গত কয়েকদিনের ব্যবধানে একটি সংবাদ মাধ্যমের এর মতামত বিভাগে বাংলাদেশের তরুনদের রাজনীতি বিষয়ক দু’টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দু’টি লেখাই সুলিখিত।
আমাদের দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা সাধারণত লেখালেখি করেন না। অথচ আমরা সাধারণ মানুষরা চাই উনারা নিয়মিত লিখুন। এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, এবার বিএনপির মহাসচিবের লেখা পড়লাম। দলীয় মহাসচিব হিসেবে তিনি তাঁর দলে নতুন এবং ভাল কর্মী চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি তাই চেয়েছেন, দেশের তরুন সমাজকে তাঁর দলে যোগ দেবার আহবান জানিয়েছেন। এতে খারাপ কিছু দেখি না। নিমন্ত্রণ দেবার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন, নিমন্ত্রণ গ্রহন করা বা না করার দায়িত্ব তরুন সমাজের। আমরা যারা তারুন্যের সেই উত্তাল দিনগুলো পার করে এসেছি তাঁদের উচিত হবে তরুনদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা না করে ওদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে দেয়া। বাংলার তরুন সমাজ যে কখনো সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তার সাক্ষী। সে কারনেই আরিফ জেবতিকের লেখা পড়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম।
লেখক, কলামিস্ট ও ব্লগার হিসেবে আরিফ জেবতিক অনেক জনপ্রিয়। তাঁর এক ব্লগ লেখা সারাবিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে আমরা মিজ ভ্যালরি টেইলর প্রতিষ্ঠিত সিআরপিকে রক্ষা করেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই নেটস্ফিয়ারে বিচরণকারী তরুণ সমাজ ওনার এই সাম্প্রতিক লেখাটিও পড়বে এবং এটা নিয়ে চিন্তা করবে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতি করার বা না করার সিদ্ধান্তও নেবে।
নিজের তারুণ্যে আমিও ছাত্র রাজনীতি করেছি আর সেই কারণেই এখনো তরুণ ছাত্রদের রাজনীতির পক্ষেই আমার অবস্থান। তবে সেই ছাত্র রাজনীতি বর্তমানে প্রচলিত দলীয় ছাত্র রাজনীতি নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ছাত্র রাজনীতি। বলাবাহুল্য দীর্ঘ দিনের চর্চার অভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদীয় রাজনীতির সাথে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম পরিচিত নয়। তারা জানে না যে, তাদের রাজনীতি চর্চার পাঠশালা এবং দাবি আদায়ের প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এই ছাত্র সংসদগুলো। দেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন আর নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। ফলে কার্যকর ছাত্র রাজনীতিও নেই।
দলীয় লেজুড় ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনও নেতাই ছাত্র নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে নেতৃত্বটা আসল ছাত্রদের হাতে থাকতো। ছাত্র নেতারা কেন্দ্রের নেতাদের পেছনে না ঘুরে সাধারণ ছাত্রদের পেছনে ঘুরতো, তাঁদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতো, আন্দোলন করতো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোটের মাধ্যমেই তাঁদের যোগ্য নেতাকে নির্বাচিত করতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় আমি হল সংসদে সহ-ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলাম। ১৯৯১ তে ২য় বর্ষে পড়ার সময় জাকসুতে সহ-ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছি।
দু’বারই প্রতিপক্ষ ছিলো সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তখনো ছাত্র সংগঠনগুলোতে সন্ত্রাসী ছিলো। তবে দলের ভেতরে নির্বাচনের জন্য প্যানেল তৈরির সময় তাঁদেরকেও কাউন্সিলরদের ভোটে পাশ করে আসতে হতো। জাকসু নির্বাচনে পাশ করতে পারবে না এমন নেতাকে কাউন্সিলররা দলের প্রাথমিক বাছাইতেই বাদ দিয়ে দিতে পারতো। সবচেয়ে বড় কথা কেন্দ্র থেকে নেতা চাপিয়ে দেওয়া হতো না। কারণ বিতর্কিত প্রার্থী দিলে পাশ করে আসা অসম্ভব ছিলো।
আমি যে জাকসুতে নির্বাচিত হয়েছিলাম সেখানে সাহিত্য সম্পাদক পদে যুগ্মভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মানস চৌধুরী (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। উনি বাম সংগঠন করতেন, নাটক লিখতেন ও পরিচালনা করতেন। একই নাটকের নাট্যকার এক প্যানেলের হয়ে নির্বাচন করেছেন আর অভিনেতারা প্রতিপক্ষের হয়ে নির্বাচন করেছি। সবাই নির্বাচিত হয়েছি। এটাই তো ছিলো ছাত্র রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিবেশ। তাহলে এখন কেন সেই পরিবেশ নেই?
নির্মম সত্য এই যে, স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি শুরু হয়েছিলো সেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোই ছাত্ররাজনীতির অভ্যন্তরীণ ও সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আগের মতো এখন আর ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের ভোটে কাউন্সিলর এবং কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচন হয় না। অছাত্র নেতারা উপর থেকে নাজেল হন; দলে কোনও সদস্য বা কর্মী নেই; সবাই নেতা। ফলে ছাত্র সংগঠন বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না এবং ভিকারুন্নেসা বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে তারা অংশগ্রহণ করে না।
বরং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে এই আন্দোলনের গলা টিপে ধরতে দেখা যায়। ছাত্র সংসদে নির্বাচনের প্রশ্ন থাকলে ছাত্র নেতারা মূল দলের নির্দেশে এভাবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়াতে সাহস পেতেন না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তরুণদের নিমন্ত্রণ দেবার পাশাপাশি অছাত্র ও মূল দলের সরাসরি হস্তক্ষেপমুক্ত ছাত্র সংগঠন উপহার দিলে এবং সেই আগের মতো গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চর্চার অঙ্গীকার করলে তরুণ শিক্ষার্থীরা অবশ্যই তাদের দাবি আদায়ের প্লাটফরম হিসেবে সেই ছাত্র সংগঠনে যাবার জন্য আকর্ষিত হবে। এমন একটা ঘোষণা এবং পদক্ষেপ নিয়ে তিনি এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
অন্যদিকে আরিফ জেবতিক যেভাবে তরুণদের দুই প্রধান দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হবার আহ্বান জানিয়েছেন তা অবশ্যই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমার সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ করা মধ্যবয়স্ক চাচাও আমাকে একই পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৭৭ হতে ১৯৯০ পর্যন্ত উনার চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে যে পরিবর্তন হয়েছিলো সম্ভবত সেই প্রেক্ষিতেই উনি তা দিয়ে থাকবেন। আরিফ জেবতিকও হয়তো একই কাজ করছেন। তা না হলে তিনি তরুণদের কোনও বিকল্প দল বা তৃতীয় পক্ষ দেখাতেন। নব্বইয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে উনার অবশ্যই জানা আছে যে, রাজনীতির বাইরে থেকে, মানে সিস্টেমের বাইরে থেকে সিস্টেমের ভেতরে কোনও পরিবর্তন আনা যায় না। তাহলে কেন বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা সিস্টেমের বাইরে থাকবে?
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এই দু’টি দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগই নির্বাচিত হবার সম্ভাব্য অবস্থানে ছিলো। তখন কিন্তু শ্রদ্ধেয় আরিফ জেবতিক তরুণদের এই দুই দলের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন নি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষেই তরুণদের সমর্থন চেয়েছেন। এখন তরুণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষার অধিকার এবং পরিবারের মৌলিক অধিকার বিবেচনা করে বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে চাইতেই পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা বাণিজ্য করার সুযোগ করে দিতে দরিদ্র ও কর্মজীবীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর শিক্ষণে এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিগ্রী পাস প্রোগ্রামগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দীর্ঘ সেশন জটের ফাঁদে ফেলা হয়েছে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছে। যে কৃষক পরিবারের সন্তান আজকের তরুণ শিক্ষার্থী, সে তার রাজনীতির সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সারের বস্তার দাম ২৫০ হতে ১২৫০ টাকা হওয়াকেও নিশ্চই বিবেচনা রাখতে চাইবে। বিবেচনায় রাখতে চাইবে তার অভিভাককের অর্থ শেয়ার বাজারে লুট হয়ে যাবার কথা, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা। তাঁদের মাথায় থাকবে অতীত দুর্নীতির অযুহাত দিয়ে বর্তমান দুর্নীতিকে বৈধতা দেবার প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে ঢিমেতালে চলা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই তরুণদের মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। তারা সন্দেহ করছে, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে ঝুলিয়ে রেখে সরকারি দল আবারো একই অযুহাতে ক্ষমতায় আসতে চায়। অন্তর্জালে বিচরণকারীরা তরুণদের এই ক্ষোভ টের পান। একজন সচেতন সাংবাদিক ও ব্লগার হিসেবে আরিফ জেবতিকের ও এই ক্ষোভ টের পাবার কথা। হয়তো এই কারণেই মন্দের ভালো হিসেবে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার স্বার্থে হলেও তরুণদের এই সরকারের পক্ষে থাকা উচিত, আর তা না হলে কোন পক্ষেই যাওয়া ঠিক হবে না। নিজেদের ‘মৌলিক অধিকার’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ এই দুই ইস্যুকে মাথায় রেখে তরুণ প্রজন্ম কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা তাঁদেরই ঠিক করতে হবে। আমরা শুধু পারি তরুণদের সিদ্ধান্ত নেবার বন্ধ পাঠাশালাটি আবার খোলার ব্যবস্থা করে দিতে।
আসুন আমরা তরুণদের নিজেদের সিদ্ধান্ত ওদের নিজেদেরকেই নিতে দেই। পারলে ওদের মধ্যে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চাটা ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাই। আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে মূল দলের প্রভাবমুক্ত গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ফিরিয়ে দেবার জন্য সম্মিলিত চাপ সৃষ্টি করি।
এ.কে.এম. ওয়াহিদুজ্জামান: গবেষক ও কলামিস্ট। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশের শিক্ষক
বাংলাদেশ সময় ১৬৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১১