ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সৌদিরাজের শরিয়াহপ্রীতি ও দুই আরবের মুসলমানিত্ব

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১১
সৌদিরাজের শরিয়াহপ্রীতি ও দুই আরবের মুসলমানিত্ব

যখন সৌদি আরবের সরকার ইসলামি শরিয়াহ আইনের নাম করে আট বাংলাদেশিকে প্রকাশ্য দিবালোকে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে আদিম বন্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল, তখন পেশাগত ব্যস্ততার কারণে নিজের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারিনি। চাপা ক্ষোভ ভেতরে ধারণ করেই রাখছিলাম।

এরই মধ্যে সেদিন রাতে আমার স্ত্রী ইউটিউবে শিরশ্ছেদের মর্মান্তিক বর্বরতা দেখে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সারা রাত ঘুমুতে পারেননি। মনটাকে হালকা করার জন্য বাসায় ফোন দেন। মা-বাবার সাথে বিষয়টি শেয়ার করার চেষ্টা করেন। আমার শ্বশুর সাহেব এ ব্যাপারে তাকে আরো নতুন কিছু ধারণা দেন।

কয়েক বছর আগে আমার এক চাচাশ্বশুর সৌদি আরবে গিয়েছিলেন চাকরি করতে। সেই সুবাদে সৌদির অনেক কিছুই তাঁর নখদর্পণে। সৌদিদের এ পাশবিক বর্বরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হলে মাইকিংয়ের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে জানিয়ে যেভাবে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়, সেভাবে সৌদি সরকার কোনো অপরাধীকে শরিয়াহ আইনের আওতায় এনে শিরশ্ছেদের মতো ঘৃণ্য শাস্তি কার্যকর করার আগে শহরব্যাপী মাইকিং করে। সাধারণত জুমার নামাজের পর ‘কেসাসে’ যোগদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। এ যেন এক মহা আনন্দঘন সমাবেশ! উপস্থিত উল্লসিত জনতার সামনে হাত-পা বেঁধে নির্দয় ও অমানবিকভাবে এই বর্বর কাজটি তারা সম্পন্ন করে।

ছিঃ, সৌদি সরকার ছিঃ! সভ্য যুগে বাস করেও এই অসভ্যতার বৃত্ত থেকে এখনো আপনারা বেরিয়ে আসতে পারলেন না। পাঁচশ-সাতশ বছর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে অসভ্যতা ও বর্বরতা ছিল, তা সৌদি সরকার আজকের প্রাযুক্তিক সভ্য বিশ্বেও বহন করে চলছে নির্লজ্জের মতো। ইসলামি শরিয়াহ আইনের দোহাই দিয়ে তলোয়ার দিয়ে সভ্যতাকে কুচি কুচি করে কেটে নির্বাসন দিচ্ছে আরব সাগরে । সময়ের সাথে সাথে সারা বিশ্বে সবকিছুতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এককালে ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও শাস্তিমূলক পন্থা হিসেবে শিরশ্ছেদের প্রচলন ছিল। কিন্তু সভ্যতায় সিদ্ধ মানুষ এসব বর্বরোচিত শাস্তির বিধানকে পরিহার করেছে,  এমনকি কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো একটি নির্মম শাস্তিকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে যে কোনো জঘন্যতম অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকেই গণ্য করে নিচ্ছে। তাছাড়া মৃত্যুদণ্ডকে কার্যকর করতে হলেও তারা অন্য কৌশল অবলম্বন করে।

কিছু দিন আগেও ইয়াহু ম্যাসাঞ্জারের হোম পেজে দেখতে পেলাম ইউরোপের কোনো একটি দেশে এক ধরনের ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে একজনের মৃত্যুদণ্ডকে কার্যকর করা হচ্ছে। মানবতা ও সভ্যতার গান তারা গাইছে অন্য ধর্মাবলম্বী হয়েও। কিন্তু ওই আরবরা মুসলিম হয়েও মানুষ বলি দিয়ে সভ্যতাকেই পরিহাস করছে নির্মমভাবে। অথচ পৃথিবীতে  যুগে যুগে যত ধর্ম এসেছে তার মধ্যে ইসলাম হচ্ছে এক পরম শান্তিকামী ও সিভিলাইজড ধর্ম। অপ্রিয় হলেও সত্য, আরব বিশ্ব ও আল কায়েদা এই ধর্মটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ফলে কলংকের কালিমা বহন করে চলতে হচ্ছে আমদের প্রাণের ধর্ম ইসলামকে। কখনো কখনো অন্য ধর্মীয় সমাজে মাথা হেট করে থাকতে হয় ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের।

প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে একটি প্রসংগের অবতারণা করি। বছর দুয়েক আগের কথা। আমি আয়ারল্যান্ডে একটি ফাইভ স্টার হোটেলের এফঅ্যান্ড বি (ফুড অ্যান্ড বেভারেজ) ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। সেই সুবাদে হরেক রকম লোকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটে প্রতিনিয়তই। এর আগের একটি লেখাতেও বলেছিলাম, বিল ক্লিনটন থেকে শুরু করে আমদের ড. ইউনূস পর্যন্ত এরকম অনেক লোককে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

ফিরে আসি মূল কথায়। একদিন রাতে দুজন এরাবিয়ান মুসলিম এসেছেন ডিনার করতে। একজন পাইলট, অন্যজন গলফ এয়ার লাইন্সের শেয়ার হোল্ডার। দুজনের সঙ্গে সুন্দরী দুজন তরুণী। আমি বুঝে উঠতে পারিনি তারা তাদের গার্লফ্রেন্ড নাকি ভাড়াটিয়া কেউ। তবে এতটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, তরুণী দুজন ইউরোপিয়ান কোনো দেশের ইহুদি বা ক্রিশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বী। অথবা এমনও হতে পারে, কোনো ধর্মের ধারই তারা ধারে না।

ডিনারের অর্ডার নিতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক দুজন দিব্যি বিয়ার (একজন পাইন্ট অব হ্যানিকেন, অন্যজন বুডবাইজার বোতল) গিলছেন,  যেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী বা বিধর্মী মেয়ে দুটো শুধুই পান করছিল সফট ড্রিংস (কোকাকোলা)। মেইন কোর্স হিসেবে অর্ডার দিলেন ‘সিবাস’ আর মেয়েগুলো শুধু ভেজিটেবল স্যুপ। সিবাস হচ্ছে এক ধরনের সামুদ্রিক স্কিনি মাছ। এ মাছ খেতে মুসলিমদের কোনো বাধানিষেধ নেই। খেতেই পারেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সিবাস ডিশটি পরিবেশন করা হয় দুটো ত্রাফল নকি (truffle knokee- ভেজিটেবল ম্যাশের মাধ্যমে বানানো ছোট পিঠা আকৃতির এক ধরনের জিনিস) এস্পারাগুচ, ক্রিস্পি বেকন পানসেটা, গার্লিক ও ট্যারাগন সসের মাধ্যমে। ক্রিস্পি বেকন পানসেটা হচ্ছে কড়া ভাজা শূকরের মাংসের সরু, চিকন, পাতলা ও ছোট বর্গাকৃতির টুকরো, যা সিবাসের দু টুকরোর ওপর দিয়ে পরিবেশন করা হয়। পানসেটা সম্পর্কে তাদেরকে এ ধারণা দেওয়ার পরও তারা তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেননি। মুসলিম বিধায় আমি আরেক ধাপ এগিয়ে বললাম, ইচ্ছে করলে আপনারা বেকন পানসেটা বাদ দিয়েও এ ডিশ পেতে পারেন (কোনো কাস্টমারকে এভাবে বলা যদিও আমার আমার চাকরির রীতিবিরুদ্ধ)। বোঝা গেল একটু বিরক্ত হয়েও তারা আমাকে বলল, ‘please do, whatever we ordered. We are in little rush.’ আমার ও তাদের বাক্যবিনিময় শুনে মুখোমুখি বসা মেয়ে দুটো মুচকি মুচকি হাসছিল। আমি অহেতুক কথা না বাড়িয়ে অত্যন্ত আহতচিত্তে অর্ডারটি কিচেনে পৌঁছে দিয়ে তাদের দেখআল করার জন্য আমার অন্য এক কলিগকে দায়িত্ব দিয়ে সরে যাই। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি ফিশ নাইফ দিয়ে কেটে কেটে সিবাসের সাথে পানসেটা মিশিয়ে খাবার দৃশ্য। আমার বমি বমি ভাব হচ্ছিল, যদিও এর আগে অন্য ধর্মীয় কাউকে খেতে দেখলে কোনো দিনই এ রকম হয়নি।

প্রিয় পাঠক লক্ষ করুন, যাদের আমরা বিধর্মী বলে যখন-তখন গালি দিই, তারা মুসলিম টেবিলে বসে ইসলামকে সমীহ করে মদ্যপায়ী হয়েও মদ পান থেকে বিরত রয়েছে, শূকরপ্রেমী হয়েও শূকরের মাংস ভক্ষণ করার মতো ধৃষ্টতা অন্তত ওই টেবিলে তারা দেখায়নি। বরং উল্টো চিত্র ফুটে উঠল বিশ্বসেরা(!) মুসলিম দাবিদার দুই আরব মুসলিমের হারাম ক্রিয়াকলাপে। এ যেন মুসলিমের করাত দিয়ে তরমুজের পিসের মতো কেটে ফেলা হলো মুসলিম শিষ্টাচার তথা ধর্মীয় বিধানকে।

এ তো গেল দুই মামুলি আরবের গল্প। গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে কোনো কিছুই আর গোপন থাকে না। ফেসবুক বা ইউটিউবের মাধ্যমে সৌদি প্রিন্সের শরাবপ্রেম ও  লাম্পট্যের কথা কে না জানে! কিছুদিন আগে দুবাইয়ের এক নাইট ক্লাবে গিয়ে অর্ধনগ্ন এক সুন্দরী তরুণীর গায়ে ডলার ছিটিয়েছে, এক রাত কাটিয়েছে এক মিলিয়ন ডলার খরচ করে। শুধু যে যুবরাজরা এসব ইসলামবিরোধী কাজে লিপ্ত তা নয়, বরং স্বয়ং বাদশাহ সাহেবের বিরুদ্ধেও শরাব ও নারী আসক্তির কথা। ইউটিউবের মাধ্যমে ধারণকৃত একটি ভিডিও ফুটেজটিই এর প্রমাণ। ভিডিওটি প্লে করলেই দেখা যাবে বাদশাহ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাথে গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে কীভাবে ‌‌‌চিয়ার্স করছেন! এসব বিষয় আজকের বিশ্বে ওপেন সিক্রেট মাত্র।

এরপরও কি আমরা অন্ধের মতো সমর্থন দিয়ে বলব, ওরা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে শিরশ্ছেদের বিধান পালন করছে? আল্লাহ, শরিয়াহ আইন ইত্যাদি শব্দ মুখে এনে ফেনা তোলার মাধ্যমে ধর্মব্যবসায়ীদের মতো ভণ্ডামি করছে না? যারা নিজেরা ঘর সামলাতে পারছে না কিংবা তারা নিজেরাই ‌আল্লাহওয়ালা কায়দায় শরিয়াবিরোধী কাজে লিপ্ত, তারা কিসের জোরে কোন মন-মানসিকতায় শরিয়া শরিয়া বলে চিল্লিয়ে গলা ফাটায়? তাই সবাকে আজ উপলব্ধি করতে হবে, ওদের বর্বরতায় উল্লসিত না হয়ে সমুচিত জবাব দেওয়ার সময় এখনই। আর কদিন পরেই আরো তিনজন বাংলাদেশীকে শিরশ্ছেদ করার প্রক্রিয়া চলছে। তাই সরকারসহ দল-মত নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসুন। আর দেরি নয়। বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে ওদের এসব ধর্মবিরোধী বন্য ক্রিয়াকলাপ তুলে ধরার মাধ্যমে মানবতার আবেদনকে বলিষ্ঠভাবে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি। যে তিনজন বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ আসন্ন, অদেরকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। আল্লাহ চাইলে সফল হওয়াও যেতে পারে।    

লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।