ঢাকা: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ মফস্বল সাংবাদিকদের নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ওই সব লেখা পড়ে মফস্বলের সাংবাদিকতা, তাদের কষ্টসহ নানা দিকি আমাদের সামনে উঠে এসেছে।
বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ শ্রদ্ধেয় আলমগীর হোসেন ভাই জনপ্রিয় এই অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে মুক্ত চিন্তার পরিস্ফূটন ঘটানোর যে সুযোগ করে দিয়েছেন সেই কারণেই আমার মতো একজন নগণ্য সংবাদকর্মী এই লেখাটা লিখতে সাহস পেয়েছে। নিজের একটি অভিজ্ঞতা বাংলানিউজের পাঠকদের সাথে শেযার করার জন্যই এই সাহসটা দেখালাম।
আমরা যারা সংবাদ জগতের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করি তাদের প্রত্যেকেই কিছু স্বপ্ন নিয়ে এই জগতে আসি। এই পেশাতে স্বপ্ন না থাকাটাই সমস্যা। কারণ সাংবাদিকতা নিছক একটা পেশা নয়। অন্য অনেক পেশাতেই এর চেয়ে দ্রুত বৈষয়িক সাফল্য লাভ করা যায়। কোনো সৃষ্টিশীলতার পাশ দিয়ে না গিয়ে অফিসের রুটিন কাজের চাপ বেশি নিয়ে অন্য হাজারটা পেশায় উন্নতি করা যায়। কিন্তু আমরা যারা সংবাদ জগতে কাজ করতে আসি তাদের মধ্যে এক ধরণের স্বপ্ন কাজ করে। কাজ করে নতুন কিছু করার। রাষ্ট্র ও সমাজের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে একটি গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে সাহায্য করার সুযোগ থাকে এক রাজনীতিতে আরেক সাংবাদিকতায়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সংবাদকর্মীরই এই জগতে কাজ শুরু করাটা সুখকর নয়। এটা আমি একরকম নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি। যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা অথবা মফস্বলের একজন মানুষ এই পেশায় আসতে চায় শুরুর দিকে তাদের করতে হয় অনেক সংগ্রাম। যার প্রথমটাই হলো একটি চাকরি খুঁজে পাওয়ার। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে বড় ভাইদের বলে কিংবা নিছক বিনা বেতনে কাজ করে নিজের যোগত্যা প্রমাণ করে একজনকে সংবাদকর্মী হতে হয়। যদিও বর্তমান সময়ে এই দৃশ্য অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবুও আমার এবং আমার পূর্ববর্তী কয়েক প্রজন্মের মানুষের এই ধরণের অভিজ্ঞতা আছে।
আমার অভিজ্ঞতা বলি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার বহু আগেই ইচ্ছা ছিলো সংবাদকর্মী বিশেষ করে একজন রিপোর্টার হিসেবে পেশা জীবন শুরু করবো। সেই মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চলে আসি রাজধানীতে। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সুপারিশের এবং মুখের উপর সত্যি কথা বলায় একটি ইংরেজি পত্রিকায় চাকরির সুযোগ হয়। চাকরি বললে ভুল হবে কাজের সুযোগ পাই। ওই পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ইংরেজি লিখতে পারেন?; আমি বলেছিলাম, ‘না। ’ এই কথায় ওই সম্পাদক খুশি হয়ে আমাকে কিছুদিন কাজ করার একটি সুযোগ দিয়েছিলেন। যদিও ইংরেজি ভীতির কারণে সেই সুযোগ আমি রাখতে পারিনি। এরই মধ্যে আমার এক আমলা আত্মীয় আমাকে জানালেন, তার এক পরিচিত মানুষ আছেন যিনি বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার ‘উপ’ পদধারী ব্যক্তি। যিনি ‘গুপ্ত’ উপাধি ধারণ করেন। তার কাছে গেলে আমার ‘কিছু একটা’ হতে পারে। এখানে বলে রাখি ওই পত্রিকার উপর আমার এক ধরনের ভালোলাগা ছিলো। পত্রিকাটির সাহিত্য সাময়িকীটি আমি দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহ করতাম।
আমার ওই আত্মীয় ‘গুপ্ত’ বাবুর কাছে ফোন করে আমার কথা বললে উনি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বললেন। সময় ঠিক করে গেলাম তার কাছে। কিছু একটা হয়ে যাবে ধরণের আশাও ছিলো মনের ভেতর। গুপ্ত বাবুর অফিসে যাওয়ার পর তিনি একটি সুন্দর হাসি দিয়েই আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, ‘বলুন কি করতে পারি?’ আমি বললাম, ‘আমি রিপোর্টার হতে চাই, যদি আপনি একটু সাহায্য করেন। ’ উনি বললেন, ‘আগে লেখালেখি করেছেন?’ আমি বললাম, ‘রিপোটিং করিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু লিটল ম্যাগাজিনে কাজ করেছি। ’ এরপর উনি বললেন, ‘দেখেন আপনার যে আত্মীয় আমাকে ফোন করেছিলো তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। উনি ফোন করেছে বলেই আপনাকে আসতে বলেছি। নাহলে বলতাম না। আপনার যেহেতু অভিজ্ঞতা নেই কে আপনাকে চাকরি দেবে?’ এরপরে তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনি প্রেসক্লাব চেনেন?’ আমি বললাম, ‘জ্বি। ’ উনি আবার বললেন, ‘ওখানে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেন। সাথে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেও যাবেন। ঘুরতে ঘুরতে কারো সাথে পরিচয় হলে তখন তার মাধ্যমে আপনার চাকির হবে। এর আগে না। ’ তিনি আরো বললেন, ‘আপনার আত্মীয় হয় এমন কোনো মানুষ আছেন যিনি পত্রিকার সম্পাদক?’ আমি বললাম, ‘না। ’ এরপর উনি আবার বললেন, ‘তাহলে বসে থেকে লাভ নেই। যান আপনার চাকরি হবে না। যদি কোনো আত্মীয় সম্পাদক থাকে তবে তাকে বলে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেন। ’
এতকিছুর পরেও আমি আবার বললাম, ‘শিক্ষানবীস হিসেবে যদি একটা ব্যবস্থা করতে পারতেন.....। ’ কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বলে উঠলেন, ‘শিক্ষানবীস মানে কি বোঝেন? আপনাকে কে কাজ শেখাবে? এরপর আমি তাকে আদাব জানিয়ে চলে এলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে আমার ওই আমলা আত্মীয়কে পুরো ঘটনা জানালে তিনি আমার আচরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আমি দুটি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছি। খুব অল্পদিনে অনেক সহৃদয় মানুষের সাথে কাজ করেছি। প্রতিদিনই নতুন অনেক কিছুই শিখছি। তবে ওই গুপ্তবাবুর কথা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না।
সাংবাদিকতায় যারা আসেন তাদের প্রত্যেকের হয়তো না তবে অধিকাংশরই এধরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নতুন অনেক ছেলেমেয়েরাই এই পেশায় আসতে চাচ্ছে। নতুন স্বপ্ন, ভাবনা, আইডিয়া সবকিছুই আছে তাদের। নেই শুধু একটু সহমর্মিতা দেখানোর কেউ। এই স্বপ্নগুলোকে ধরে রাখতে পারলে আখেরে লাভ হবে বাংলাদেশের সংবাদ জগতের। ওই `গুপ্ত`বাবুর মতো লোকজন যতই ‘উপ’ পদে আসীন থাকবেন আমাদের সংবাদ জগতের ততই ক্ষতি হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময় ১৫১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১১