কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা,সংশয় আর অনিশ্চিয়তার ভাব অনেকটা কেটে গেছে। আইনি জটিলতাগুলোও নিরসনের পথে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ধারা সূচনার অগ্রপথিক ড.শামসুল হুদা, ছুহুল হুসাইন ও সাখাওয়াত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত এ নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনকে নিয়ে কিভাবে এগুবেন বা এখানে কতটা সফল হবেন, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও দেখার বিষয়। এ নির্বাচন কমিশন ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, স্বচ্ছ ব্যালট বক্সের ব্যবহার, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, আরপিও সংশোধনসহ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করাসহ কতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠান যেমন জাতীয় সংসদ, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। এ নির্বাচন বোদ্ধামহলে দারুণভাবে প্রসংশিত হয়েছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণার ক্ষেত্রে শুরুতে একধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেলেও কুসিকের দুটি ওয়ার্ডের সীমানা নিয়ে যে ভুল-ভ্রান্তিগুলো ছিলো তা জরুরি ভিত্তিতে নিস্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়ায় জটিলতাগুলো এড়ানো পথ প্রশস্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন যে তরিৎ উদ্যোগ নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সম্পর্ক কখনোই খুব মধুর হয় না, যা কিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনগুলোর সময় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। এতদসত্ত্বেও ভারতে সরকার ও বিরোধীদল উভয় পক্ষই এ সংবেদনশীল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির সন্মান রক্ষায় কখনো পিছপা হয় না। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ঘোষণাদানের পরও নারায়ণগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করা, এমনকি সরকারের অবস্থান পর্যন্ত ব্যাখা না করা কতটা সঙ্গত হয়েছে তা দেখার বিষয়। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির সন্মান রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাকে অনেকেই ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি।
নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে বা করতে পারছে তা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। যদিও কমিশনের দাবি তারা স্বাধীন এবং বর্তমান কমিশনের আমলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সংবিধানের ১২৬ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কাজে সহায়তা করা নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির অভাব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে সংবিধানের ১২৬ ধারা কার্যকর করা প্রয়োজন। এর জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে যথাশিগগির আলোচনা হওয়াও জরুরি। শুধু তাই নয়, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পূর্ণ নির্দলীয় হওয়া সত্ত্বেও দলগুলোর ভূমিকা এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রয়োজনে এ আইনটিরও পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এবার কুমিল্লায় সব ওয়ার্ডেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ ওয়ার্ডে ইভিএম পদ্ধিতে ভোটগ্রহণ হয়েছিলো । ইভিএমে আপত্তি জানিয়ে আসা বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথম দিকে থাকলেও সেনা মোতায়েন না হওয়ার প্রশ্নে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপিকে এ সিদ্ধান্তহীনতা থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। কারণ বিএনপির মতো একটি নির্বাচনমুখী দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা দল ও গণতন্ত্রের জন্য খুবই কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রত্যাখান করার মতো এ পর্যন্ত বলিষ্ঠ কোনো বক্তব্য বা তথ্য-প্রমাণ জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি বিএনপি, এটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে প্রধান দলগুলো তৃণমূলের নেতা কর্মীদের মতামতকে যথার্থভাবে মূল্যায়নে ব্যর্থ হলে কুমিল্লার রাজনীতিতে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। গণমানুষের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে রয়েছে আসন্ন এ নির্বাচন। সকল নেতিবাচক মনোভাব, কৌশলগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং আইনি জটিলতা কাটিয়ে আশু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার গভীর প্রতিক্ষায় কুমিল্লাবাসী। উন্নয়নের পাদপীঠ বলে খ্যাত কুমিল্লার এ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে কৌতুহলী দেশবাসী, পেশাদারিত্বের অঙ্গীকার নিয়ে প্রস্তুত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সকল সাংবাদিকবৃন্দ, পর্যবেক্ষণের নীতিমালা ও কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত মানবাধিকার সংগঠনগুলো, অব্যাহতভাবে চলছে নাগরিক সংলাপ। প্রত্যাশা একটাই- নারায়ণগঞ্জের মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও সন্ত্রাসমুক্ত একটি নির্বাচন।
লেখক: রিসার্চ ফেলো, সেন্ট পলস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা ও নোটারি পাবলিক অব সাস্কাচুয়ান, কানাডা এবং সাবেক সভাপতি,কুমিল্লা প্রেসক্লাব ও কুমিল্লা সাংবাদিক ইউনিয়ন