ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

অদূরদর্শিতায় ভিলেন যেখানে নায়ক

অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম, মালয়েশিয়া থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১১
অদূরদর্শিতায় ভিলেন যেখানে নায়ক

রাজা মন্ত্রী হবার সাধ কার না থাকে! সেই সাধে ছোটবেলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজনীতিবিদ এর সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? তিনি বলেছিলেন দূরদর্শিতায়। আমার দূরদর্শিতা কম, তাই সে পথ আর মাড়াইনি।

অগ্যতা বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমি বড় ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ, আজ আমি ডাক্তার হয়েছি বটে তবে বড় ডাক্তার কিনা তা এখনও জানি না। জীবন সায়াহ্নে এসে এখন মনে হচ্ছে, বাবা কি আমাকে ভুল শিক্ষা দিয়েছিলেন! হতে পারে, দূরদর্শিতা সে সময় একটি ফ্যাক্টর থাকলেও আজকাল তা মূল্যহীন! সম্প্রতি নাসিক নির্বাচন আর নরসিংদীর মেয়র এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে সে ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে।
 
আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে কে বা কারা উপদেশ দেন আমার জানা নেই। নাসিক নির্বাচনে সেনাবাহিনী না মোতায়েনের সিদ্ধান্ত যদি প্রধানমন্ত্রীর স্ব ইচ্ছায় হয়ে থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই, কেননা ভাল মন্দের বোঝা আগামীতে তাকেই বহন করতে হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত যদি অন্য কারও পরামর্শে নিয়ে থাকেন তাহলে আমার দুটি কথা থেকে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত/সমর্থিত প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ছিল, “সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজনে নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে যেরূপ সহযোগিতা চাইবে সরকার সেইরূপ সহযোগিতা দিতে বাধ্য”।

স্ফটিক স্বচ্ছ এ রায়কে সামনে রেখে  সরকার তার সিদ্বান্তের স্বপক্ষে যত ব্যাখ্যাই দিক না কেন তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? তাছাড়া ইতিপূর্বে নির্বাচন কমিশনের আবেদনে সেনাবাহিনী নামানোর একাধিক নজির রয়েছে। সেনাবাহিনীকে দিয়ে চাল বিতরণ আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের চাইতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা অনেক সম্মানজনক। জননেতা শামীম ওসমানকে যে কৌশলে তার গণ্ডিতে আটকে রেখে সুন্দর ও স্বাভাবিক নির্বাচন উপহার দেওয়া হয়েছে তা প্রশংসিত। তবে উচ্চ আদালতের রায় সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে সেনাবাহিনী চেয়ে পায়নি বিধায় সব প্রশংসাই যেন ঢাকা পড়ে গেছে। এই নজিরকে সামনে রেখে আগামী দিনের সরকার গুলিও যদি একই কাণ্ড ঘটায় তাতে সর্বোচ্চ আদালতের মান সম্মান অথবা ভাবমূর্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সর্বোচ্চ আদালতের তার নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় কি কিছুই করণীয় নেই!

বাংলাদেশি হয়েও হাতে গোনা যে ২/৪ টি জেলা সদরে আমার পা পড়েনি তার একটি নরসিংদী।
সম্প্রতি সেখানের জনপ্রিয় যুবনেতা ও মেয়র লোকমান হোসেন আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন।

পেশায় ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট হওয়ায় কেউ মারা গেলে আমার ইন্দ্রিয়শক্তি সচল হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তো কথাই নেই। ফরেনসিক সূত্র অনুযায়ী, দুষ্কৃতকারী তা সে যতই সুচতুর অথবা ক্ষমতাবান হোন না কেন ধরা পড়ার মত আলামত রেখে যাবে/গেছে।

কে বা কারা তদন্তে নিয়োজিত অথবা তাদের  যোগ্যতাই এখন বিবেচ্য। তবে যুবনেতা মেয়রের মৃত্যুতে সেখানকার জননেতা ও মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু ও তার ভাইয়ের সম্পৃক্ততা নেই ধরে নিলেও এ ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে তাদেরও মৃত্যু ঘটে গেছে। এখন তাদের নারীঘটিত কেলেংকারী যেভাবে উন্মোচিত হচ্ছে তা তো বোনাস। আর তাই গণক না হয়েও বলা যায়, যতদিন রাজুরা বেঁচে থাকবেন, মৃত যুবনেতা তাদের অস্বস্তিতেই রাখবে। তার উপর খায়রুল কবির খোকন এর দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তো কথাই নেই। ডাইরেক্টলি হেল অর জেল!

আমি মনে করি, রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার অভাবই দেশ ও জাতির অবক্ষয়ের মূল কারণ। আগামীতে কি ঘটতে পারে তা যদি কল্পনায় না আনা যায় তাহলে তারা সঠিক পরিকল্পনা করবেন কিভাবে! এ ব্যাপারে আমাদের নেতাদের কোনও ভাবনা আছে কীনা এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জনসেবার কথা বলে ক্ষমতায় এসে তারা নিজ সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেধা আর প্রাপ্ত ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে! পরবর্তী নির্বাচনে এরা তাদের কতৃকর্মের জন্য ধরাশায়ী হবেন জেনেই কূট কৌশলের আশ্রয় নেন। সম্প্রতি উইকিলিক্স যেভাবে তাদের উলঙ্গ করেছে তা আর ভাবতে চাই না। বিদেশে বিদেশি দূতাবাসের চিঠি চালাচালিতে জানা যায়, গাদ্দাফি আর ব্লেয়ারের গোপন বৈঠকের তথ্য । আর আমাদের দেশের বিদেশি দূতাবাসের চিঠি চালাচালিতে জানা যায়, কে কাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চায় অথবা গোয়েন্দা সংস্থার উপর আস্থাহীনতার খবর! অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, টয়লেটে বদনা নেবেন না ঘটি,  সেটিও আমাদের নেতারা বিদেশ দূতাবাসে জানিয়ে আসতেন।

আবার আমি আমার লেখার মূলধারায় ফিরে আসি। নারায়ণগঞ্জ আর নরসিংদী, দুটি জেলাতেই সরকারি দল নায়ক ও ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় যা কি না ফাস্ট, সেকেন্ড! ভিলেনকে নিয়ে সরকারি দলের মাতামাতি আমার মত অনেককেই ব্যথিত করেছে। এটি কিসের আলামত? সরকার কি জনগণের মনের কথা জেনে গেছে! সেনাবাহিনী ব্যারাকে, নতজানু নির্বাচন কমিশন, ভিলেনরা সরকারি দল সমর্থনপুষ্ট, কু-অংক যেন মিলে যাচ্ছে! আমার অংক না মিললে অসুবিধা নেই কিন্তু যারা এই কু-অংক সাজিয়েছেন, তাদের অংক ঠিক আছে তো? তারা কি ভুলে গেছেন, অতীতে ভোটের অংকে জনগণ কখনও ভুল করেনি। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।

অধ্যাপক ড: (ডা:) মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া।
nasimul@salam.uitm.edu.my

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।