ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ভবিষ্যতের বাংলাভাষা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৮
ভবিষ্যতের বাংলাভাষা ভাষার ফেব্রুয়ারি আশার ফেব্রুয়ারি

ভাষা তো জীবন্ত, সময়ের সাথে সাথে বদলায়। ৫০ বা ১০০ বছর আগের বাংলাভাষা আর নেই। শব্দ, রীতি, বাক্য গঠন ও শৈলী ইত্যাদি বদলে গেছে। সামনের ৫০ বা ১০০ বছরে বাংলাভাষার চেহারাটা কেমন হবে? ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি।

বলতে দ্বিধা নেই, আগামী ২৫, ৫০ বা ১০০ বছর পর বাংলাভাষা কেমন হবে—এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে নানা উদ্বেগ। উদ্বেগটি বাস্তবসম্মত।

কারণ, সংস্কৃতির অবক্ষয় আর ভাষার মানে ও গুণে পতনের চিহ্ণ দেখেই তারা এমন উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন।

উদাহরণ দিয়েই বরং বিষয়টি স্পষ্ট করা যেতে পারে। একদা পাঠ্য এবং নানারূপ সহযোগী বই পড়া ছিল অনেকের কাছে অভ্যাসের বিষয়। অভ্যাস বললে ভুল হবে। বই পড়া ছিল জীবনচর্চার অংশ এবং শিক্ষিতজনের প্রধান হবি বা শখ। অবসর বিনোদন কিংবা সুযোগ পেলেই পাঠে মগ্ন হওয়া ছিল সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ব্যক্তি বা পরিবারগুলোর সংগ্রহে থাকত বই, পাড়ায়-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের মধ্যে আদান-প্রদান হতো বই। কলেজ তো বটেই, অনেক স্কুলেই গ্রন্থাগার ছিল। শিক্ষাক্রম ছিল বইবান্ধব। সপ্তাহে একদিন স্কুলের গ্রন্থাগারেই ক্লাসে গিয়ে বসতে হয়েছে আমাকে। বৃহস্পতিবার শেষ ক্লাসটি ছিল পাঠাগারে। বইপড়া, বই খোঁজা, পুরনো বই ফেরত দিয়ে নতুন বই নেওয়ার যাবতীয় কাজই ঐ ক্লাসে করতে হতো।

সেই সাংস্কৃতিক ধারা এখন আর নেই। এখন বইপড়া নামক সুকুমার বৃত্তিটি চলে গেছে টিভি দেখা, ইন্টারনেট ঘাঁটা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর পেছনে। সাইবার জগতে দাপিয়ে বেড়ানোই এখন জীবনের অংশ। বয়স ও লিঙ্গভেদে প্রযুক্তির অনুসরণ করাই হাল আমলে দস্তুর।  তথাপি এহেন পরিস্থিতিতে যারা বই পড়ছেন, তাদের একটা বড় অংশ আটকে আছেন বাজার-চলতি জনপ্রিয় সাহিত্যের ফাঁদে। জনপ্রিয় সাহিত্যের চমক আছে, স্থায়িত্ব নেই; মনকে তা আনন্দ দেয়, চিন্তাকে খোরাক দেয় না।

মনন ও সৃজনের বিকাশে এইসব বই কাজের কাজ কিছুই করতে পারে না। কেবল পাঠককে তাৎক্ষণিক ও সস্তায় বিনোদিত করাই এইসব বইয়ের প্রধান লক্ষ্য।

বইপড়ার সঙ্গে ভাষার সম্পর্কের কথা ভেবেই বিশিষ্টজনেরা উদ্বেগাকুল হন। বই না পড়া এবং পড়লেও হাল্কা কিছু পড়ার ফলে ধ্রুপদী, চিরায়ত, জীবন-ঘনিষ্ঠ, নিরীক্ষণমূলক বইপড়া থমকে যাওয়ায় মানুষের ভাষার পতন ঘটছে। আদর্শ বা প্রমিত ভাষাচর্চাও এতে ব্যাহত হচ্ছে। তাই শিক্ষিতজনের উদ্বেগের তালিকায় বড় জায়গা নিয়ে আছে ভাষার ক্ষেত্রে নানা শৈথিল্য, যা এর মানটাকে কিছুতেই ধরে রাখতে দেয় না।

একসময় শিক্ষিতজনেরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা ভাষার ক্ষেত্রে একমত হয়েছিলেন, যা তাঁদের চিন্তাভাবনাকে পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করবে। এর কথ্য ও লিখিত দুই রূপের ব্যাপারেও মতৈক্য ছিল। এটিকে কেউ বলেছেন প্রমিত, কেউ মানভাষা। এটি ছিল আমাদের মননশীলতার এবং আনুষ্ঠানিক ভাব ও চিন্তা প্রকাশের একটি সম্মত রূপ। একসময় এটিকে কর্তৃত্ববাদী, এলিটধর্মী ও প্রাতিষ্ঠানিক বলে প্রশ্ন করা শুরু হলো। এখন ‘মান’ বা ‘প্রমিত’ শব্দ দুটি সন্দেহজনক একটি চরিত্র নিয়েছে।

এখন কেউ যদি বলে, আমাদের একটি মানভাষার প্রয়োজন আছে, তাকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করবে; অনেকে বলবে, লোকটা সেকেলে অথবা মতলববাজ। ভাষাকে এখন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পণ্যবিশ্বের হাতে, দৃশ্যমাধ্যমের পাণ্ডাদের হাতে; ভাষার ব্যাপারে আমরা খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছি।

ভাষার মান নিয়ে কোনো কথা তুললে একটা হইচই পড়ে যায়। না, হইচইটা মানটাকে ওপরে তোলার পক্ষে নয়, হইচইটা ভাষা নিয়ে রক্ষণশীলতা কিংবা নীতি-নৈতিকতা দেখানোর অভিযোগে।  মান যে পড়ছে, তা তো বোঝা যায় বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখে। অনেক শিক্ষিতজনের বাংলা এখন শিথিল—তা ব্যাকরণ মানে না, শুরু ও শেষের যৌক্তিক সম্পর্কটি মানে না। বাক্যে সিনটেক্স বলে যে একটা বিষয় আছে, সেটাকেও নাকচ করতে চায়। সাবজেক্ট আর প্রেডিকেটের সম্পর্কটিকে যুক্তিনিষ্ঠও রাখতে আগ্রহী হয় না।

সঙ্গত কারণেই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখে কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, বাংলাভাষায় বিদেশি শব্দের (ইংরেজি, হিন্দি)  অকারণ অনুপ্রবেশ ও আরোপিত মিশ্রণ ঘটছে, ভাষা সেজন্য দূষিত হচ্ছে, তাহলে তাকে একেবারে উনিশ শতকের ভাষা-সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দিয়ে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা চলবে, তরুণেরা যদি এ রকম মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে, তাহলে সেটিই বাংলা ভাষার অবধারিত ও নিয়তি নির্দিষ্ট রূপ ধরে নিতে হবে। এমনটি করেই এফএম রেডিও আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষাচর্চা করা হচ্ছে।

কিন্তু একথা অনেকেই মনে রাখেন না যে, হাজার বছরের চর্চা ও অনুধ্যানে বাংলাভাষা একটি জীবন্ত ও কোটি মানুষের ভাষার পরিণত হয়েছে। সেখানে সংস্কার করার দরকার হলে উপযুক্ত হাতে সেটা করাও উচিত। কিন্তু ভাষার ঐতিহাসিক কাঠামোকে তছনছ করে ভেঙে ফেলা কোনও কাজের কাজ নয়।

কথ্যভাষার পাশাপাশি প্রতিদিনের চর্চায় বাংলাভাষার কাঠামোগত, উচ্চারণগত এবং নান্দনিক বিচ্যুতি ঘটছে। এই স্খলন রোধ করা না গেলে আগামী দিনের বাংলাভাষার কথা ভেবে শঙ্কিত হেওয়ার যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৮

এমপি /জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।