ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

খালেদার ৪১ বছরের রোডম্যাপ!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১২
খালেদার ৪১ বছরের রোডম্যাপ!

প্রতি রোডমার্চে মাশাল্লা খালেদা জিয়া বিশেষ কিছু বক্তব্য দেন। এসব বক্তব্য নিয়ে আমরা একখানা রাজনৈতিক রচনাও লিখে ফেলতে পারি! কিন্তু দুর্ভাগ্য শুরুর রোডমার্চ থেকে এসব বক্তব্যের ধারাবাহিকতাও সবক্ষেত্রে থাকছে না! অথবা এসব নিয়ে বেফাঁস পরিস্থিতির আলামত দেখে সেখানে ক্ষান্ত দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন স্বয়ং! যেমন চট্টগ্রাম রোডমার্চের প্রথম দিনের বক্তৃতায় তিনি দেশের ভবিষ্যৎ শাসনভার-কর্তৃ্ত্ব নিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণী অথবা রোডম্যাপ দিয়ে ফেলেছেন! তাহলে এবার ক্ষমতা থেকে বিদায় হলে আগামী ৪১ বছরেও আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না! এর মানে পরবর্তী ৪১ বছর তিনি এবং তার ছেলে বাংলাদেশ শাসন করবেন! ছেলের পর ছেলের বউ অথবা নাতনি! বাংলাদেশের জিম্মি জনগণের সামনে যেহেতু আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাদে মূলধারার একক তৃতীয় কোনো দল বা পক্ষ নেই সে কারণে বিষয়টি এমনই ভাবা হতে পারে।

গণতন্ত্রে ক্ষমতার  মালিক জনগণ। আমাদের গণতন্ত্রীরা(!) আবার একইসঙ্গে ধর্মে বিশ্বাসী। সব সময় বলেনও যে ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। আল্লাহ ক্ষমতা দেনেওয়ালা আর লেনেওয়ালা। এসব ধারণা-বিশ্বাস সত্ত্বেও খালেদার রোডম্যাচটি কোন সূত্র-তরিকা অথবা পরিকল্পনার এ নিয়ে অনেক আলোচনা গবেষণা হবে।

এমনিতে এরশাদ-পরবর্তী বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এখানে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষমতার মালিক ভোটাররা আবার ভোটের মাধ্যমে পাঁচবছর পরপর ক্ষমতার মালিক বদলাচ্ছেন। বিএনপির জায়গায় আওয়ামী লীগকে আনছেন, অথবা আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপিকে। অথবা বিএনপির ওপর রাগ করে অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ হয়ে ভোট দিচ্ছেন আওয়ামী লীগকে। একইভাবে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারিতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপিকে ভোট দিচ্ছেন। পছন্দের নির্ভরযোগ্য তৃতীয় কেউ না থাকাতে ১৯৯১ সাল থেকে এমনটিই ঘটে চলেছে। কিন্তু কাউকে একসঙ্গে ১০ বছরের জন্য ক্ষমতা লিখে দিচ্ছেন না। এক্ষেত্রে কেউ যদি একা একা জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দিচ্ছেন জনগণ।

এটা এরশাদের ক্ষেত্রে যেমন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। সে কারণে খালেদা জিয়া নিজেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দাবী করলেও আদতে পূর্ণ মেয়াদ পার করতে পেরেছেন দুবার। ২০০৬ সালে আবার নিজের মতো করে বিচারপতি হাসান অথবা ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছিলেন। সেখানে ১/১১-তে এসেছে। এবার যদি শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষ খালেদার ২০০৬ স্টাইলে ভুল আর জোর করে কিছু করার চেষ্টা করেন, এর ফলাফলও ভালো হবে না। এটিও ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু হাসিনাকে খুব কাছে থেকে যারা জানেন তারা মানবেন তিনি সে পথে শেষ পর্যন্ত যাবেন না। ১৯৯৬ সালের ক্ষমতায় থাকতেও গণভবন তার নামে লিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদার মতো উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত সেখানে পড়ে থাকেননি। খালেদার মতো ‘আপোষহীন’ও শেখ হাসিনা নন।

এখন এই ৪১ বছরের রোডম্যাপ কী করে বাস্তবায়ন করবেন খালেদা জিয়া? এটিও কিন্তু অসম্ভব না। কিন্তু সে পথে তিনি কী সত্যি যাবেন? না বিশ্ব পরিস্থিতি আর দেশের আম-জনতা কী সে অবস্থায় আছে? এর আগে ২১ বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে খুন করতে হয়েছে। আজ যেমন খালেদা জিয়া তার ছেলে তারেক রহমানকে আগামীতে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানোর স্বপ্ন দেখেন, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু খুনের সঙ্গে জড়িতরা তার কোনো উত্তরসূরি শেখ কামাল, জামাল এমন কী শেখ ফজলুল হক মনিকেও বাঁচিয়ে রাখেনি। শেখ হাসিনা-রেহানারা বিদেশ থাকায় তখন প্রাণে বেঁচে গেছেন। অথবা বাংলাদেশে কখনো যে নারী নেতৃ্ত্ব আসতে বসতে পারে, ৭৫-এর সেই খুনের পরিকল্পনাকারীরা তখন তা কল্পনায়ও ভাবতেও পারেনি। ভাবলে হয়তো হাসিনা-রেহানা যেখানেই থাকুন সেখানেই মেরে আসত! এরপর আবার অবস্থা বেগতিক দেখে আওয়ামী লীগ যেন নেতৃত্ব শূন্যতায় ভোগে, আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে কারণে পলায়নের আগে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে গেছে। এরপর জিয়া-এরশাদ যে কাজটি সফল করে গেছেন আওয়ামী লীগ যাতে আর কোনোদিন ক্ষমতার মুখ না দেখে। সেই দায়িত্বটি পরে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার কাঁধে বর্তায়। কিন্তু এরপরও যে আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় চলে এসেছে, এটি যদি খালেদা জিয়ার ব্যর্থতা হিসাবে সে রাজনীতির ধারক-বাহকরা দেখেন, এর জবাব কী হবে। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে কী ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে?

যদি বলা হয় এখন আবার দলটিকে ৪১ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখার রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে সে রকম আরেকটি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হচ্ছে, এর কী জবাব দেবেন ম্যাডাম?

এমনিতে চট্টগ্রাম রোড মার্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে খালেদার বক্তব্যটি সুন্দর ছিল। শেখ হাসিনা বিবিসির ইন্টারভ্যুতে বলেছিলেন, নির্বাচনে না এলে খালেদা জিয়া ভুল করবেন। খালেদা এর সুন্দর জবাব দিয়ে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিলে ভুল করবেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এলে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দুর্নীতির বিচারের ওয়াদাটিও সময়োপযোগী। কারণ দুর্নীতি যে হচ্ছে না সে বড়াই করে বলার অবস্থা আর এ সরকারের নেই। সর্বশেষ মহাজোটের নেতা রাশেদ খান মেননও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্তরিক হলে এ সরকারের দুর্নীতির বিচার করতে চাইলে নিজের আমলের দুর্নীতির বিচার কেন বন্ধ করতে চান খালেদা জিয়া? সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে ছেলেদের পাচার করা টাকা ধরা পড়েছে তো আন্তর্জাতিক মানে! একেবারে আমেরিকা-এফবিআই-সিঙ্গাপুর, তিন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে টাকাগুলো ধরা পড়ে জব্দ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিদেশে পাচার করা টাকা এর আগে আর কখনো ধরা পড়েছে কী?

১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এরশাদের বিদেশে পাচার করা টাকা উদ্ধারে ফেয়ারফ্যাক্সকে নিয়োগ দিয়েছিল খালেদার সরকার। এরশাদ অনেক চতুর হওয়াতে সে টাকাকড়ি উদ্ধার করা যায়নি ঠিক, কিন্তু এবার সিঙ্গাপুরের ব্যাংকের টাকাগুলোর তো হদিস বের করেছে খোদ এফবিআই। বাংলাদেশ সরকার তো সে টাকার খোঁজ পেয়েছে পরে। আর সর্বশেষ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সহায়তায় এফবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা যে এখানের কোর্টে এসে স্বাক্ষ্য দিয়ে গেলেন, এরপরও কী তদন্ত আর সাক্ষ্য প্রমাণের বিচারকেও কী আন্তর্জাতিক মানের মনে হচ্ছে না? `তোমার বেলায় দুর্নীতি আমার বেলায় না`--এই যদি হয় নীতি, তাহলে মানুষ নির্ভর করবে কাকে? বা দেশের মানুষ কী করে বুঝবে-মানবে যে ভবিষ্যতে দুর্নীতির বিচার নিয়ে খালেদা জিয়া আন্তরিক?

আগের রোডমার্চগুলোর মতোই চিটাগাং রোডমার্চেও উপচে পড়া মানুষ হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের মানুষ যে এ সরকারের ওপর খুশি না এটি তার প্রমাণ। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও বিপুল হেরেছে সরকারি দলের প্রার্থী। কিন্তু মানুষকে বিকল্প শাসনের স্বপ্ন দেখানো যদি হয় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর নিয়ত, তাহলে শেষ পর্যন্ত কে যাবে বা থাকবে সে নিয়তের সঙ্গে? সিলেট রোডমার্চের মঞ্চেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবির ব্যানার-প্ল্যাকার্ড টানাতে দেওয়া হয়নি। আর এবার ঢাকা থেকে রওয়ানা শুরু থেকে শুধু একাত্তরে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গাদ্দারি করা এসব গণবিরোধী  নেতার মুক্তির ছবি আর ছবি!

চট্টগ্রামের মেয়রের পাশে দাঁড়িয়ে সেখানে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা করলেন সালাহউদ্দিন কাদেরের ছেলে! এসবের মাধ্যমে দেশবাসীকে কী সেই পুরান বার্তাটিই আবার দিলেন না বিএনপির চেয়ারপারসন? এসব নিয়ে তাড়াহুড়া মানে এ সরকারকে তার মেয়াদ পর্যন্ত থাকলে দিলে তারা যুদ্ধাপরাধী আর ছেলেদের টাকা পাচারের বিচার করে ফেলবে, এই যদি হয় সরকারকে ফেলে দেবার মূল নিয়ত, তাহলে কী আর দেশের মানুষ এত ভিড় করে ১০ কোটি টাকার রোডমার্চের ৬ হাজার গাড়ির কাফেলা দেখতে যাবে, সঙ্গে থাকবে আর? নাকি সরকারও তখন শুধু বসে বসে বাদাম চিবোবে?

এ প্রশ্নগুলো বারবার করলেও তা শুনছে কে? দেশের দায়িত্বশীল বিরোধীদলের নেত্রী গণতান্ত্রিক প্রতিটি পদক্ষেপ-বক্তব্য নিয়ে দায়িত্বশীল থাকবেন, এটিই সবার আশা। সংসদে যান আর না যান বিরোধীদলের নেত্রী হিসাবে তো সব প্রটোকল, সুযোগ-সুবিধা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিচ্ছেন, সরকার মুখে যত গালিগালাজ করুক, কোথাও কিছু কম দিচ্ছেন না। চট্টগ্রাম রোডমার্চেও তিতাস হত্যা নিয়ে তার কাছ থেকে কোনো জোরালো শক্ত বক্তব্য আসেনি। ৪১ বছরের রোডম্যাপের ইঙ্গিত যেটি দিয়েছেন, সেটিও কিন্তু খুনোখুনির ইঙ্গিতযুক্ত। এখনই একটি সংসদীয় সরকারের আরও দু’বছর মেয়াদ থাকতে চরম কোন কর্মসূচি দিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করার মতো বিপ্লবী কর্মী-বাহিনী বিএনপির নেই সেটিও খালেদার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। জামায়াতের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করে চোরাগুপ্তা কিছু কামিয়াব করে ফেলা যাবে? সে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও এর মাঝে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশবিরোধী প্রত্যক্ষ রক্তাক্ত ভূমিকাওয়ালা শীর্ষ নেতাদের নিয়ে সে নৈতিক জায়গাটিও সে দলের কর্মী-শুভানুধ্যায়ীদের নেই। ৪১ বছরের রোডম্যাপের খুনোখুনিতে জড়িয়ে আমছালা দুই হারানোর পরামর্শ নিশ্চয় তার উপদেষ্টারা তাকে দেবেন না। কিন্তু ঢিলটি কেন এভাবে ছুঁড়লেন সেটিই  নতুন প্রশ্ন।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।