বিলাতের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ানের পুরস্কার জিতেছে বাংলাদেশের এক নার্গিসের জীবনের গল্প নিয়ে লেখা রিপোর্ট। দ্য গার্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম ২০১১’র অধীনে ‘রাইট টু দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের প্রতিযোগিতায় কিরন ফ্লাইনের পুরস্কার জেতা রিপোর্টের শিরোনাম ‘দ্য রাইট টু সে নো’।
পুতুল খেলার বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় নার্গিসের। ১৪ বছর বয়সে সে প্রথম গর্ভবতী হয়। কিন্তু তার প্রথম সন্তানটি বাঁচেনি। জন্মের ১৬ দিনের মাথায় মারা যায়।
রিপোর্টে বলা হয়, নার্গিসের কাহিনী বাংলাদেশের একার নয়। দেশটিতে বাল্যবিবাহ তথা অপ্রাপ্ত বয়স্ক বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা তথা গ্রামাঞ্চলের গরিব ঘরের মেয়েরা হরদম এর শিকার হচ্ছে। নার্গিস পৃথিবীর দশ মিলিয়ন মেয়ের একজন যারা অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের শিকার হচ্ছে প্রতিবছর।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশে সম্পাদিত বিয়ের ৬৬ শতাংশ কোনও না কোনওভাবে অপ্রাপ্ত অথবা বাল্যবিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের এ ধরনের বিয়ের হার সর্বোচ্চ এবং তা দুনিয়ার মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ।
নার্গিসের পারিবারিক পরিচয় গোপন রাখা হয় রিপোর্টে। তার পরিবারের সদস্যরা রিপোর্টারকে বলেন, মেয়ে বড় হয়ে গেলে পরপুরুষ ছেলেদের নজর পড়ে, বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। তাই তারা তাড়াতাড়ি বিয়ের পক্ষে। নার্গিসকেও সে কারণে আগে বিয়ে দেয়া হয়েছে। রিপোর্টারের সঙ্গে প্রথমে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন নার্গিস। স্বাভাবিক হবার পর বলেন, বাল্য বিয়ে একটি অভিশাপ। এমন যাতে আর কারও জীবনে কখনো না হয়। কারণ, ১২ বছর বয়সে যেমন বিয়ে কী সংসার কী বোঝার জ্ঞান হয় না, তেমনি তার জীবনেও তা হয়েছে। মারা গেছে তার প্রথম সন্তান। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের হচ্ছে বন্ধ হয়ে গেছে তার পড়াশুনা।
কিরন তার রিপোর্টে লিখেছেন, এমন বাল্য বিয়ের কারণে যে অসময়ে একজনের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়, জাতিসংঘের সংজ্ঞায় এটি মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে। অথচ বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। অভিশপ্ত বাল্যবিয়ের কারণে প্রতি বছর এমন শিকার মেয়েদের পড়াশুনার পাট চুকে যাচ্ছে।
রিপোর্টে লেখা হয়েছে, নার্গিসের আবার স্কুলে ফেরার ইচ্ছা ছিল। পারেনি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে মনে করা হয়, বিবাহিত মেয়ের কাজ বাচ্চা লালনপালন করা, সংসার দেখা। সংসারের কাজের পিছনে এরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যায়। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর।
শেরপুরের একজন সরকারি কর্মকর্তা দেবাশিস নাগ রিপোর্টারকে বলেছেন, আইনের ত্রুটির কারণেও বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। এমন বিয়ের আগে যদি খবর পাওয়া যায় তাহলে তা হয়তো আটকানো যায়। অন্তত চেষ্টা করা যায়। কিন্তু এমন বিয়ে হয়ে গেলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে বা মেয়েকে আলাদা করার সুনির্দিষ্ট আইনই নেই।
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের প্রথম দিকে নতুন একটি নারীনীতির প্রস্তাব করলে ধর্মীয় মৌলবাদীদের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ আসে। প্রস্তাবিত নতুন এই নারীনীতিতে নারীর সঙ্গে বৈষম্যের অনেক কিছুর সঙ্গে বাল্যবিবাহ বন্ধে কড়াকড়ি আইনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণীর ধর্মীয় চিন্তাবিদ এর বিরোধিতা করে বলেন, এটি ইসলামবিরোধী। রুনিয়া মওলা নামের একজন এনজিও সংগঠক বলেন, দেশের এক শ্রেণীর মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসও বাল্যবিয়ে রোধের অন্যতম অন্তরায়।
কিরন ফ্লাইন তার রিপোর্টে উল্লেখ করে বলেন, শুধু বাংলাদেশে না, বিলাতেও মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। মাইগ্রেশনসহ নানা কারণে ফোর্সড ম্যারেজের শিকার হচ্ছে বিলাতের মতো দেশের অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ে।
ফজলুল বারী : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, ২৩ নভেম্বর, ২০১১