ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শুভ জন্মদিন পৃথুলা রশিদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৮
শুভ জন্মদিন পৃথুলা রশিদ ছবির ফ্রেমে বেঁধে রাখা এ পৃথুলা এখন কেবলই স্মৃতি

মোবাইলে নম্বর ডায়ালের পর ওপারে রিং বাজতেই বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করলো। কিভাবে যে শুরু করবো! ভাবনা গোছানোর আগেই শান্ত কণ্ঠস্বর ওপ্রান্তে-

: হ্যালো!
: জ্বি, পৃথুলা রশিদের মা বলছেন? 
প্রশ্ন নয়, যেন একরাশ মেঘ ছুড়ে দিলাম তার দিকে। অপরপ্রান্তে তা কান্না হয়ে ঝরে পড়লো।

 
: জ্বি, আমিই পৃথুলার মা...আমিই। কিন্তু পৃথুলা তো...।  
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি রেডিওতে কাজ করি, তার ইন্টারভিউ নেবো শুনেই গলায় আর্তি ঝরালেন-
: আমি মিডিয়ার কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য এখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত নই মা।  
: আমার ইন্টারভিউ লাগবে না, আপনার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলতে চাই। দেখা করতে চাই।
: চলে আসো পৃথুলার কবরের কাছে, বিকেলে।  
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ফটকে এসে ফোন দিলাম। জানালেন অফিস থেকে বের হয়েছেন। সুনশান-নিস্তব্ধ কবরগুলো দেখছিলাম অনেক সময় নিয়ে। হঠাৎ মা ফোন দিলেন। পৃথুলা রশিদের মা, রাফেজা বেগম। অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলো ওনাকে। তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি এনজিওর অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর। ইশারা করলেন তার পিছু যাওয়ার জন্য। হাতে তসবিহ, দোয়া-দরুদ পড়ে চলেছেন অবিরত। সমাধিগুলোর ফাঁক গলে হাঁটছি আমরা। ডানে-বামে অসংখ্য কবর। অনেকবার কবরস্থান চক্কর দিলেন রাফেজা বেগম।

এরমধ্যে দু’একটা ছোট প্রশ্ন করতে থাকলেন, সাথে কে, কোথায় থাকি, কয় ভাই-বোন ইত্যাদি। অজানা কোনো কারণে খুব অস্বস্তি-অস্থির লাগছিলো। পত্রিকা-ফেসবুকে যে দুরন্ত কো-পাইলটের উচ্ছল ছবি দেখেছি, সেই মায়াবী তরুণীর নিশ্চুপ কবরে পাশে যাচ্ছি।

যেখানে আমরা থামলাম, সেটি অনেক ভেতরে। কবরের নেমপ্লেটে লেখা, ‘মরহুমা পৃথুলা রশিদ’।
কী বলে কথা শুরু করবো এমন ভাবনার মধ্যে তিনিই অবাক করে দিয়ে আলাপ তুললেন- 
: বাবু, একটু দেরি হয়ে গেলো রে আজ। আমার পাখি, এই যে আমি চলে এসেছি। ও হচ্ছে মৌ, তোমাকে দেখতে এসেছে।

কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত পৃথুলার সঙ্গে মায়ের এমন হৃদয়স্পর্শী কথোপকথন আমার জন্য একেবারেই অচেনা। চোখ ছলছল করতে থাকলেও কোনো ব্যাখ্যা মিলছিল না এই অনুভূতির।

টুল কিনে রেখেছেন মেয়েকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য, আমাকে বসতে দিলেন। বললেন-
: আমার ময়না পাখিটা বড্ড লক্ষ্মী মেয়ে ছিল, জানো মা? আমরা দু’জন ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড, সব শেয়ার করতাম, সব। একটু পরপর আমরা দু’জন দু’জনের খোঁজ নিতাম। কখনো যদি অফিস থেকে আমার ফিরতে দেরি হতো, তখন ওরা বাপ-মেয়ে টেবিলে ভাত-তরকারি সাজিয়ে বসে থাকতো। তবু তিনজন একসঙ্গে না হলে খেতাম না। আজো আমি আর ওর বাবা প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে থাকি, কিন্তু খাওয়া আর হয় না।

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। গড়ানো অশ্রু মুছে দিতে গেলে বলেন-
: কত মুছবা।  সারাদিন ঝরতেই থাকে, আমার বাবু আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না।  

প্রসঙ্গ ঘোরাতে পৃথুলার বাবার কথা তুলতে হলো। সে কথা বলতে যেন আরও মুষড়ে পরছিলেন।
: ওর বাবা (কে এম আনিসুর রশীদ) মেয়ে ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত ওর কাপড় ধোয়া-ইস্ত্রি সবই উনি করতেন। আমি তো কাঁদতে পারছি, তিনি তাও পারেন না।

কিছু বলতে পারছিলাম না। বলতে যাবো। থেমে গেলাম তার আরেক কথাতেই।
: আমি তোমাকে (পৃথুলা) আকাশে উড়বার অনুমতি দিয়েছিলাম, আকাশে থেকে যাবার নয়।
চোখ মুছতে মুছতেই বলেই যাচ্ছিলেন-
: ২২ তারিখ ওর দু’টো ফ্লাইট ছিল। একটা ঢাকা-চিটাগং, আরেকটা ঢাকা-কাঠমাণ্ডু। প্রথম ফ্লাইট শেষে আমি কল দিলাম, ও বলে,- তুলা, তুলা।  

জিজ্ঞেস করলাম-
: মানে কী খালাম্মা?
: ফ্লাইট খুব সফটলি ল্যান্ড করলে পৃথুলা বলতো- তুলা, তুলা। আমি তখন বললাম, ফি আমানিল্লাহ্। সেদিন পৃথুলার পছন্দের খাবার ডাটা-চিংড়ি কিনবো বলে বাজারে গেলাম, কী মনে করে না কিনেই ফিরে এলাম। পৃথুলার বাবাকে বললাম কিনে আনতে। পৃথুলার একটা ফোন আমার কাছে ছিল। ওর বন্ধু দীপঙ্কর কল দিলো, বললো, পৃথুলা তুই কই রে? আমি বললাম দীপঙ্কর কী হয়েছে। ও ফোন কেটে দিলো কিছু না বলেই। এর কিছুক্ষণ পরই বাড়িওয়ালার ফোন, ‘আপনার মেয়ে কি আজ ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট গেছে? আমি হ্যাঁ বলায় তিনি তড়িঘড়ি করে রেখে দিলেন। এরপর ওর বাবাকে ফোন দিলাম, বাকিটা সহ্য করতে পারছি না এখনো।

এরমধ্যেই কবরস্থান এলাকায় মাগরিবের আজান হলো, মা পানি খেলেন। পৃথুলা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই রোজা তিনি। শুধু পানি দিয়ে ইফতার করবেন, আমি কিছু নিয়ে আসি বলতেই থামালেন। বললেন-
: সুস্থ থাকার খুব বেশি কি দরকার আছে আর?

আমি ওঠার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, তিনি ঘনিয়ে আসা অন্ধকারেও মেয়ের সঙ্গে আরও অনেকক্ষণ থাকবেন। হঠাৎ বললেন-
: তুমি কিন্তু তোমার প্রশ্ন করোনি।
: আমার মেয়েটাকে পাইলট বানাতে চাই। সাহস পাচ্ছি না।
: অবশ্যই, কেনো নয়। আমি চাই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৃথুলা রশিদ গড়ে উঠুক।  

সন্ধ্যার আলো আবছায়ায়, অসংখ্য সারি সারি কবরের মধ্যে দিয়ে ফিরছি আমি। এ এক অন্য আমি, পৃথুলার মা বসে আছেন কবরের পাশে। পৃথুলার বাবাও আসছেন মেয়েকে সঙ্গ দিতে। কারণ তারা জানেন, তাদের আদরের লক্ষ্মী মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পায়।

১৮ জুলাই পৃথুলার জন্মদিন। গত ১২ মার্চ প্লেন দুর্ঘটনায় তিনি দুনিয়ার মায়া ছাড়ার পর প্রথম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন পৃথুলা রশিদ। আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণা।

 

লেখক:
আর জে, সিটিএফএম৯৬.০০

বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।