আগরতলা (ত্রিপুরা): গৌরি ভট্টাচার্য বা গৌরি বৌদি এ নামেই বাংলাদেশের অনেকে চেনেন তাঁকে। কিন্তু তাঁর ভালো নাম বা আসল নাম এটা নয়।
সুনন্দা বা গৌরি যে নামেই তাঁকে চেনা যাক না কেন, তিনি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের অত্যন্ত আদরের এবং শ্রদ্ধার গৌরি বৌদি। এই গৌরি বৌদির এখন বয়স ৭৩। জন্ম ১৯৩৮ সালের ৮ জুলাই।
বয়সের ভাড়ে স্মৃতিতে অনেক ধুলো জমেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের আনেক ঘটনাই এখনও অমলিন তাঁর বুকে। ৭১’র সে সব রক্তঝরা দিনের কথা বলা শুরু করলে আর থামতেই চান না।
হাজারিবাগে মামার বাড়িতে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজার কর্মচারী। পড়াশুনা আগরতলাতেই। পড়া শেষে ১৯৬০ সালে যোগ দেন ত্রিপুরায় নার্সের চাকরিতে। ৬৩’তে বিয়ে করলেন অনিল ভট্টাচার্যকে। স্বামী ছিলেন রাজ্যের বিশিষ্ট সংবাদিক।
আগরতলার তাঁর বাড়িতে বসেই কথা হচ্ছিল। গৌরি ভট্টাচার্য বললেন তাঁর সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগের কথা। ১৯৭১ পর্যন্ত কোন দিন সেখানে যান নি। তবে সে দেশের কথা শুনেছেন বিভিন্ন জনের কাছে। ১৯৭১’র ২৫ মার্চ যে দিন যুদ্ধ শুরু হয়, তাঁর দু দিন পরে তাদের বাড়িতে আসেন কলকাতার দু জন সাংবাদিক। এরা বাংলাদেশের যুদ্ধ কভার করতে এসেছিলেন। এদের একজন অমৃতবাজারের সাংবাদিক দীপক ব্যানার্জী, অন্যজন তাঁর সাথে আসা সাংবাদিকতার ছাত্র সুরজিত লাহিড়ী। দু’দিন গৌরি ভট্টাচার্যর বাড়িতে থেকে তারা ফের বাংলাদেশ ঢুকে পড়েন যুদ্ধ কভার করার জন্য। সে সময় বাংলাদেশের ছাত্রনেতা মুনিরুল ইসলাম তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তারা ধরা পড়েন। মুনিরুল কোনক্রমে বেঁচে গেলেও বাকি দুই সাংবাদিক প্রাণে বাঁচতে পারেননি। পাকবাহিনী তাদের হত্যা করে।
সেই থেকে শুরু বাংলাদেশের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের। অবশ্য এর আগে সাংবাদিক স্বামী অনিল ভট্টাচার্যর কাছে প্রতিনিয়ত শুনেছেন সে দেশের পরিস্থিতির কথা। শুনেছেন, একটি জাতি অধীর প্রতীক্ষায় রয়েছে তার স্বাধীনতার জন্য। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারা তৈরি হচ্ছে জীবন বাজি রেখে সংগ্রামের জন্য। বাংলাদেশ এগুচ্ছে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পথে। তখন গৌরি ভট্টাচার্য থাকতেন, তাঁর স্বামীর সাথে আগরতলার মেলারমাঠের কোয়ার্টারে। তাদের সেই কোয়ার্টারে যুদ্ধের দিনগুলোতে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বহু মানুষ। থেকেছেন, খেয়েছেন। যেন, গৌরি বৌদির আস্তানা তাদের জন্যে নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
তিনি বলছিলেন সে সব দিনের কথা। হয়তো দিন তারিখ এখন আর সব মনে নেই হুবহু। কিন্তু স্মৃতির খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে জোড়া দিলে এক জীবন্ত উপন্যাস দাঁড়িয়ে যায়।
তাঁর বাড়িতে যারা এসে আশ্রয় নিতেন, তারা এই পরিবারটিকে বিশ্বাস করতেন নিজেদের লোকদের মতই। বাংলাদেশ থেকে যারা সে সময় এসেছেন, তারা তাদের গয়নাগাটি, টাকা পয়সা, সব গৌরি বৌদির কাছে নিশ্চিন্তে রেখে যেতেন। এমনকি সে সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের বন্দুক, রিভলবারও লুকিয়ে রাখতেন তাঁর কাছেই, জানালেন গৌরি ভট্টাচার্য।
যুদ্ধের দিনগুলোতে তাদের সেই কোয়ার্টারে প্রতি বেলায় খেয়েছেন ১৮/২০ জন। সবার বাসার জায়গা হত না, ফলে ভাত খেতে হত দাঁড়িয়েই। খাবারের মেন্যুতে থাকতো ডাল, আলু দিয়ে ডিমের ঝোল আর ভাত। প্রায় প্রতিদনই এই একই খাবার। কারণ এত লোক সবার জন্য প্রতিদিন ভালো আয়োজন হবে কোথা থেকে। তাছাড়া তখন যুদ্ধের বাজার। সব কিছুর অগ্নিমূল্য। পাওয়াও যাচ্ছে না খাদ্য সামগ্রী। তাই সামান্য ভাত, ডাল ডিমেই পেট ভরতে হত মুক্তিযোদ্ধাদের।
তাদের এই কোয়ার্টারে বসেই, প্রথম সভা হয়। যে সভা থেকে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়, বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করার জন্য। গৌরি বৌদি জানালেন, ঐ সভাতেই সিদ্ধান্ত হয় “স্টপ জেনোসাইড”। সে সভাতে ছিলেন ৩৫ জন। সে দিনের সভার জন্য ঘর খালি করে তাঁকে জায়গা করতে হয়েছিল। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সামনের সাড়ির নেতা এবং ত্রিপুরার কয়েকজন ছিলেন ঐ সভায়। সেই সভাতে ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী।
বার কয়েক তদের ঐ কোয়ার্টারে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয় শেখ ফজলুল হক মনি এবং মেজ ছেলে শেখ জামাল। গৌরি ভট্টাচার্যের কথা, প্রথম বার যখন ফজলুল হক মনি তাদের এখানে আসেন তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আগরতলায় সেদিন রটে যায়, শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলায় এসেছেন। আর ফজলুল হক মনিকে দেখতে আনেকটাই শেখ মুজিবুর রহমানের মতো লাগতো। ফজলুল হক মনিকে দেখেই অনেকে ভাবলেন, এটাই বুঝি বঙ্গবন্ধু। সে রাতে গৌরি ভট্টাচার্যদের কোয়ার্টারের সামনে হাজার কয়েক লোক জমে যায় বঙ্গবন্ধুকে দেখতে। পরে তাদের বুঝিয়ে বলা হয়।
এছাড়াও তাদের সেই বাড়িতে এসেছিলেন, মির্জা আবু মনসুর, মোশাররফ হোসেন, নূরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মমতাজ বেগমসহ আরও অনেকেই। সবার নাম এখন আর মনে নেই তাঁর।
গৌরি ভট্টাচার্যের কোয়ার্টারে কাজ করতেন এক মহিলা। সবাই ডাকতো রেনুদি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনিও ছিলেন অত্যন্ত আপনজন। গৌরি ভট্টাচার্য বাড়িতে না থাকলে ঐ রেনুদিই সামলাতেন সব। সবার খওয়ার, থাকার, ব্যবস্থা করা, সবাইকে দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তাতো তার উপরই।
গৌরি ভট্টাচার্য নিজে কাজ করতেন নার্স হিসাবে। যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধের সময় আক্রান্ত বহু বাংলাদেশি নাগরিক ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। সে সময় ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৩ লাখ। আর ত্রিপুরায় বাংলাদেশ থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ১৭ লাখ মানুষ। সোনামুড়ায় জাফরউল্লা চৌধুরী একটি হাসপাতাল করেন মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য। সে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন, গৌরি ভট্টাচার্য। তাছাড়া তখন আগরতলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশে সে সময় নির্যাতিতা মহিলাদের চিকিৎসা চলে। সে কাজে সেবিকা হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন গৌরি ভট্টাচার্য।
সেদিন শুধু এই গৌরি ভট্টাচার্যই একা নন, এমন বহু সেবিকা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আক্রান্ত বাংলাদেশের ভাই বোনদের দিকে। ডাক্তার হিসাবে, সুজিত দে, রথীন দত্ত, এইচ এস রায়চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য, জানালেন গৌরি বৌদি।
বাংলাদেশ সময় ০৭২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১১