নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক সেঁজুতিকে নিয়ে আমরা লেখালেখি করলাম বেশকিছু দিন। সেঁজুতির বাবা সাংবাদিক শামছুর রহমান খুন হবার পর অসহায় পরিবারটির পাশে অনেকেই দাঁড়ান বিশেষ করে সেঁজুতি-প্রণতি দু’বোনের পড়াশুনার ব্যয় নিষ্কন্টক রাখতে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশেষ হাত বাড়িয়েছিলেন।
শহীদ সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি পাগলা সেলিম সম্প্রতি ভারতে আটক হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগর থানার পুলিশ গত শুক্রবার সকালে তাকে আটক করেছে সল্টলেক এলাকা থেকে। উল্লেখ্য দীর্ঘদিন ধরে পলাতক সেলিম। তাকে দেশের বাইরে পালিয়ে থাকতে দেশের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তিটি সহয়তা দিচ্ছিলেন, তা যশোরের মানুষজন জানে। সরকারেরও তা জানার কথা। যশোরের ঘোপ এলাকায় বাড়ি পাগলা সেলিমের। ওই এলাকার মৃত শামসুদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে সে। কিন্তু যশোরের সবাই জানেন তার মুরব্বিটি আসলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। এক সময় সে তরিকুল ইসলামের দেহরক্ষী ছিল।
উল্লেখ্য খুন হবার আগে শামছুর রহমান তার ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন, তরিকুল ইসলাম তাকে হত্যার চেষ্টা করছেন। তার ডায়েরিটি হত্যা পরিকল্পনার আলামত হিসাবে জব্দ করে সিআইডি। ড শামসুদ্দোহা নামের সিআইডির এক কর্মকর্তা আদালতে জমা চার্জশিটে লিখেন ২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে জনকন্ঠের যশোর অফিসে এক সঙ্গী সহ ঢুকে শামছুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে পাগলা সেলিম। গ্রেফতারকৃত অন্য আসামিদের জবানবন্দীর সূত্রে চার্জশিটে লেখা হয়, তারা একটি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার কথা বলে সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু শামছুর রহমানের অফিসে লোক থাকায় সেখানে ঢোকার আগ পর্যন্ত পার্শবর্তী ইনকিলাব অফিসে তারা অপেক্ষায় থাকে। ইনকিলাবের সাংবাদিক মিজানুর রহমান তোতাকেও মামলায় আসামি করা হয়। তরিকুল ইসলামের দেহরক্ষী হওয়াতে সেলিমকে চিনতেন শামছুর রহমান। রিপোর্টের জন্য যে যখন যেত তাদের সঙ্গে সৌজন্য কথাবার্তা তিনি বলতেন। ঘাতকরা সে সুযোগটাই নেয়।
চাঞ্চল্যকর সেই হত্যাকান্ডের পর ভারতে পালিয়ে যায় পাগলা সেলিম অথবা তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শামছুর রহমানের ডায়েরিতে ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও মামলায় কিন্তু তরিকুল ইসলামকে আসামি করা হয়নি। সিআইডির ড শামসুদ্দোহা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে বোঝান, ভবিষ্যতে সেলিম ধরা পড়লে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে হুকুমের আসামি হিসাবে তরিকুল ইসলামের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হবে সম্পূরক চার্জশিটে। কিন্তু ২০০১ সালের ২৩ জুন দিল্লি পুলিশের হাতে সেখানকার লাল কেল্লা বাঙ্গালি বস্তির ভারত নগর কলোনি থেকে পাগলা সেলিম গ্রেফতার হলে ততক্ষণে বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসে। ফলে ঘটে ভিন্ন এক ঘটনা। ভারত সরকারের হাত থেকে সেলিমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে তাকে আড়াল করা হয় তরিকুল ইসলামের প্রভাবে। যশোর কোতোয়ালি থানা-জেলখানার জীবনে তাকে এমন নিয়ন্ত্রিত রাখা হয় যাতে মিডিয়া বা কেউ তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে না পারে!
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিআইডি বলেছিল, পাগলা সেলিমকে ধরতে পারলে পাকড়াও করা সম্ভব হবে শামছুর রহমান হত্যাকান্ডের নেপথ্যের গডফাদারকে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে করে ভিন্ন কাণ্ড! হত্যা মামলার গ্রেফতারকৃত সব আসামিকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। উল্টো সম্পূরক চার্জশিটের মাধ্যমে ইত্তেফাকের সাংবাদিক ফারাজী আজমল হোসেনকে আসামি করা হয়। মোস্ট ওয়ান্টেড পাগলা সেলিমকেও চুপচাপ জেল থেকে ছাড়িয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে। এরপর তড়িঘড়ি নিজেদের মতো করে বিচার শেষের চেষ্টা দেখে সম্পূরক চার্জশিটে নারাজি দেন মামলার বাদি শামছুর রহমানের স্ত্রী সেলিনা আখতার লাকী। হাইকোর্ট মামলার বিচার স্থগিত করে। ওই অবস্থাতেই হিমাগারে পড়ে আছে শামছুর রহমান হত্যা মামলা।
এবার দ্বিতীয় দফা সেলিমের ভারতে ধরা পড়ার কাহিনীঃ ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেছেন, তারা সেখানকার এক হত্যা মামলায় তাকে ধরেন। এরপর সে স্বীকার করে তার নাম সেলিম, বাংলাদেশের যশোরের অভয়নগর থানার ঘোপে বাড়ি। ভারতীয় পুলিশ বলেছে তাকে তারা নিশ্চিত হয়েই ধরেছে। সে সেখানে নানান অপরাধ করে যাচ্ছিল। তবে গত শনিবার তাকে কোর্টে হাজির করা হয় অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে।
এখন বাংলাদেশ সরকার কী তাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিয়ে এসে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করবে? তার কাছ থেকে কী জানার চেষ্টা হবে কারা তাকে দিয়ে কিসের বিনিময়ে দেশের সেরা একজন সাংবাদিককে হত্যা করিয়েছে?
শামছুর রহমানের ডায়েরিতে নাম থাকলেও এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে তরিকুল ইসলাম সত্যি সত্যি জড়িত কিনা তা কেউ নিশ্চিত নয়। হত্যামামলার গতিপথ পাল্টে দিতে, গ্রেফারকৃত সব আসামিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা, দিল্লি পুলিশের জিম্মা থেকে পাগলা সেলিমকে নিয়ে এসে একশ লুকোছাপা সেই সন্দেহকে গাঢ় করেছে। এখন তরিকুল ইসলাম জড়িত না থাকলে সেটাও প্রমাণ হোক। জড়িত না থাকলে তাকে টেনশনে রাখার বা এই বয়সে তার পোষাক-পরিচ্ছদ নষ্ট করার কী দরকার। এর সবকিছুর জন্য দরকার পাগলা সেলিমের একটি স্বচ্ছ জবানবন্দী। এ উদ্যোগটির জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ চাইছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কারণ শামছুর রহমান হত্যার পর তার দুই এতিম মেয়েকে লালনে তিনিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্লিজ।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৩৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১১