ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমরা কি ভুলে গেলাম সোয়াত জাহাজ অবরোধ দিবসের কথা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
আমরা কি ভুলে গেলাম সোয়াত জাহাজ অবরোধ দিবসের কথা চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রামের গৌরবের কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি। চট্টগ্রাম নিয়ে লম্ফ ঝম্ফ, হৈ চৈ করার লোকের অভাব নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের কৃতিত্বের গল্প আমরা করি না। আমরা কি জানি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রাম কেন, কিসে বড়; কোথায় তার শ্রেষ্ঠত্ব, কী তার মহিমা। 

২৪ মার্চ বাঙালি ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা একটি দিন। সেদিন চট্টগ্রাম বন্দরে বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামের জনগণের বুকের তাজা রক্তে একটি ইতিহাস রচিত হয়েছিলো।

সে ইতিহাস সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত। ২৪ মার্চ স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত।  

স্বাধীনতা সংগ্রামে এমনি আরো বহু গৌরবময় ইতিহাসের স্রষ্টা চট্টগ্রাম। ২৮ মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চট্টগ্রামের একক আধিপত্য, চট্টগ্রামকে সে ইতিহাসের নায়ক বললেও অত্যুক্তি হবে না।  

২৫ মার্চ: এদিন রাত ৮টা ৪০মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন ১ সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। তিনি তখন ইপিআর-এর অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন, তার পদবী ছিল ক্যাপ্টেন।  

২৬ মার্চ: চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের প্রচার যন্ত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। যেখান থেকে সর্বপ্রথম জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এদিনই চট্টগ্রামের পাকিস্তানি বাহিনীর সাহায্যার্থে কুমিল্লা থেকে আগুয়ান পাকিস্তানি বাহিনীকে কুমিরায় অ্যাম্বুশ করে একজন কর্নেল সহ ১৬৯ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেন তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন এস এ ভূঁইয়া (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও আওয়ামী লীগের এমপি) ও তার বাহিনী।  

২৭ মার্চ: জুবিলি রোড ন্যাভাল এভিনিউতে অবস্থিত পাকিস্তানি নৌ কমান্ডারের বাসভবন আক্রমণ করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এদিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মেজর জিয়াউর রহমান (পরে জেনারেল, রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) স্বাধীন বাঙলা বেতার থেকে দ্বিতীয়বারের মত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।  

২৮ মার্চ: জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল হারুন আগরতলা গিয়ে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে গণহত্যার সংবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সাহায্যের আবেদন জানান।  

পাঁচ বছর আগেও সোয়াত জাহাজ অবরোধ দিবসে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হতো চট্টগ্রামে। তখন এই দিনটিকে চট্টগ্রামের মানুষের শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের পরিচয় জ্ঞাপক একটি দিন হিসেবে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হতো। এখন আর কেউ সে কথা মনে রাখে না। ফলে নীরবে পেরিয়ে সোয়াত জাহাজ অবরোধ দিবস। লজ্জায়, গ্লানিতে ছেয়ে যায় আমার মন, নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করেই কেন বেঁচে আছি?

সোয়াত জাহাজ অবরোধ
সোয়াত অবরোধ বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামের জনগণের একটি অনন্যসাধারণ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির মরণপণ লড়াই, সেই অর্থে জনগণের যুদ্ধ; আর চট্টগ্রামের বীর জনতা ২৪ মার্চ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেই জনযুদ্ধেরই সূচনা করেছিলেন।

সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীও বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিলো এবং নয়মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছিলো। কিন্তু সেটা আরো একদিন পর। তার আগেই জনগণ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলো চট্টগ্রামের নিরস্ত্র বাঙালি। বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করেই যারা জীবনযুদ্ধে বেঁচে বর্তে থাকে, নদী ও সাগর পাড়ের সেইসব মানুষের কাছে জীবন ও জীবিকারই অপর নাম সংগ্রাম। তাই বাংলার উপকূলের চিরকালের শত্রু হার্মাদ বর্গী জলদস্যুদের মতই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আধুনিককালের হায়েনারা যখন কর্ণফুলীর কূলে হানা দেয় তখন বন্দর, পতেঙ্গা হালিশহরের সাহসী চট্টলপুত্ররা লগি বৈঠা লাঠি হাতে রুখে দাঁড়ায়।

পাকিস্তানি জমানায় পাঞ্জাবি সৈন্যমাত্রই বাঙালিদের কাছে ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা। খানসেনা দর্শনমাত্র পড়ি কি মরি দৌড়, পৈতৃক প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচত যে সাধারণ মানুষ, তারাই কিনা লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোটা মাত্র সম্বল হাতে করে কামান, মেশিনগান তাক করে হিংস্র হায়েনার মত সোয়াত জাহাজ আগলে দণ্ডায়মান দশাসই চেহারার যমদূতের মুখোমুখি হলো, শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে-এ যে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। একটুও বুক কাঁপলো না, শয়তান পিশাচের সামনাসামনি হয়েও অকম্পিত, অচঞ্চল। এতদিন বাঙালির পরিচয় ছিল ভেতো ভীতু-ভীরু বাঙাল, পরিচয় না বলে দুর্নাম বলাই শ্রেয়। সেই গোবেচারা, অসামরিক জাতি কি করে পৃথিবীর অন্যতম কথিত শ্রেষ্ঠ দুর্ধর্ষ সামরিক জাতির মিথ্যা অহংকারকে ভেঙে চুরচুর করে দিলো। যারা এসেছিলো আস্ফালন করে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ গুঁড়িয়ে দিতে, তারাই কি-না সেই বাঙালির মানবপ্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে নাকালই শুধু হলো না, জাহাজ থেকে তীরে নামারই সুযোগ পেলো না।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা কোন সময়েই বাঙালিকে সুনজরে দেখেনি। বাঙালি জাতিকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখত। সেই জাতিকে স্বাধীনতার জন্য মরিয়া সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। তাই এ জাতির স্বাধীনতার সাধ ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ বোঝাই করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য আনা হয়েছিলো ‘সোয়াত’ জাহাজে করে। ঢাকায় যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার ভান করে ইয়াহিয়া-ভুট্টো সময়ক্ষেপণ করছিলো বাঙালি জাতির ওপর আঘাত হানার চূড়ান্ত মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসার জন্য, সেই অবসরে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিলো অস্ত্র বোঝাই জাহাজ। কিন্তু সেই জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে ব্যর্থ হলো তারা নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে মানবেতিহাসের যে নিকৃষ্টতম, ভয়াবহতম ও ঘৃণ্যতম গণহত্যা বাঙালি জাতির ওপর চালিয়েছিলো পাকিস্তানি নরপিশাচরা, সেই গণহত্যায় ব্যবহারের জন্যই ওই অস্ত্র আনা হয়েছিলো সোয়াত জাহাজে করে। অত্যন্ত সঙ্গোপনে ছদ্মাবরণে এই সমরাস্ত্রের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা হলেও বন্দর পতেঙ্গা হালিশহর এলাকার শ্রমিক জনতার কানে ঠিকই পৌঁছে যায় এই ষড়যন্ত্রের আগাম সংবাদ। তারপরের কাহিনী সশস্ত্র সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের লোমহর্ষক কাহিনী।  

আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার মতো টগবগ করে ফুটতে থাকা হাজার হাজার ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ জনতার ওপর মনের সুখে চানমারি প্র্যাকটিস করে পাখির মত গুলি করে করে ফেলে দিয়েও পাকিস্তানি সৈন্যরা সেই মানবপ্রাচীরে কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি। বন্দর এলাকার রাজপথে মানুষের তরতাজা রক্তের নহর বইতে বইতে কর্ণফুলীর পানিও রাঙা হয়ে গিয়েছিলো। তবুও অস্ত্র খালাসের জন্য এতটুকু ফাঁক বের করতে পারেনি হানাদাররা। তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অবিরাম নির্বিচার গুলিবর্ষণে ২৩টি প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছিলো, আহত হয়েছিলো আরো অর্ধশতাধিক মানুষ। হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু অবাক হওয়ার মত ঘটনা ছিল জনতার মনোবল। গুলি খেয়ে সামনের কিংবা পাশের জন পড়ে যাওয়ার পর পশ্চাদবর্তী কিংবা পার্শ্ববর্তী কেউ এসে আবার প্রতিরোধব্যুহ দুর্ভেদ্য করে তুলছে, কারো পিছু হটার কথা মনেই হয়নি। ব্যক্তিচিন্তা, আত্মস্বার্থপরতা ভুলে গিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তাই নিজেকে রক্ষায় নিজের প্রাণ বাঁচানোর গরজ কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। সোয়াত অবরোধের ঘটনা আজ ইতিহাস।

গুজব নয়, সত্য কাহিনী
একাত্তরের মার্চের বাংলাদেশ ছিল গুজবের দেশ। অসম্ভব অনিশ্চয়তাপূর্ণ সেই সময়ে যে কোন কিছুই ঘটা অসম্ভব ছিলো না। ধনুকের ছিলার চেয়েও টানটান, উত্তেজনাভরা রুদ্ধশ্বাস এক একটি দিন ও রাত গড়িয়ে গড়িয়ে ধাবিত হচ্ছিলো আরো ভয়াবহ, কঠিন কঠোর, হিংস্র পরিণতির পানে। অজানা ভয়, বিপদাশংকা, অমঙ্গলবোধে আচ্ছন্ন, কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন স্বভাবতই ভীতু, দুর্বল, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ; কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিলেন এতই নগণ্য যে, যাদের মনে রাখার কথা কারো মনেই হত না এবং তাদের ছাড়াই সমাজের চলিষ্ণুতা চলমান থাকত। বরং ভীরুতার অপবাদ মাথায় নিয়ে গৃহকোণে নিরাপদ আশ্রয়ে আবদ্ধ থাকাটাই ছিল অগৌরবের, সেই সময়ের বিচারবোধে অপৌরুষেয় একটি কাজ। তখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার। তাই রোমাঞ্চের আকর্ষণে বিপদকে আলিঙ্গন করতে ছুটে যাওয়াটাই ছিল সেই সময়ের জন্য স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া। শেখ মুজিব নামক বাঁশিওয়ালার বাঁশির মোহন সুরে মজে লাখো কোটি জনতা জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে পথকেই ঘর করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

সেটা ছিল এমন সময় যখন জীবন-জীবিকা, ঘর-সংসার, দারাপুত্রপরিবার, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাট-বাজার, মাঠ-ময়দান, শহর-বন্দর-গ্রাম, রাজপথ-জনপদ, ঘরের রোয়াক-দাওয়া, চণ্ডীতলা-আটচালা, ট্রেন-বাসস্ট্যান্ড-লঞ্চ টার্মিনাল, চৌরাস্তার মোড়, অলিগলিপথ, টি স্টল, পাড়ায় মুদির দোকান, সর্বত্রই উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা, উত্তেজিত কথাবার্তার শোরগোল। সবাই স্বাধীনতার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য তখন প্রস্তুত। ভয়ডর উবে গিয়েছিল মানুষের। মিলিটারি, কামান, বন্দুকের পরোয়া নেই। বাঙালির কাছে বাঁশের লাঠি, ইট-পাটকেল, মরিচের গুঁড়ো-তাই নিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যদের ট্যাংক, মেশিনগানের মোকাবেলার জন্য দুর্জয় সাহসে ভর করে তৈরি হয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা। একটিই দাবি বিক্ষুব্ধ জনতার-স্বাধীনতা, যেটি আদায় না করে আর ঘরে ফিরবে না এই জনতা। বাতাসে বারুদের গন্ধ, অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন হালিশহরের সন্তান, চট্টলশার্দুল এম এ আজিজ। কিছু মানুষ থাকেন, যারা অনেক পরের কথা আগেভাগে জেনে যান। তারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, দেয়ালের ভাষা পড়তে পারেন। বাতাসের গন্ধ শুকে আগাম বলে দেন, তিন মাস, ছ’মাস পরে কি ঘটতে যাচ্ছে। তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনেক দূরের জিনিস দেখতে পান, তারা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ। এম এ আজিজ এমনি একজন দূরদর্শী নেতা ছিলেন, যিনি সত্তরের নির্বাচনের পর পরই বলা শুরু করেছিলেন এক দফা মানে স্বাধীনতার কথা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভাবসাব দেখে তার মনে হয়েছিল তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না আওয়ামী লীগের কাছে, শেখ মুজিবের হাতে। অন্যদিকে বাংলার মানুষের মনের দিগন্তে তখন স্বাধীনতার সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে এবং ক্রমাগতভাবে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেই জনতা তখন মানসিকভাবে সাবালক হয়ে গেছে, যাদের আর সহজে পাকিস্তানিরা ধোঁকা দিতে পারবে না; সুতরাং এই সচেতন জাগ্রত জনতা আর এক ইঞ্চিও ছাড় দেবে না; ফলত সংঘাত অনিবার্য। সেই সংঘাতই অনিবার্য হয়ে উঠলো মার্চে, বাংলার ভূখণ্ড থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়ানোর জন্য বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে ঘোরতর রণে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

একাত্তরের মার্চ মাসের বাতাসে সত্যিই বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগলো। জনতার বুকে ক্রোধাগ্নি ধিকিধিকি জ্বলছিলো, বিদ্রোহের একটি স্ফুলিঙ্গের জন্য যা জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। এমনি অগ্নিগর্ভ, তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিনে, যেন বাতাস কানে কানে বলে গেল বন্দরের জেটিতে ভিড়ে আছে সোয়াত নামে যে জাহাজ, তাতে অস্ত্র আছে। বাঙালিদের মারার জন্য এই অস্ত্র এনেছে পাকিস্তানিরা। গুজব নাকি বাতাসের আগে ছুটে যায়। যদিও তা গুজব নয় সত্যি খবরই ছিলো। ডক ইয়ার্ডের এক বাঙালি শ্রমিক প্রথমে সোয়াতে করে অস্ত্র আসার খবর পান এবং তিনি প্রথম সুযোগেই সে খবর পৌঁছে দেন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে। ওদিকে ঢাকার দলীয় সূত্র থেকেও এমএ হান্নান পাকিস্তানিদের অস্ত্র আনয়নের খবর জেনে ফেলেন। হান্নান, সেই সময় চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা, শ্রমিক লীগেরও মূল সংগঠক ও নেতা তিনি। পতেঙ্গা ভারি শিল্প এলাকায় তখন প্রচুর শ্রমিক, মার্চের উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে তারা টগবগ করে ফুটছিলো বৃহত্তর আন্দোলনের নির্দেশের অপেক্ষায়; হান্নান সাহেবকে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সোয়াত জাহাজ থেকে কিছুতেই অস্ত্র ও সৈন্য নামাতে দেয়া যাবে না। যেকোন মূল্যে তা প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি সোয়াত অবরোধের ডাক দিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ নেতৃবৃন্দকে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারী ও বন্দর সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় জনসাধারণকে সংগঠিত করে সোয়াত প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে বলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজের অনুজ মজিদ মিয়া এম এন এ, ইসহাক মিয়া এমপি, আতাউর রহমান কায়সার এম এনএ, আবদুল্লাহ আল হারুন এমপি, আবু সালেহ এমএনএ প্রমুখ সংসদ সদস্য এবং জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এস এম জামালউদ্দিন, মোহাম্মদ হারিছ প্রমুখ সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে দুর্বার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

#লেখক: মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক ও সংগঠক

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।