ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

করিমন, মমতাজ, সায়রা...

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১১
করিমন, মমতাজ, সায়রা...

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুকুন্দপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের পু্নর্মিলনীকে কেন্দ্র করে হঠাৎ প্রচারের আলোয় উঠে এলেন একাত্তরের দুঃসাহসিনী মুক্তিযোদ্ধা সায়রা। বাংলানিউজ ছাড়া অন্য মিডিয়াগুলো কী কারণে বিষয়টি সেভাবে পিক করল না তা বোধগম্য না।

করিমন বিবির পর বিস্মৃতির অতল হাতড়ে হঠাৎ যেন নতুন এক উন্মোচন। সারা দেশে আমাদের এমন আরও অনেক সায়রা আছেন। তাদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করলে জাতির কিছুটা ঋণ শোধের ব্যবস্থা হবে। আজ যেসব কপট দ্বিচারী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের পক্ষ অবস্থান নির্লজ্জ নিয়েছে দেশের মানুষ তাদের দুয়ো দেবে। বিছুটি পাতা হাতে খুঁজবে।

এখন কেমন আছেন করিমন বিবি? অনেকদিন তার খবর জানি না। কেমন আছেন বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম, সালেহাসহ আরও অনেকে? হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের জামায়াতি, মুসলিম লীগার দোসররা বাঙ্গালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর জান বাঁচাতে বানের লাহান মানুষ সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। কসবায় মমতাজ বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেন জেনারেল ওসমানী। নেতারা সব ভারতে পাড়ি দিলেও ওসমানি ওপারে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। তার ধারণা তিনি পয়ষট্টিতে পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাই ভারতীয়রা এখন তাকে পেলে গ্রেপ্তার করে ফেলতে পারে।

ভারতে তাকে সেনাবাহিনীর লোক না এমএনএ পরিচয় দেবার কথা বলে আশ্বস্ত করে মমতাজ বেগম তাকে ওপারে নিয়ে যান। পরে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হন জেনারেল ওসমানি। স্বাধীনতার পর জাসদের রাজনীতিতে জড়িত হন মমতাজ বেগম। জাসদের রাজনীতি ধূসর-পান্ডুর হবার পর উজ্জ্বল অনেকের মতো ধীরে ধীরে তিনিও অবহেলা-বিস্মৃতিতে হারিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধা সালেহা বেগম এখন কোথায়?

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে আমরা প্রয়াত কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, কর্নেল তাহেরের নাম জানি। কিন্তু এই দুটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য যে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সে কাহিনী জানি কী? স্টপ জেনোসাইড ছবির শুটিংয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরছিলেন জহির রায়হান। কোথায় কাকে হাইলাইট করতে হবে না হবে এই মাতব্বরিতে তাকে স্বাধীন কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। তার স্বাধীন কাজ করা ব্যবস্থা করে দেন কাজী নুরুজ্জামান। লুবনা মরিয়মসহ তার মুক্তিযোদ্ধা মেয়েরা এসবের বিস্তারিত জানেন।

ত্রিপুরায় ডা কাজী জাফরউল্লাহর গড়া হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অনেকেও এর মাঝে অকৃতজ্ঞ আমাদের বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন।

মতিয়া চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, কবরী, সুবিদ আলী ভুঁইয়া এখন এমপি। আগরতলার গৌরি বৌদিকে একবার ঢাকায় এনে সম্মানিত করতে তাদের কারোরই কী ইচ্ছে করে না? এই গৌরি বৌদি অথবা গৌরি ভট্টাচার্যের কুমিল্লায় জন্ম। একাত্তরের আগরতলায় মতিয়া চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব থেকে শুরু করে জেনারেল জিয়া, খালেদ মোশাররফ, শাহাদাত চৌধুরী, হারুন হাবীব থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, সামরিক অফিসার, সাংবাদিক যারাই গেছেন তারা সেখানে গৌরি বৌদিসহ অনেকের স্মরণীয় সব ভূমিকা দেখেছেন। আতিথ্য নিয়েছেন। ভারত সরকার তখনও বাংলাদেশের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়নি। সে কারণে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি যাদের বাড়িঘরে প্রবাসী নেতাদের বৈঠক চলত গৌরি ভট্টাচার্যের সরকারি নার্স হিসাবে পাওয়া একতলা টিনের বাড়িটি তখন অনেকের আশ্রয় হয়। তার স্বামী তখন পিটিআইর আগরতলা প্রতিনিধি ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সানী এখনও বেঁচে আছেন, ঢাকায় থাকেন। এই গৌরি ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে সানীকে রাজি করিয়ে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যেতে ঢাকা পাঠান জিয়াউর রহমান। বিপদসংকুল সেই ঢাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে খালেদা জিয়ার কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সানী। কিন্তু খালেদা জিয়া কেন তখন স্বামীর কাছে গেলেন না তা সানীই ভালো বলতে পারবেন।

সুবিদ আলী ভুঁইয়া তখন আর্মির জুনিয়র ক্যাপ্টেন। আগরতলায় তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর প্রসব হবে, কিন্তু সুবিদ আলী ভূঁইয়ার কোনো খোঁজ নেই। তিনি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনে ব্যস্ত। ওই অবস্থায় গৌরী ভট্টাচার্য নিজে অভিভাবক হয়ে মিসেস ভূঁইয়ার সন্তান প্রসবের যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। সারা আগরতলা চষে বেড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শরণার্থী যুবকদের উৎসাহিত করতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। সে কারণে তিনি সেখানেও ছিলেন পরিচিত এক মুখ।

কয়েকদিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এক কাপড়ে আগরতলা গিয়ে পৌঁছেন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সেই সময় তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা মিষ্টি মেয়ে কবরী। পরিচিত চেনাজানা কেউ নেই। তাই সেখানে গিয়ে তিনি আগরতলা চৌমুহনীর একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন। মুহূর্তে বাংলাদেশের শরণার্থী যুবকদের মধ্যে কবরীর আগমনের কথা রটে গেলে সৃষ্টি হয় বিশেষ এক পরিস্থিতির! কবরীকে একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষ হোটেলের চারপাশে ভিড় করে। পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিব্রত হোটেল মালিক ফোন করে কবরীকে তার (গৌরি ভট্টাচার্য) কাছে পৌঁছে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন!

জন্মভূমির সিনেমার নায়িকাকে নিজের বাড়িতে শরণার্থী অতিথি হিসাবে পেয়ে আগে তার স্নানাহার-বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় গৌরি ভট্টাচার্য। নিজের সবচেয়ে ভালো শাড়িটা আলমিরা থেকে বের করে তাকে পরতে দেন। কবরীকে পরে প্রবাসী শিল্পী দলের সঙ্গে বংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলানিউজে সায়রা কাহিনী পড়ে গৌরি ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়ল খুব। এমন আরও অনেক অঙ্গাঙ্গী চরিত্র আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। আমরা হয় তাদের কথা জানি না অথবা অকৃতজ্ঞ, ভুলে গেছি।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১১

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।