হবেন এটাই স্বাভাবিক। গরীব নিরক্ষর সাধারণ জনগণকে তাদের নেত্রী যে মণ্ডা-মিঠাই খাওয়ালেন তা পরদিনের পত্র-পত্রিকা খুলেই দেখা গেল।
তারপর জন হয়রানির মহা হাতিয়ার, হরতালকেও হার মানানো সারাদেশে রোড মার্চের নামে সরকারকে নাজেহাল করার খেলাতেও দেখা গেল দলপ্রেমী নিরক্ষর ভক্ত-প্রেমিককূলের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
খালেদার জিয়ার এ রোড মার্চ-সমাবেশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়েকটি জনসভায়ও ভক্ত প্রেমিককূলের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা গেল। মনে হলো, দেশের জনগণকে অশিক্ষিত রাখতে পারলেই রাজনৈতিক দলগুলো মওকা বাড়ে।
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নেতা-নেত্রীদের মিষ্টি মুখের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর ভোটের গণতন্ত্রকে পেয়ে দেশের সাধারণ জনগণ যে বেজায় খুশি, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের অংশগ্রহণ দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।
আর রাজনৈতিক দলগুলোরও মনে রাখা দরকার যে, মিথ্যা প্রতিশ্রতি দিয়ে ক্ষমতা বেশি দিন কুক্ষিগত করে রাখা যায় না। সেই সাধারণ জনরায়েই ক্ষমতাচ্যূত হতে হয়। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও আত্মশুদ্ধির পণ করা উচিৎ। সাধারণ জনগণের ভালোবাসার সাথে আর প্রতারণা করবেন না। জনগণের অজ্ঞতা, প্রশ্নহীন অন্ধ ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আপনারা মূর্খতার পরিচয় আর দেবেন না আশা করি।
নাজিম মৃধা, আইন ও বিচার বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়