সারা দুনিয়ার মতো বিভক্ত মতধারার অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম সমাজ আগামী রোববার-সোমবার দু’দিনে ঈদ করবেন। আরব ক্যালেন্ডার অনুসারীরা ঈদ করবেন রোববার।
উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার ঈদের ছুটি নেই। ঈদের ছুটি দিতে এ দেশের সরকারের আপত্তিও নেই। মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছে সে কারণে একমত একটি দিনের প্রস্তাবও চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এতে একমত হতে পারেননি। তবে ঈদে মুসলিম স্টাফরা ছুটি চাইলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ক্যাজুয়াল ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। যাদের স্থায়ী চাকরি নেই তারা অবশ্য এমন ছুটি নিতে চানও না। কারণ একদিন কাজ মিস মানে ডলার-ইনকাম মিস। সাপ্তাহিক আয়-রোজগারের হিসাবে গড়মিল হয়ে গেলে ব্যয়বহুল জীবনের অনেক কিছুতেই গড়বড় দেখা দেয়। জীবনের হিসাব এখানে এমনি কঠিন!
এবার দেখা যাক অস্ট্রেলিয়ার মুসলিমরা কোরবানি কিভাবে দেন। বাংলাদেশের মতো শহরের ভিতরে যেখানে সেখানে কোরবানির পশুর হাট, রাস্তার পাশে জবাই হাইজেনিকসহ নানা কারনে এদেশে অকল্পনীয়। বা স্বাভাবিক রাতের বেলা ঢাকা সহ প্রধান শহরগুলোতে কসাইখানায় যেমন পশু জবাইর জন্য আসে তাও এদেশে কল্পনার বাইরে। এদেশে সব জবাই’ই হয় শহর থেকে দূরের খামারবাড়িতে। সেখানে জবাইর নানান আধুনিক ব্যবস্থা আছে। এদেশে মুসলিমরা মূলত কোরবানির টাকা জমা দেন যার যার এলাকার মুসলিম বুচার শপ বা মাংসের দোকানে। সিডনির বাঙ্গালিপাড়া লাকেম্বার বাঙ্গালি মালিকানার দোকানটিতে এবার গরুর প্রতি নামের জন্য ১৫০, খাসি ১৪০, ভেড়া ১৪০ ডলার করে নেয়া হয়েছে। এভাবে এদেশে কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ কোরবানির পশু দেখেন না। দোকানি নিয়মমাফিক শহর থেকে দূরের খামারের মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পশু জবাই, ভাগাভাগি প্যাকেট করে নিয়ে আসেন। এরপর টাকা জমার রশিদ দেখিয়ে ঈদের ২/১ দিন পর দোকান থেকে মাংস নিয়ে আসতে হয়।
এর বাইরে অনেকে আবার পরিজন নিয়ে বহুদূরের খামারে ড্রাইভ করে গিয়ে সেখানে আগে থেকে কিনে রাখা পশু নিজেদের হাতে জবাই, কাটাকাটি করে মাংস নিয়ে আসেন। কিন্তু এমন সময়ও এদেশের খুব কম মানুষের আছে। এবার আবার এদেশে রোববার বা সোমবার যে যেদিনই ঈদ করুন না কেন কোরবানির মাংস পাবেন মঙ্গলবারে। কারণ রোববারে আইনত এদেশে পশু জবাই হয় না। সে কারণে সব পশু জবাই হবে ৭ নভেম্বর সোমবার। দোকানিরা মাংস দেবে ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার।
কোরবানির মাংস বিলিও এদেশে আরেক সমস্যা। বা নিয়ম মাফিক যে কোরবানির মাংস ৩ ভাগ করে এর একভাগ গরিব-দুঃস্থ মানুষজনকে দিতে হয় সে সুযোগ নেই এদেশে। কারণ মাংস দেবার বা নেবার মতো সে রকম অফিসিয়াল গরিব মানুষ এদেশে নেই। এর কারণে গরিব মানুষের ভাগের মাংসের টাকা হিসাব করে অনেকে দেশে পাঠিয়ে দেন। আত্মীয়স্বজনের ভাগের মাংস গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে বিলির সময়ও অনেকের নেই। কোরবানির পশুর চামড়া বা এর টাকা বিলিবন্টনের ঝামেলা ঘাড়ে নেবার সুযোগও নেই লোকজনের। দোকানি বা খামার থেকে চামড়ার টাকা মুসলিম চ্যারিটি সংগঠনগুলোর কাছে চলে যায়। সেই চ্যারিটির টাকা হয়ত হাতবদল হয়ে চলে যায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জামায়াত জাতীয় মৌলবাদী দলগুলোর হাতে।
অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোয় বিশাল সব আকারের গরু কোরবানির উদ্দেশে মাটিতে শুইয়ে জবাইর প্রচুর লোকবলও নেই। এমনিতে এদেশের খামারে সব জবাই হয় মেশিনে। জবাই হালাল করতে কম্পিউটারাইজ মেশিনে প্রোগ্রাম করা শব্দ বাজে, আল্লাহু আকবর। আবার কোরবানির জন্য অনেক ক্ষেত্রে দূর থেকে গরুর মাথায় গুলি করে তাকে কাবু করা হয়। গরু মাটিতে পড়ে গেলে একজন দৌড়ে গিয়ে গলায় ছুরি চালান। আরেকজন হয়ত পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কোরবানিদাতাদের নাম পড়েন, আব্দুল কাদির, পিতা মৃত আব্দুর রহিম--! আরবিভাষী বুচার শপগুলো আবার কোরবানিদাতার নাম জমা নেবার সময় দাতার পিতা বা স্বামীর নামও নেয় না।
কোরবানির পশুগুলো আবার একেকটি বিশাল সাইজের হওয়াতে গরুর প্রতি নামের বিপরীতে মাংস পাওয়া যায় ৩০-৩৫ কেজি। খাসি বা ভেড়ার ক্ষেত্রেও তা একেকটিতে ২৫-৩০ কেজির কম নয়। সৌখিন অনেকে বিশেষায়িত খামারে উৎপাদন-লালন করা হরিণ-ক্যাঙ্গারুও কোরবানি দেন। তবে এমন ঘটনা খুব ব্যয়বহুল। গল্পের মতো। এদেশে মাংসের বড় বিপদ অত্যধিক মাত্রার চর্বি। কোরবানির মাংস এনে চর্বি পরিষ্কারে অনেক সময় যায়। এক ঈদে শখ করে ভেড়া কোরবানি দিয়ে বেশ বিপদে পড়তে হয়েছে। এদেশে ডায়েটিং বিশেষজ্ঞরা আবার খাসির চেয়ে ভেড়ার মাংসে তুলনামূলক চর্বি কিছুটা কম বলে সুপারিশ দিয়ে থাকেন। তেমন সুপারিশে ঈমান এনে ভেড়া কোরবানির ২৫ কেজি মাংসের চর্বি সাফ করতে করতে লম্বা সময় গেছে। বিপদ হয়ে গিয়েছিল অন্যখানে। অঢেল চর্বি ছাড়ানোর অনেক সময়-পরিশ্রমের পাশাপাশি ঘর-কাপড় সবকিছুতে ভেড়ার মাংসের গন্ধে বিদঘুটে অবস্থা চলেছে কয়েকদিন!
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক