‘নান্দিনা’ শব্দের অর্থ আমি জানি না। কোনোদিন অভিধানে বা নামকরণ গ্রন্থেও শব্দার্থ খুঁজতে চেষ্টা করি নি।
ঘুরতে ঘুরতে উড়তে উড়তে জীবনঘুড়ি আজ বিদেশি আকাশে। কিন্তু ঘুড়ির নাটাইটা এখনো যেনো নান্দিনা মহারাণী হেমন্ত কুমারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আটকে আছে। জীবনের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বিশ্বের বহু দেশ, পৃথিবী বহু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে নান্দিনাকেই আমার তীর্থস্থান মনে হয়েছে। হ্যাঁ, তীর্থস্থান তো বটেই। মসজিদ, মন্দির, গির্জা যেমন পরম পবিত্র স্থান, প্রার্থনার স্থান; তেমনি বিদ্যাপাঠের স্থানগুলোও আমার কাছে পবিত্র স্থান।
ব্রহ্মপুত্র একটি নদের নাম। পৃথিবীর বুকে বৃহৎ যে কটি নদ-নদী রয়েছে তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ অন্যতম। ২ হাজার ৯০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের উৎপত্তি নাম ইয়াং সুং সাংপো। হিমালয় পর্বতের তিব্বতের অংশে কৈলাশ টিলার মানস সরোবরের নিকট চেমাই যাং ডুং হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত পর্যন্ত এ নদের ৫ বার নাম পরিবর্তন হয়েছে (ইয়াং সুং সাংপো, জিমা ইয়াং জং, ডিহং, খেরকুটিয়া প্রভৃতি)। এরপর আসাম প্রদেশের ডিব্রুগড় ও লক্ষ্মীপুরের মাঝামাঝি এসে নদটি দু’টি চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে একটি উত্তরাঞ্চলের খেরকুটিয়া চ্যানেল এবং অপরটি দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে। এবং তা গাড়ো পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে ৭২৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
জানা যায়, ২০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে এক ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদ ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি শাখা যমুনা নাম ধারণ করে ২৭৭ কিলোমিটার অতিক্রম করে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে ২০৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। অপর শাখাটি বাহাদুরাবাদ ঘাটের উজানে হরিণ ধরা নামক স্থান থেকে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ নামে জামালপুর-ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনার সঙ্গে একত্রিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। *১
সেই বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী নান্দিনা মহারাণী হেমন্ত কুমারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। আর ব্রহ্মপুত্রের ওপারে চরাঞ্চলে ‘চর খার চর’ আমার গ্রামে বাড়ি। ১৯৭১-এ একদিকে সদ্য স্বাধীন দেশ। অন্য দিকে নতুন জীবন গড়ার প্রস্তুতি। তাই প্রতিদিন ঝড়-বৃষ্টি, বর্ষা-বন্যা, তীব্র তাপদাহ, প্রকৃতিক দুর্যোগ অতিক্রম করে সেই কৈশোরে দীর্ঘ সাড়ে তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে আসতাম। বর্ষাকালে নৌকা আর বর্ষার আগে ও পরে কাদা পানি ভেঙে স্কুলে যেতাম। কখনো ভেজা কাপড় পাল্টিয়ে, ব্যাগ থেকে সেন্ডেল বের করে পায়ে দিয়ে ‘বাবু সেজে’ স্কুলে ঢুকতাম। নান্দিনা বাজার পেরিয়ে প্রবেশ করতাম স্কুলে। দীর্ঘ পথের দু’ধারে সারি সারি বকুল ফুলের বাগান। পথে বিছানো ঝরা বকুলের পাঁপড়ি। যেনো ফুলপরীরা আকাশের তারাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে মাটিতে। চারিদিকে মৌ মৌ করা সৌরভ। বা দিকে খোলা মাঠের হু হু করা রোদেলা বাতাস। সেই মৃদু বাতাসে মেশানো বকুল ফুলের বিভোর করা ঘ্রাণ- যা কৈশোরে নেশা জাগিয়েছে। তাই আজো হৃদয়ে গেঁথে আছে নান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্মৃতি, চিরদিন মনে গেঁথে থাকবে মহারানী হেমন্ত কুমারীর কথা!
পথের তারা-ফুল কুড়িয়ে মালা তৈরি অথবা বরুইয়ের মতো ছোট ছোট হুলদে বকুল ফল গাছ থেকে পেরে বন্ধুরা মিলে খাওয়া, সেই দিনগুলো সত্যি যেন সত্যজিৎ কিংবা মৃণালের ছবির মতো। এ নিয়ে ‘নান্দিনা’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলামঃ
‘ব্রক্ষপুত্র নদের নেশা আমার গায়ের রক্তের ভেতর/ টগবগিয়ে স্মৃতির স্রোতে ঢেউ খেলে যায়-/ জোছনা মেঘ আর রোদের ছায়ায় শান্ত শীতল/ বকুলতলার দিনগুলি সেই মিশে আছে সেই বয়সের/ দুষ্টুমি আর হলুদ পাখি পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা/ লাজুক চোখের ঝলমলানি নাম না জানা নম্র পাখি/ এই ১৯৮৫ তে সেই পাখিটি কোথায় আছে?
ইস্টিশনে বৃষ্টি ভেজা গার্লস স্কুলের সেই মেয়েটি/ কোথায় আছে? অচিন গাঁয়ে বউ সেজেছে-/ সংসারে তার হয়তো এখন সুখের অভাব/ নিশিরাতে একলা কাঁদে, স্বামী রেখে পাশ ফিরে শোয়/ তবু পুরুষ ঘামে কামে তার বাহুতে নাকটি ঘসে।
ফলাফল আর খেলাধুলা শিক্ষা সুনাম সবকিছুতেই/ যার ছিল খুব ঐতিহ্য নাম- নান্দিনা সেই/ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্মৃতিগুলো তন্ময়তায়/ অবসরে ঘোরের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠে ঠিক যেন এক সত্যজিতের পুরস্কৃত চলচ্চিত্র।
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’- যে/ যারা ছিল সাত বছরের সহপাঠী সেই সাথীরা/ আজমত লেবু হেলাল মতিন মজনু রমিজ কোথায় তারা?/ হারিয়ে গেছি নিজের কাছে; এই শহরে সুখেই আছি/ মাঝে মধ্যে তবু তাদের সমবেত স্মৃতিগুলো-/ হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠে মৃণাল সেনের ছবির মতো’। *৩
যাহোক, সেই বকুলতলা পেরিয়ে শুভ্র সকালে সারা গায়ে ফুলের ঘ্রাণের পবিত্রতা মেখে যেন পাঠ্য প্রার্থনায় ঢুকতাম। স্কুলে ঢুকলেই সামনে বিশাল শান্ত পুকুর, সান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাড়ে নাম জানা আর অজানা ফুলের গাছ। পুকুরের এক পাড়ে দীর্ঘ ছাত্রাবাস। আর অন্য পাড়ে দেয়াল। সেই দেয়ালের পাশ ঘেষে ইট বিছানো রাস্তা। ইউনিফর্ম পরা গালর্স স্কুলের ছাত্রীদের যাতায়াত। তার দক্ষিণে অদূরেই রেল স্টেশন। সিগনালের উঠানামায় ট্রেনের ছোটাছুটি। লাল রঙের মালট্রেনের বিশ্রাম।
স্কুলের শান্ত পুকুরের পাড় ঘেঁষে ইট বিছানো রাস্তা। পাশে মসজিদ, টিফিন ঘর, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, শহীদ মিনার, হেড স্যার বঙ্কিম বাবুর কক্ষ, স্যারদের কমনরুম। সামনে সাজানো ছবির মতো অপূর্ব বাগান। স্কুল বাউন্ডডারির ভেতর আলাদা মাঠ। বিশাল স্কুলের প্রতিটি ক্লাশে এবিসিডি সেকশন। প্রত্যেক সেকশনে ৩০/৪০ করে ছাত্র। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার ছাত্র। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশাল ঐতিহ্যবাহী স্কুলের বর্ণনা স্বল্প আকারে দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
বিশালত্ব, কৃতিত্ব, পড়াশোনা, খেলাধুলা, ফলাফল, সুনাম সুখ্যাতি সব দিক দিয়েই নান্দিনা মহারাণী হেমন্ত কুমারী পাইলট হাইস্কুলের গৌরবের জুড়ি ছিলোনা।
এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে আজো নিজেকে ভীষণ গর্বিত মনে করি। প্রায় বিনা বেতনে পড়া। চার/পাঁচ টাকা বেতন। দুই ভাই পড়লে একজনের হাফ-ফ্রি, তিন জন পড়লে একজনের ফুল-ফ্রি! ক্লাশ শুরু হবার আগে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে ‘পাক সার জমিন’ কবর দিয়ে সমবেত সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া। টিফিনের বেল বাজলেই প্রতিদিন স্কুল থেকে লুচি, ভাজি, হালুয়া, রুটি, মিহিদানা, সিঙ্গাড়া, সমুচা টিফিন সরবরাহ। ক্লাশ-কেপ্টিনের মাতাব্বরি। কতো না অম্ল-মধুর স্মৃতি!
আমি ছাত্র হিসেবে খুবই সাধারণ ছাত্র ছিলাম। কিন্তু হেড স্যার বঙ্কিম বিহারী রাউথ থেকে শুরু করে নাট্যকার-অভিনেতা এম এস হুদার খুবই স্নেহভাজন ও প্রিয়পাত্র ছিলাম। তাঁরা শুধু আমার কিংবা তিন সহোদর নোমান-শফিক-শিহাবের শিক্ষক ছিলেন না; শিক্ষক ছিলেন আমার বাবারও। নানা কারণে তাঁদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ঢাকায় চলে আসার পর সেই মধুর সম্পর্ক স্মৃতি হয়ে পড়ে।
বঙ্কিম স্যারের ছোট ছেলে লেবু অর্থাৎ চম্পক বিহারী রাউথ আমার সহপাঠি। স্কুল কলেজ পেরুনোর পর লেবুরা ভর্তি হলো মোমেনশাহী অর্থাৎ মৈমনসিং-এর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর আমি গ্রাম ছেড়ে মফস্বল অতিক্রম করে রাজধানীতে পা দিলাম ‘নাগরিক’ আর ‘কবি’ হবার স্বপ্ন নিয়ে। একদিন সেই নগর, সেই প্রিয় শহর ছেড়ে আটলান্টিকা পাড়ি দিয়ে দূর প্রবাসে আটকে গেলাম। বেছে নিলাম এ আরেক অজানা জীবন। তেরো হাজার মাইল দূরে এসেও ভুলতে পারিনি নান্দনিক নন্দিত নান্দিনার কথা। অথচ জীবনের কত কিছুই ভুলে গেছি, মন থেকে কত স্মৃতি মুছে বিস্মৃতি হয়েছে। অথচ আমার কৈশোর, আমার স্কুল জীবন, আমার স্কুলের দিনগুলো আজো নীল নক্ষত্রের জ্বলজ্বল করছে।
এতো দূর এসে এতকাল পর পেয়ে গেলাম প্রিয় পুরনো বন্ধু চম্পক বিহারী রাউথ লেবুকে। সে আরেক চমক। কানাডার রাজধানী অটোয়া থেকে এসে টরন্টোর সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টারে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছি। সেই নিউজ দেখে শুভেচ্ছার ঢালি নিয়ে হাজির হলো লেবু। শুধু লেবুই নয়; নান্দিনা স্কুলের অনেক পুরনো ছাত্র খুঁজে বের করলেন আমাকে। স্থানীয় আরবিসি ব্যাঙ্কের উপদেষ্টা আবদুল মতিনের আহ্বানে আমরা একদিন একত্রিত হলাম টিম হার্টনে, আরেকদিন কফি টাইমে ।
সেই খবর স্থান পেলো স্থানীয় পত্র-পত্রিকায়। যার শিরোনাম ছিলো- ‘সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়েও ভুলতে পারেনি শেকড়ের কথা’। কানাডাস্থ জামালপুর নান্দিনা মহারানী হেমন্ত কুমারী পাইলট হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র (চম্পক বিহারী রাউথ, মোহাম্মদ আবদুল মতিন, আমিনুল হক, লুৎফর রহমান, বজলুর রহমান, আবদুর রশিদ প্রমুখ)এবং এলাকাবাসী গত ৯ মে রোববার জেরাড এবং ভিক্টোরিয়া রোডস্থ কফি টাইমে এক জমজমাট আড্ডাসর বসে। জামালপুরস্থ নান্দিনা মহারানী হেমন্ত কুমারী পাইলট হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং এলাকাবাসী উক্ত ছুটির সকালে সমেবেত হয়। তারা নান্দিনার ঐতিহ্য, অহংকার নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। আজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে কানাডায় এসেই কেউ ভুলতে পারে নি শৈশব নান্দিনার কৈশোরের কথা, শেকড়ের কথা, মাতৃভূমির কথা!*৩
আমরা সেদিন চা খেতে খেতে, আড্ডা দিতে দিতে, স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রত্যেকেই ফিরে গিয়েছিলাম- কৈশোরের স্মৃতি জড়ানো স্কুলে; যে স্কুলের নাম নান্দিনা।
তথ্যসুত্রঃ
১। নদের নাম ব্রহ্মপুত্র/ আনিছুর রহমান মিয়াজী, দৈনিক সংবাদ, নভেম্বর ২১, ২০১১, ঢাকা।
২। কবিতাসমগ্র/ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, প্রকাশকঃ অনন্যা, প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, ঢাকা। পৃষ্টা-১০৬।
৩। অনলাইন সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস, মে ১৩, ২০১০, টরন্টো, কানাডা।
বাংলাদেশ সময় ০৯৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১১