ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘হ্যাঁ, আমিই দ্বেষ পত্রিকার সম্পাদক!’

আহ্‌সান কবীর, কান্ট্রি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১১
‘হ্যাঁ, আমিই দ্বেষ পত্রিকার সম্পাদক!’

পশ্চিমবঙ্গের সাময়িকী `দেশ` পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে নিয়ে করা একটি কার্টুন ছিল এরকম: ফিনফিনে পাঞ্জাবি-ধুতিতে ধোপদুরস্ত একজন বাবুসাহেব তার অফিসে টেলিফোনের রিসিভার হাতে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন। অপর প্রান্তের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন: ‘হ্যাঁ, আমিই দ্বেষ পত্রিকার সম্পাদক!’

‌আনন্দবাজার গ্রুপের মালিকানাধীন `দেশ` পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের বিলাতপ্রবাসী বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিরদ চন্দ্র চৌধুরী’র কাণ্ডজ্ঞানহীন হঠকারিতায় লেখা ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ কাণ্ডের পর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় `নিরোড চান্ড্র চাওড্‌রি’কে তুলোধোনা করা হচ্ছিল সবশ্রেণীর মানুষের মন্তব্যে-লেখায়।

ওই সময়ে বাংলাদেশের সিনে ম্যাগাজিন তারকালোকে ছাপা হয়েছিল অসাধারণ জবাবওয়ালা লা-জবাব সেই কার্টুনটি।

বলা বাহুল্য- দাদাদের সীমাহীন বাড়াবাড়ির অকৃত্রিম নিরদীয় ওই নমুনার মস্তকে কাষ্ঠপাদুকাঘাতের মত ছিল কার্টুনটি।

তবে  ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’- বাংলার চিরস্মরণীয় প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণে সর্বদাই ধণুর্ভঙ্গ-পণ কোলকেতে দাদাদের, বিশেষ করে আনন্দবাজা‍রী মহাজনদের, জুড়ি মেলা ভার।

এর সর্বশেষ প্রমাণ, বাংলাসাহিত্যের বর্তমান এবং সর্বকালের জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন হুমায়ূন আহমেদকে তাদের পত্রিকায় শুধু `প্রবন্ধকার` হিসেবে উল্লেখ করার নির্লজ্জ স্পর্ধা আর নাক সিঁটকানো ভাবটা স্পষ্ট। । বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের বাঙালিদের হেয় করতে তাদের চিরকেলে অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই রোববার, ১৩ নভেম্বর দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা `আজকের দিনে` বিভাগে লিখেছে: `১৯৪৮: বাংলাদেশের প্রবন্ধকার হুমায়ুন আহমদের জন্মদিন। ` অর্থাৎ বাংলাসাহিত্যের নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাদের দৃষ্টিতে শুধুমাত্র একজন প্রবন্ধকার! বাস্তবে খোদ পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার বাঙালিদের ‍কাছেও হুমায়ূন আহমেদ একজন ঔপন্যাসিক বা কথা সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত।

আর লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বরাবরের মত হুমায়ূন আহমেদের নামটিও বিকৃত করেছে তারা। সীমান্তের এপারের একটি স্বাধীন দেশের (যেদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন-সহযোগিতা ছিল সবচেয়ে বেশি) জনপ্রিয়তম লেখকের নামের বানানটির প্রতিও তারা সুবিচার করতে হীনম্মন্যতার পরিচয় রেখেছে। ‌`আহমেদ`কে তারা লিখেছে `আহমদ`।

অথচ চরম বৈপরিত্যের বিষয় হচ্ছে: একইসঙ্গে নিজেদের অসার কৌলিন্যের নেংটিতে মাঞ্জা মারা আর বাণিজ্যলক্ষ্মীকে বগলদাবা করার নেশায় এই ‘প্রবন্ধকার` হুমায়ুন আহমদেরই একাধিক হটকেক উপন্যাস তারা ছেপেছে তাদের গ্রুপের পত্রিকার পুজোসংখ্যাসহ বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যায়।

বাংলাদেশের যে কোনও অর্জনকে বাঁকা চোখে দেখা, আমাদের সব পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক আর নেতা-নেত্রীদের বিকৃত নামে অভিহিত করার বেআদপী তো তাদের মজ্জাগত। তারা আমাদের আহমেদকে লেখেন আমেদ, মওদুদকে লেখেন মদুদ। এহেন আচরণ স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানের আওতায়ও পড়ে না। তবু বাংলাদেশের বিখ্যাত আর জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে এসব ছেলেখেলা করার বদ মতলব এদের হাড়ে মজ্জায়। সাধারণ রফিক-শফিক-যদু-মধু’র নাম হলে না হয় মানা যায়, কিন্তু বিখ্যাত আর প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নামের বানান নিয়ে তারা যথেচ্ছাচার করেই চলেছেন। লজ্জার বিষয় হচ্ছে, ওই নামগুলোর বানান কিন্তু বাংলাভাষায় করা। এগুলো তাদের হিব্রু-ল্যাটিন-সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করে পাণ্ডিত্য ফলাতে হয় না।

বাংলাদেশ সফরে  আসা ওপারের লেখক-গায়ক-বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখায়-বক্তৃতায় প্রায়শই বলে থাকেন- বাংলাভাষা আর সাহিত্য-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ পীঠস্থান হবে বাংলাদেশ তথা ঢাকা। তারা কি তাদের দিককার জ্ঞানপাপীদের এ ধরনের অশিষ্ট আচরণগুলো দেখেন না! নাকি তাদের ওইসব কথা আসর জমানো আর লোক দেখানো `ছলনার পাশা খেলা` ছাড়া আর কিছু না!

ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি যাই বলি না কেন--এসব বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বাঙালি-অবাঙালি সব মানুষের ‍কাছেই কলকাতা উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার প্রশংসা করেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি উর্দুর শ্রেষ্ঠ কবি গালিবও এই ইতিহাসসমৃদ্ধ নগরীর দিওয়ানা প্রেমিক বনে গিয়েছিলেন। তিনি কলকাতার রাস্তাঘাট, সুরা-নারীসহ নানান জাঁকজমকের প্রশংসা করে বলেছেন--- অন্য দেশের রাজা হওয়ার চেয়ে কলকাতার পথের ধুলোয় বসে থাকাও বেশি মর্যাদার।

আমি নিজেও ১৯৯৪ সালে একবার কলকাতা গিয়েছিলাম। সঙ্গে রোগী নিয়ে চিকিৎসার ওছিলায় যাওয়া সেই সফরে রাজীব গান্ধীর ভাষায় `মূমূর্ষু` ওই নগরীর অমানবিক অনুষঙ্গ মানুষটানা টাঙ্গা গাড়ি থেকে শুরু করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল- কোনও কিছুতেই তাদের দোষী ভাবার কিছু খুঁজে পাইনি। তবে তখন একটি বিষয়ে খুবই খটকা লেগেছিল। তা হলো বাংলাদেশের বাঙালিদের প্রতি তাদের উষ্মা আর তাচ্ছিল্য ভাব।

এছাড়া আরেকটি বিষয়তো রীতিমত হতবাক করেছে আমাকে। তা হলো পরিচিত-অপরিচিত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কলকাতাবাসীদের ইংরেজিপসন্দ মনোভাব। প্রথম পছন্দ ইংরেজিতে সমস্যা হলে চেষ্টা চলে হিন্দিতে। আর যদি দেখা যায় বিদেশি-স্বদেশি দুই ভাষায়ই উভয় পক্ষে বনিবনা হচ্ছে না- তখন দ্বারস্থ হতে হয় অগতির গতি ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলা বাংলার।

এ সংস্কৃতির চর্চা এমন নয় যে, শুধু অবাঙালিদের সঙ্গেই চলে, ভারতের অন্য রাজ্য থেকে আসা বাঙালি, আধা-বাঙালি এমনকি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালিরাও স্বজাতিদের এহেন ভাষাগত পছন্দের ওই অশিষ্ট খুঁটিতে হোঁচট খেয়েছেন।

ঘটনা আরও আছে। সম্ভবত ১৯৯৮ সালের মার্চের ঘটনা। সেসময়, পত্রিকায় খবর বেরুলো: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতাসীন সিপিআইএম সদস্যরা হিন্দি শেখার কর্মশালা শুরু করেছেন। কলকাতার শ্রমিকভবনে শুরু হওয়া ওই হিন্দি শেখার কর্মশালার উদ্বোধক ছিলেন তখনকার রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। এ বিষয়ে সিপিআইএম এর পক্ষ থেকে মিডিয়াকে জানানো হয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গের হিন্দিভাষী মানুষের মধ্যে দলকে জনপ্রিয় করতে দলের মন্ত্রী থেকে নিয়ে সবাইকে হিন্দি শেখানোর এ উদ্যোগ। উদ্বোধনী দিনের ক্লাসে হাতে-কলমে হিন্দি শিখতে হাজির ছিলেন রাজ্যের বাঘা মন্ত্রীরাও। এছাড়া ছাত্রের তালিকায় ছিলেন ছাত্র-যুব-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও।

এ লেখা যাদের প্রথম থেকেই খারাপ লাগছে--- এপার-ওপার দু’পারের ---তারাই হয়তো বলবেন, বাপু, বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে ম্যাকিয়াভেলিজমের (চাণক্যনীতির) চূড়ান্ত জয়জয়কারের যুগ। ম্যাকিয়াভেলিজম অর্থাৎ চাণক্যনীতির (‘উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সকল কর্মপন্থাই বৈধ’) রমরমা সাফল্যক্ষেত্র। সেখানে কে হিন্দি শিখলো আর কে বাংলা ভুলে গেল তা নিয়ে এত হৈ চৈ করে লাভ কী? আমেরিকানাইজেশনের এ যুগে মূল লক্ষ্য  ধনে-মানে-জনে টিকে থাকা, সেখানে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ কোথায়!

কিন্তু আমরা এপারের `বাঙ্গাল`রা মাত্র তার আগের মাসে পালন করেছিলাম তাদের ভাষা আর আমাদের ভাষা বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার গৌরবমাখা ২১ ফেব্রুয়ারি। আর তার পরের মাসেই ওপারের বাঙালিদের শাসক মহলের অহেতুক হিন্দিপ্রীতির নমুনা দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
যতই আপনারা ভারতীয় আর আমরা বাংলাদেশি হই না কেন, আদপে আমরা তো সবাই বাঙালি। সেই আমাদের অনুভূতির প্রতি কি একটু শ্রদ্ধাও দেখাতে পারেন না আপনারা?

তবে অবাঙালিদের ভোট পেতে বামফ্রন্টের ওই হিন্দিকাণ্ডের ফজিলত কী হয়েছিল তা নিয়ে তেমন বিশ্লেষণে না গিয়ে কেবল এটুকু বলা যায়, ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসনের পর ২০১১ এর নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাদের।

`সিটি অব জয়` খ্যাত এমন সমৃদ্ধ আর দুনিয়ামশহুর নগরীর বুদ্ধিজীবী তথা বিদগ্ধজনদের একটি শ্রেণির নিচু আচরণ আর মানসিকতার কারণে প্রায়ই ক্ষতবিক্ষত হতে হয় এপারের `বাঙ্গাল` তথা বাঙালিদের। কলকাতাইয়া বুদ্ধিজীবীদের সংকীর্ণমনা একটি অংশের ধ্বজাধারী আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমাকে তার `লজ্জা` বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার দিয়েছিল। তার পেছনেও নাকি ছিল অসৎ দুরভিসন্ধি। এ ধারণার সত্যতা পাওয়া যায় তাদের থলের বিড়াল বের করে দেওয়ায় ওই তসলিমাকেই যখন তারা দূর-দূর করা শুরু করলেন। পুরস্কৃত তসলিমাকে তাদের সেই তিরস্কারের ধারাবাহিকতায় চরম অসম্মানজনক লিঙ্গবিদ্বেষী অভিধায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ছাপার অযোগ্য শব্দে অভিহিত করেছেন তারা।

তসলিমার লেখা ক, দ্বিখণ্ডিত আর উতল হাওয়া এ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের ভেতরের নোংরা খড়ের পাখানি উদোম করে দিয়েছে।

তবে দার্শনিক-কবি রবীন্দ্রনাথের ‘আমি যতই বলি চ ছ জ ঝ ঞ, ও কেবলি বলে মিঞ মিঞ মিঞ’ এর মত ওপাড়ের বেড়ালছানারা শত লেখা আর দণ্ডাঘাতেও শোধরাবেন না, এটা ধরে নেওয়া যায়। কারণ বাংলায়ই তা আছে ‍আরেকটি প্রবাদ- `চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। `

এ অবস্থায় ওপারের সাধারণ বাঙালি যারা রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব-মানিক-শক্তি, শামসুর রাহমান-সৈয়দ শামুসল হক-সুনীল-সমরেশ পড়েন আবার পড়েন হুমায়ূনও---তাদেরকে বলছি, দয়া করে এদের শেখান- হুমায়ূন আহমেদ বর্তমান বাংলাভাষার জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক। তার সৃষ্টির মান নিয়ে ভাল-মন্দ তর্ক যা আছে তা থাক, সামনে আরও বাড়ুক- তাতে কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু একটি স্বাধীন ভাষা-জাতি গোষ্ঠীর জনপ্রিয়তম লেখককে আপনারা হেয় করার অধিকার কিছুতেই রাখেন না, এ সত্যটা তাদের তেলতেলে চাঁদির নিচে মগজকোঠায় প্রবিষ্ট করিয়ে দিন।

সহজ কথা তারা আসলেও সহজে বোঝেন না কী না!

বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘণ্টা, ১৩নভেম্বর, ২০১১-১১-১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।