ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বার্ষিক ছবিটা এবারও মিস!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১১
বার্ষিক ছবিটা এবারও মিস!

দেশের মানুষ এবং মিডিয়ার ভাগ্যে এতদিন শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া দুই নেত্রীর যুগলবন্দি একটা ছবির সৃষ্টি হতো বছরে একবার! তা ২১ নভেম্বর, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে সেনাকুঞ্জের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে! সারা বছর ধরে আমাদের জাতীয় এই দুই নেত্রীর মধ্যে যতই কাইজ্যা চলুক না কেন, বছরের এই একদিন তারা সেখানে দু’জনের মুখোমুখি, পরস্পরের কুশল বিনিময় করতেন। কিন্তু বার্ষিক এই ছবিটি গত বছর থেকে হঠাৎ করেই মিস হতে শুরু করল! সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের রাগেদূঃখে অপমানে বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া গত বছর প্রথম গেলেন না সেনাকুঞ্জের সম্বর্ধনায়! এবারে গেলেন না আগের বছরের সেই পুরনো রাগের পাশাপাশি ঠিকমতো দাওয়াত না দেবার কথা বলে!

অথচ আমাদের এসব নেতানেত্রীরা সারাদিন যে কথাটি ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বেশি বলেন, তাহল আমাদের ঐক্যের প্রতীক সেনাবাহিনী! আমাদের নেতানেত্রীদের মুখের কথায় আগে পার্লামেন্ট ছিল সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু! সেটি এখনও সরকারে গেলে আছে, বিরোধীদলে গেলে নেই।

যে যখন নির্বাচনে হেরে যান ভোটার পাবলিককে শাস্তি দিতে, তাদের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা, বিদেশ ট্যুর এসবের সবকিছু ষোলআনা উসুল-উপভোগ করলেও নানা বাহানায় সংসদে যান না। নব্বুই দিনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি মাথায় রেখে বেতন-ভাতার বিষয়টি নিষ্কন্টক-নির্বিঘ্ন রাখতে কোন প্রকারের আরেকটি বাহানা সাজিয়ে মাঝে এক-দু’দিনের জন্যে যান! সংবিধান, বিচার বিভাগ এসব নিয়েও পরতায় না মিললে একেকজন যা খুশি বলেন! বাকি ছিল সেনাবাহিনী! ওটা এখন শুধু বিরোধীদল নির্বাচনে চায়! সরকারি দল চায় না। সশস্ত্রবাহিনী বা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এর প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দিবসটিও সবার কাছে এখন আর সার্বজনীন না!

অনেকে বলতে পারেন, বছরে একবার দুইনেত্রীর এমন একটি ছবি হলো না, এতে সমস্যার কী? অথবা এটিইতো দেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা না। কথাটি অসত্য না। কিন্তু এটা পাবলিক চায় বলেইত এখনওতো এক নেত্রী আরেক নেত্রীকে রোজায় ইফতার পার্টির দাওয়াত দেন, একজন আরেকজনের ইফতারে যে যাবেন না তা দেশের আবুলরাও জানে। ঈদ-নববর্ষে একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কার্ড পাঠান। এসব ইফতার পার্টির আয়োজন অথবা শুভেচ্ছা কার্ড ছাপতে অবশ্য তাদের কারো গাঁটের টাকা খরচ হয় না। কারণ সংসদনেত্রী ও বিরোধীদলের নেত্রীর এসব আপ্যায়ন-সামাজিক আচারাদির খরচ বহন করে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে তারা এভাবে জনগণকে আবুল বা বোকা-হাবা ভাবা, অথবা বোকা সাজানোর চেষ্টা করে যান হরদম।

দুই নেত্রীর ঐক্য চিন্তা অথবা কাইজ্যার বিষয়টি অবশ্য আজকের নতুন না। সেই এরশাদ জমানা থেকেই এটি যেন চলমান-বহমান এক নদী! স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আটদল, সাতদল, পাঁচদলের যুগপৎ আন্দোলন চলছিল। কিন্তু তখনও মাঝে মাঝে লেগে যেত এই দুইনেত্রী অথবা প্রধান দুটি দলের। তা দেখে আনন্দ বাড়ত স্বৈরাচারীর! তা দিত গোঁফে। তখন রেফারির ভূমিকা নিত হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননদের পাঁচদল। অথবা দেশের সুশীল সমাজ। ফয়েজ আহমদ সহ সেই পাঁচ বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কথা অনেকের নিশ্চয় মনে আছে। কারণ সবাই জানতেন এই নেত্রী বা প্রধান দুটি দলের ঐক্য ছাড়া স্বৈরাচারের পতন সম্ভব না।
 
অতএব দুইনেত্রীর ঐক্য তথা একান্ত বৈঠক, অন্তত ঐক্যের প্রতীক একটি যুগলবন্দি ছবি সৃষ্টিতে অনেকের উদ্যোগের সঙ্গে হাত মেলান শেখ হাসিনার অধুনা প্রয়াত বিজ্ঞানী স্বামী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া। যে কোনও কারনণ খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তার একটি ভদ্রলোকি ভালো সম্পর্ক ছিল। অতপর দুই নেত্রীর এমন একটি প্রথম বৈঠক-গ্রুপ ছবিটি হয় ড. ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালীর সরকারি বাসায়। এরপর খালেদা জিয়ার বড়বোন খুরশিদ জাহান হক ওরফে `চকলেট আপা`র বাসায় এমন আরেকটি ফিরতি বৈঠক হয়। পরপর ওই দুটি বৈঠক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কী প্রচন্ড শক্তি এনেছিল তা অনেকে এখনও মনে করতে পারেন। এরপর সে ঐক্য ভাঙ্গতেও সময় লাগেনি। ঐক্য ভেঙ্গে গেলে দীর্ঘায়িত হয় স্বৈরশাসন। আবার তারা ঐক্যবদ্ধ হলে পতন ত্বরান্বিত হয় স্বৈরাচারীর!
 
কিন্তু দুই নেত্রীর ঐক্যের স্থায়ী সমস্যা দেখা দেয় ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর। কারণ সেই নির্বাচনে জয়পরাজয়ের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন পূর্ববর্তী সময়ের উভয়ের লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ডটি ভেঙ্গে যায়। নির্বাচনে একদল জিতবে একদল হারবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের স্বপ্নের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এর কোন নির্বাচনেই বিজিত দল পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানায়নি। উল্টো প্রতিবার বিজিতরা কারচুপির অভিযোগ করে ভোটার জনগণকে অপমান করেছে। অতপর এক পর্যায়ে কখনও শেখ হাসিনা কখনও খালেদা জিয়া বিরোধীদলের নেত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ভোগ শুরু করলেও নানান অজুহাতে সংসদে কাজে অংশগ্রহণের গরজ-আগ্রহ দেখাননি। এভাবেই খুঁড়িয়ে চলছে কুড়ি বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশ স্টাইলের সংসদীয় গণতন্ত্র!

সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদীয় কার্যক্রমে সরকার ও বিরোধীদলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নানা ইস্যুতে আলোচনা, অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ সংসদনেত্রী-বিরোধীদলের নেত্রীর অথবা তাদের প্রতিনিধির। অস্ট্রেলিয়ার বিরোধীদলের নেতা টনি অ্যাবোট এখন জনমত জরিপগুলোতে প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের চেয়ে জনপ্রিয়। নানা ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিন সংসদের ভিতরে-বাইরে জুলিয়া-টনি একজন আরেকজনকে তুলোধুনো করেন। কিন্তু সামনাসামনি হাই-হ্যালোর সম্পর্ক ছাড়াও জাতীয় নানা ইস্যুতে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলেন। সবশেষ রানী এলিজাবেথ অথবা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সফরেও সরকারি  সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন টনি। পার্লামেন্টে রানীর সম্বর্ধনার মঞ্চে জুলিয়ার পিছনের আসনে বসেছেন। আইন-কনভেনশন অনুসারে যার যেখানে আসন! কিন্তু আমাদের এই দুই চরিত্রের মধ্যে তো ন্যূনতম সামাজিক মেলামশা বা মুখ দেখাদেখির সম্পর্কও নেই! এভাবে কী কোনও এটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চলে বা চলতে পারে? বাংলাদেশের আরও অনেক কিছুর মতো আল্লাহই যেন দেশটায় এখনও সংসদ, সংসদীয় গণতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছেন!

 ১৯৯১তে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা খালেদা জিয়া সংবিধানে নেই বলে প্রস্তাবিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নেন। তখন তিনি `পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ না` এই ঘোষণা দেন। এরপর সরকার-বিরোধীদল মুখোমুখি ও পরস্পরের বিরুদ্ধে মারমুখি অবস্থানে চলে চলে  অস্ট্রেলিয়া থেকে তৎকালীন কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার নিনিয়ান উড়ে আসে দূদতয়ালির জন্য। কিন্তু তিনিও কোনও সুবিধা করতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার সমাজে বিশেষ একজন স্কলার, সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত স্যোর স্টিফেন নিনিয়ান অত:পর দূতিয়ালিতে একপ্রকার পরাজয় স্বীকার করেই নিজের মান নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যান।

এখন আবার লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের `পক্ষপাতদুষ্টতার অভিজ্ঞতার` কথা মাথায় রেখে আদালত আর সংবিধানের কথা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চাইছেন না শেখ হাসিনা। লতিফুর রহমানের শপথ গ্রহণের পর সেখান থেকে বেরিয়ে বাসায় পৌঁছবার আগেই তেরজন সচিবকে বদলি করা সহ পুরো প্রশাসনকে বদলে ফেলার খবর পান শেখ হাসিনা। যে অভিজ্ঞতায় খালেদা জিয়াও গতবার নিজস্ব পছন্দের বিচারপতি কে এম হাসান অথবা অনুগত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছেন! আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের ভয় এবার তত্ত্বাবধায়কের আদলে তেমন আরেকজন লতিফুর রহমান বসার সুযোগ পেলে শুধু প্রশাসন বদল না, সে রাতের মধ্যে আটক যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেবে! এরপর আবার এটি পাকিস্তান হয়ে গেছে মনে করে তারা ঘাড় মটকাতে নামবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের!
 
রাজনৈতিক সংকটে জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক সব দেশ-সংস্থার মূল ফর্মূলাটি হলো আলোচনা করা। সবশেষ এখানকার অবস্থা সরেজমিন দেখে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। আর ঢাকা ছাড়ার আগে আলোচনার তারবার্তাটি আগাম রেখে গেছেন। এখন দেশের পরিস্থিতি আগামী দিনগুলোতে যত উত্তপ্ত হবে, আলোচনার বার্তাও ততই বারবার করে নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন থেকে আসতে শুরু করবে। কিন্তু বাংলাদেশের চলতি রাজনৈতিক সমীকরণটি যারা জানেন তারা জানেন তা এখন কত কঠিন আর স্পর্শকাতর অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।

এরশাদ জমানায় দুই নেত্রীর আলোচনার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী অথবা তারেক-কোকোর দুর্নীতির ইস্যু ছিল না। এরশাদের মতো দুর্নীতিবাজ দ্বিতীয় কেউ তখন ছিল না বঙ্গধামে! বা এক্ষেত্রে নিজের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী গড়ে উঠতে দেননি এরশাদ! জনতা টাওয়ার মামলায় কারওয়ানবাজারের সরকারি জমি স্ত্রী রওশনকে বেআইনিভাবে দেওয়াতে রাষ্ট্রের ৪/৫ কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে সু্প্রিমকোর্ট এরশাদকে দুর্নীতিবাজ ঘোষণা করে।

 এরপর পাঁচবছর নির্বাচন করতে পারেননি এরশাদ। কিন্তু পরবর্তী গণতান্ত্রিক জমানায় যেখানে যত দুর্নীতি ধরা পড়েছে সেখানে এরশাদতো হয়ে গেছেন দুধের শিশু! শুধু সিঙ্গাপুরের ব্যাংকেই কত টাকা ধরা পড়েছে তারেক-কোকোর?

 আগামীতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংলাপেতো বিএনপি এসবকে শর্ত করবে। শর্তটি হতে পারে সরকার আর এসব মামলা নিয়ে এগুবে না অথবা ঢিলে দেবে! অথবা বিএনপির আরেকটি শর্ত হতে পারে আটক যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির! অথবা এদের বিষয়গুলো নিয়ে আগামী নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গেও দরকষাকষিতে যেতে চাইতে পারে আওয়ামী লীগের কোনও একটি অংশ! এখন আমরা যারা শান্তির স্বার্থে সংলাপের পক্ষে, এ দুটি ইস্যুতে কোনও ছাড় মেনে নেয়া সম্ভব কী? না, তা কি মানবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এবং নতুন প্রজন্ম? এসব নিয়ে আগামী দিনগুলোতে উত্তপ্ত হবে দেশ। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে এখনই তা বলা মুশকিল।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।  

বাংলাদেশ সময় ১৩৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।