ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মুক্তিযোদ্ধা ‘সম্মানী’ কোটা লেখা হোক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৮
মুক্তিযোদ্ধা ‘সম্মানী’ কোটা লেখা হোক কোটার দাবিতে আন্দোলন

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নির্বাচনী বছর শুরু হয়ে গেছে। সরকার বিরোধী মহলে মাঠ গরম করার মতো তেমন কোনো ইস্যু নেই। তবে সম্প্রতি শিক্ষাঙ্গনে কোটা সংস্কারের দাবিতে কিছু আন্দোলন চলছে।

পাশাপাশি কোটার বিরোধীতার প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরাও মানববন্ধন করেছে। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রসহ দু’জন মিলে কোটার সংস্কার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন।

দেখা গেছে রিটকারী চাকরির জন্য অবতীর্ণ নয় এবং সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ক্ষতিগ্রস্তও নয় বিধায় ৫ মার্চ রিটটি খারিজ করেছে হাইকোর্ট।  

এদিকে ৬ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীদের দিয়ে সেসব পদ পূরণ করা হবে বলে আদেশ দিয়েছে।  

এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আমার সবিনয় প্রশ্ন কোটার বাইরে সাধারণ প্রার্থীদের মেধাক্রমানুসারে সাজানো তালিকাটির নাম কি অঘোষিত মেধা কোটা? এটিকে কোটার বাইরে থাকা সাধারণ প্রার্থীর তালিকা বলা যেত না? আমার আরো একটি প্রশ্ন, কোটা প্রার্থী যারা প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় মেধার স্বীকৃতি নিয়ে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ভাইভা নাগাদ পৌঁছায়, তাদের কি মুক্তিযোদ্ধা কোটা তালিকায় থাকার কারণে প্রকারান্তরে অমেধাবী বলা হলো না? এদিকে, মেধানুসারে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া প্রার্থীদের সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে কোটা সংস্কারের কথা বলছেন আন্দোলনকারীরা।  

ওদিকে, কোটা বিরোধী আন্দোলনকে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়াশীলতা বলেছে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধাসন্তান হিসেবে আমি তা পুরোপুরি মনে করি না। অন্যান্য দেশে বেকারত্ব কমবেশি থাকলেও বাংলাদেশে এই হার খুব বেশি। সংবিধান স্বীকৃত কোটা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসলেও বেকারত্ব থাকবে। সব সময়েই কিছু সাধারণ প্রার্থী ন্যূনতম একাডেমিক যোগ্যতা থাকায় আবেদনের সুযোগ পর্যন্ত পায়না। আন্দোলনটি কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ব্যানারে হচ্ছে।  

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, জাতীয়তাবোধ কি বুঝে না অথবা তার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রর্দশন তো দূরের কথা, উল্টো বিশ্রী ভাষায় বিদ্রূপ করা দুঃখজনক।  

কিছু মেধাবী আছেন যারা বিসিএসে চান্স না হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে দোষে। দেশের প্রাইভেট সেক্টরকে সমৃদ্ধ করতে কি মেধার দরকার নেই! মেধার লালনে তারা অন্য কোথাও এতটা সোচ্চার নয়। তারা একবারও বলেনি মেধা ব্যতিরিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে কোনো দল মনোনয়ন দেবেন না।  

মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অমেধাবী, দয়ার পাত্র ইত্যাদি বলে যখন গালি দেয়া হয়, তখন গোটা মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিটিকে সমাজে হেয় করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দে এলার্জি আছে এমন মানুষ এখনো অনেক। মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের খামের কোনায় ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ লিখতে বলা হয়। পিতার নামের বানান ভুল কেন, ঠিকানা ভুল কেন। এ রকম নানা অজুহাতে কত মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান পড়ে গেছে কেউ জানেনা।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে সংস্কারের বিষয়টি মুদ্রার একপিট দেখে মন্তব্যের মতো। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হিসেবে মনে করি সংস্কার দরকার।  

ওদিকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে এই কোটায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান না পাওয়ায় পদ খালি পড়ে থাকে। সেকথার সঙ্গে আমি মোটেও দ্বিমত করিনা। গোড়ায় গলদ রেখে ৩০ শতাংশ কোটায় আবেদন কিছু ক্ষেত্রে তামাশা।  

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স এখন গড়ে ৬৫ থেকে ৬৮ বছর। বয়োজেষ্ঠ্য মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স প্রায় ৯০। তাদের সন্তানরা ৩২ পার করেছেন অনেক আগেই। তাদের নাতি-নাতনির বয়স ৩২ বছর পার হলেই এই কোটার কার্যকারিতা শেষ।  

বর্তমান নিয়মে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি বাড়ানোও হয়, তাহলেও এই কোটার ৪ শতাংশ পূরণ হবে কিনা সন্দেহ আছে। অন্যদিকে কোটা যদি কমানো হয় তখন সংকোচিত কোটার আবেদনগুলি অপরাজনীতির শিকার হবে না, সেই গ্যারান্টি কি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিতে পারবে? জীবনবাজি রাখা পিতার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি দিয়ে গর্ব অনুভব করা আমাদের জন্য কম সন্তুষ্টির নয়। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতিপক্ষ হিসেবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে দেয়া, তাহলে কথিত ইন্ধনদাতারা সফলই বলতে হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি তাদের বাড়তি পাওয়া। মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকাটা গৌরবের, এই কোটা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার অপমানবোধ করছে। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। চলমান কোটা বিতর্ক নিরসনে বিশেষ দুটি দিক তুলে ধরা উচিত।

এক. মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী কোটা লেখা হোক। অর্থাৎ কোটা লেখার আগে সম্মানী ভাতার মতো ‘সম্মানী’ শব্দটি লেখা।

দুই. ১৯৭২ সালের পর থেকে পিএসসিসহ সব সরকারি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় অপ্রদত্ত-পদগুলোর আলাদা অংশগ্রহণমূলক পরীক্ষা নিয়ে পূরণ করা এবং ফলাফলের মেধাক্রম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরি দেয়া হোক।  

হিমু হামিদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর, জিওগ্রাফ্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৮
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।