ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ছলচাতুরি

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৮ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৮
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ছলচাতুরি গতবছরের ২৫ আগস্টের পরে এভাবেই রোহিঙ্গা ঢল নামে। ছবি: বাংলানিউজ আর্কাইভ

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র গ্রহণযোগ্য, আন্তর্জাতিক ও আইনগত সমাধান। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের পূর্বপুরুষ যুগ যুগ ধরেই মিয়ানমারে বসবাস করে আসছিল। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, সহায়-সম্পদ লুটপাট করে নিজ ভিটে-মাটি থেকে বিতাড়ন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে এসে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছে মিয়ানমার।

এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, তাই সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। সাম্প্রতিককালে কোনো একটি জাতি-গোষ্ঠীকে নিজ ভূখণ্ড থেকে এভাবে বিতাড়ণের নজির নেই।

জাতিসংঘ এটিকে জাতিগত নিধনের একটি উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু তারা শুধু জাতিগত নিধন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জাতিসংঘ সনদ, মানবিকার ঘোষণা, আইসিসি সনদসহও অপরাপর মানবাধিকার সনদগুলোতে উল্লিখিত অনেক অপরাধেই মিয়ানমার সেনা কর্তৃপক্ষ আজ অভিযুক্ত।  

আরও পড়ুন>>
** 
রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় তালিকা নিতে রাজি হয়নি মিয়ানমার

কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এসব দেখেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয়নি। ‘নিন্দা’, ‘বক্তব্য’ ও ‘প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত’র মধ্যেই তাদের সব কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশ তো বসে থাকতে পারে না। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এই সংকটের রূপরেখা তুলে ধরেছে ও বিশ্বকে এ সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা করছে না। বাংলাদেশের চাপের মুখে পড়ে যদিও তারা প্রত্যাবাসন বিষয়ে গত ২৩ নভেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক করেছে, কিন্তু এর আওতায় একটি পরিবারকেও তারা প্রত্যাবাসন করেনি। যদিও কথা ছিল দুই মাসের মধ্যে তারা তাদের নাগিরকদের দেশে ফেরত নেবে। কিন্তু ছয় মাসেও কোনো অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তারা মিথ্যাচার, ছলচাতুরি ও কালক্ষেপণ করে যাচ্ছে আর বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে জাহির করছে যে তারা প্রত্যাবাসনে অত্যন্ত আন্তরিক ও এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে এমন মিথ্যাচারও করেছে যে, বাংলাদেশের জন্যই প্রত্যাবাসন বিলম্ব হচ্ছে! বুঝতেই পারি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা তাদের সব রকম কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও প্রচার-প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরো বেগবান করতে হবে। আমরা তা করছিও। এর ফলেই ভারত তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্য মিয়ানমার থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে বলেই মনে হয়। যদিও চীন যুক্তরাজ্যকে নেপিদোর দিকেই থাকতে বলছে। এ মুহূর্তে নিরাপত্তা পরিষদে চীন ছাড়া মিয়ানমারের আর কোনো জোড়ালো কণ্ঠ নেই। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত রাখতে একটি ভেটই যথেষ্ট।

প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ করেছে। এই ওয়ার্কিং গ্রুপ আজও প্রত্যাবাসন শুরু করার কোনো সুনিদিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দিয়েছে মিয়ানমার তা গ্রহণ করেনি। প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ তিন মাস আগে ৭ লাখ রোহিঙ্গা থেকে প্রাথমিকভাবে ৮০৩২ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল মিয়ানমারে হাতে। মিয়ানমার সেখান থেকে ১০০০ জনের তালিকা প্রত্যর্পন করেছে (verify)। এমতাবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৭ মে) ঢাকায় এই ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছে এবং কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়াই তা শেষ হয়। মিয়ানমার বলেছিল, প্রতি সপ্তাহে তারা ১৫০০ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। এভাবে ফেরত নিলে সব রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে ১০ বছর লাগবে। কাজেই এ জাতীয় অবাস্তব প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ সবকিছু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে না নেয়ার অজুহাত।  

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজ দেশে ফেরত নেবে। শরণার্থীদের তালিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা (verify) করার এমন নজির বিশ্বে বিরল। সাধারণত শরণার্থীদের গ্রহণকারী রাষ্ট্র নিজের সুবিধার জন্যই পরিচয়পত্র বা কার্ড দিয়ে থাকে। সেটি প্রত্যাবাসনের জন্য নয়, বরং শরণার্থী হিসেবে তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এমন কার্ড দেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এটিই যথেষ্ট। বাংলাদেশ সব রোহিঙ্গাদের এমন পরিচয়পত্র বা কার্ড দিয়েছেও। আর এখন মিয়ানমার বলছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত যেতে হলে মিয়ানমারের নাগরিকত্বের সদন বা জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। যা শুধু অবান্তর ও অবাস্তবসম্মতই নয়, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ছলচাতুরিপূর্ণ।

যখন কারো ঘর পোড়ে তখন সে ঘর থেকে আইডি কার্ড নিয়ে বের হয় না, কোনোমতে জীবন নিয়ে বের হয়ে আসে। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মুখে ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার পরে তারা আবার বাড়ি ফিরতে চাইলে তাদের আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে? এছাড়া কোনো বাংলাদেশি নাগরিক মিয়ানমারে গিয়ে সুখের স্বর্গ গড়বে, মিয়ানমারের এজাতীয় ভাবনা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। না জীবনাচার, না গণতন্ত্র কোনো কিছুতেই তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে নেই। অস্ত্র দিয়ে ঘর পাহারা দেয়া যায়, ঘরের ভেতরের শান্তি নিশ্চিত করা যায় না। সনদে শান্তি মেলে না। কাজেই মিয়ানমার যা বলছে তা প্রত্যাবাসন না করারই অজুহাত। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এ বিষয়টি বুঝতে হবে।

মিয়ানমার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো অনুকূল পরিবেশও সৃষ্টি করতে পারেনি। যে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে তা এখনও রাখাইনে বহাল। রাখাইনে রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকতে পারবে-মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মাঝে সে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারেনি। এটি জরুরি। শুধু চুক্তি করলেই হবে না। সে চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশও মিয়ানমারকেই সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব প্রদান করছে না, সরকারি চাকরি তো পরের কথা। তাদের ঘর-বাড়ি, এলাকা এখন অন্যদের দখলে। সংখ্যালঘু এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্ব বিবেক আজ কোথায়? প্রশ্নটি মানবাধিকারের ও মানবিকতার।

রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত যেমন সুর বদলেছে, অন্য রাষ্ট্রগুলোও যাতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নেয় তার জন্য বাংলাদেশকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরে নির্যাতন ভোগ করে আসছে। তারা পৃথিবীর অন্যতম একটি নির্যাতিত  জনগোষ্ঠী। বিশ্বকে আজ এই জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে। মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদেরকে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। এখানে কোনো ‍ধরনের অবহেলা বাংলাদেশকে একটি স্থায়ী সংকটের মুখোমুখি করবে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।