প্রবাসের সব ছোট বড় শহরে আছে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠন সমূহের শাখা। কোনোটা অনুমোদিত, কোনোটা স্বঘোষিত।
না, জামায়াত প্রবাসে স্বনামে-স্বপরিচয়ে নেই। বিভিন্ন সংগঠনের ছদ্মবেশে ও আশ্রয়ে জামায়াত প্রবাসের বাংগালী মহলের সর্বত্র বিরাজমান। একাত্তরে বিচারের ভয়ে দেশ ছেড়ে পলাতক জামায়াতী রাজাকার-আল বদরেরা প্রবাসে পৌঁছেই লেবাস পাল্টে স্যুট-টাই-কোটে পাক্কা মডার্ন। একে অন্যকে টেনে আনছেন। পঁচাত্তরের পর পরিকল্পিতভাবে জামায়াতীরা অর্থ-বিত্ত সহ প্রবাসে স্হায়ী হয়েছে `স্লিপিং’ ক্যাডার হিসেবে। নগদ লাখ ডলারে ব্যারিস্টারি শেষ করেছে। নামের আগে পিছে লাগিয়েছেন ডকটরেটের মতো ডিগ্রি । এই অর্থবিত্তের কিছু অংশ এসেছে দেশের জামায়াতী ব্যবসার থেকে বিনিয়োগের আকারে। কিছু এসেছে সউদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের ’তালেবান গড়ার প্রকল্প’ হিসেবে। কিছু এসেছে যাকাত ফান্ডের টাকা থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জামায়াত ও স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্যে খুলে যায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের তীর্থভূমি গাদ্দাফির লিবিয়ার সক্রিয় সহায়তা। স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রবাসে ধনে-জনে বাড়তে থাকে।
প্রবাসী জামায়াতীদের কথায় বার্তায় কোনো গোঁড়ামী নেই। সব সময় মডারেট ভাব। আলোচনার সূচনা করে মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। ’জানেন একাত্তরে আমাদের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতো’ বাক্য দিয়ে। বলে না, একাত্তরে তাদের বাড়ি ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের টর্চার ক্যাম্প। তারপর বাংলাদেশ ভারতের `করদ` রাজ্যে পরিণত হওয়ার আর আগামীতে মসজিদে আযান নিষিদ্ধ হওয়ার আশংকা শ্রোতার মনে জাগিয়ে তোলে। এভাবে মানসিকভাবে দুর্বল করে আস্তে আস্তে শ্রোতাকে জামায়াতী চিন্তা-ভাবনার সমব্যথী বানায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রবাসী জামায়াতের উদর থেকে জন্ম নেয় হিজবুত তাহরির-ফ্রিডম পার্টি। বিভিন্ন সাইজের বোতলে ভিন্ন লেবেলে একদল জামায়াতী রাজনীতির মঞ্চে উদিত হয়। অন্যদল থাকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আজকাল প্রবাসে প্রচুর আন্তর্জাল সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পত্রিকাগুলো বিএনপি’র প্রতি সহানুভূতিশীল। আওয়ামী বিরোধী। এগুলোর নেপথ্যেও জামায়াত। বিএনপি’র আঁচলে জামায়াতের লুকানোর মূল কারণ কিন্তু বিএনপিপ্রীতি নয়। জামায়াত ভালো করেই জানে, একমাত্র আওয়ামী লীগই তাদের বিচারের মুখোমুখি করবে। এই কারণেই এই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থিতা।
জামায়াতীরা প্রবাসে প্রথম দখল নেয় মসজিদ ও আরবী-কোরান শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। পরবর্তী সময়ে এই দখল বিস্তৃত হয় বাংলা ভাষা স্কুল ও সমিতির নেতৃত্বে। সকল রাজনৈতিক দলের শাখায় অনুপ্রবেশ ঘটে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতী ছদ্মবেশীদের। প্রবাসের বাংগালী মিডিয়াগুলোর অধিকাংশই জামায়াতীদের। কমিউনিটি জাগরণের নামে আসে জামায়াতী বক্তব্য। হিজবুত তাহরীরের লিফলেট। আওয়ামী ’অরাজকতার’, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, ভারতের আধিপত্য, সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি, ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের ’করদ’ রাজ্যে পরিণত হবার সচিত্র বিবরণ ইত্যাকার কিছু।
প্রবাসের জামায়াত নেতারা থাকেন ঈদ-রোজার আয়োজনে। দেশের মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্যে যাকাত-ফেৎরা টাকা তোলে ও দেশে কোরবানির আয়োজন করে। দুনিয়া বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এভাবে জামায়াত প্রায় ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজস্ব ব্যবস্হাপনায় বিলি-বন্টনের মাধ্যমে ক্যাডার ধরে রাখে। প্রবাসে জামায়াত কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চিৎকার করে সাধারণের চিত্ত জয়ে নামে। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় ’জাস্টিস ফ র বাংলাদেশ জেনোসাইড’ নামে এক আন্দোলন শুরু হয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাংগালী মিডিয়ায় প্রকাশিত সূত্রানুযায়ী, সংগঠনটি ’অতি সুবিশাল’ এবং তারা আন্তর্জাতিক আদালতে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার প্রত্যাশী। হাজার হাজার ডলার লোপাট হবার পর জানা গেলো কাগুজে সংগঠনটি কুখ্যাত গোলাম আযমের সাবেক এক ব্যক্তিগত কর্মীর ব্রেন চাইল্ড।
হালে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদগুলোতে জামায়াতীদের অনুপ্রবেশের কথা শোনা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা সংগঠনের জন্ম দিয়ে জামায়াতীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে দ্বিধা বিভক্ত করতে চাইছে। প্রবাসেও একই কাজ করা হচ্ছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের ফাইন্যান্সিয়াররা ছদ্মবেশী জামায়াতী কিংবা জামায়াত পৃষ্ঠপোষক।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, কৌশলটি রপ্ত হয়েছে গাদ্দাফির লিবিয়ায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আশ্রয়ের অভয়ারণ্য লিবিয়া থেকেই শুরু হয় রিক্রুটিং। টার্গেট করা হয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক -বেসামরিক ব্যক্তিদের। তাদের এবং তাদের সন্তানদের উন্নত বিশ্বে স্হায়ী বসবাসের সুবিধাদি দিয়ে সহানুভূতিশীল করে তোলা হয়। কাজটি কিন্তু জামায়াতের নামে করা হয়নি। কারণ প্রবাসের মূলধারার সমাজে সকল সময় যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণা ও মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হয়। জামায়াত ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা জানতো একদিন তাদের আইনের মুখোমূখি হতে হবে। এই প্রস্তুতিতেই জামায়াত ও বংগবন্ধুর ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে উপস্হাপনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
এই অশুভ কাজে একাট্টা হয়েছে একাত্তরের বাংগালী হত্যাযজ্ঞে থাকা অবসরপ্রাপ্ত পাকি সেনা কর্মকর্তা ও পাকি গোয়েন্দা সংস্হা। একাত্তরের পাকি যুদ্ধাপরাধীদের একটা বিরাট অংশ অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, কানাডায় স্হায়ী নিবাস গড়েছে। সবার সম্মিলিত লক্ষ্য বাংলাদেশে যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের বিচারের পথরুদ্ধ করা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আইনের বিচারে ঝুলিয়ে দেবার পর তাদের সম্মিলিত আতংক বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন নির্দলীয় ফোরামের নামে সভা-সেমিনার করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরির অপচেষ্টা দেখি। এখানে এইসব তৎপরতার অর্থ যোগান ফাঁসিতে নিহত কর্নেল ফারুকের ব্যবসায়ী ছেলে, বিএনপি সরকারের সাবেক নৌমন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেনের পলাতক সাজাপ্রাপ্ত ভিন্ন পরিচয়ে থাকা পুত্র সাইমন, বিডিআর হত্যার অন্যতম আসামী নাসির উদ্দিন পিন্টুর ভাই প্রমুখ। ইওরোপ-আমেরিকার পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু পরিবারের (শেখ সেলিম) বেয়াই আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী রাজাকার নূলা মুসা বা প্রিন্স মুসা। এই মুহুর্তে কানাডায় মূল অর্থ যোগানদাতা ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে দৌঁড়ের-মধ্যে-থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনী অবঃ মেজর নূর।
লিবিয়া কানেকশনের খাকী সঙ্গী কর্ণেল কাজী কায়সারকে নিয়ে মেজর নূর অনুপ্রবেশ ক’রেছে কানাডার মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। চলতি বছরের বিজয় মেলার মূল আর্থিক যোগানদার মেজর নূরের নামটি বাংলানিউজ সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হলেও কানাডার সাথে আমার দৈনন্দিন যোগাযোগ কিছু প্রিয় মানুষের কারণে। কানাডায় বাংগালী বুদ্ধিজীবীদের মেলা। সেখানে ছিলেন প্রিয় ফারুখ ফয়সল ও সালিম সামাদ। এখনো আছেন সৈয়দ ইকবাল, ইকবাল হাসান, কবি ফেরদৌস নাহার, বন্ধু রোকসানা লেইস, মোহাম্মদ আলী বোখারী, অনুজপ্রতিম সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও শহিদুল ইসলাম মিন্টু। কমবেশি সবার সাথেই নিয়মিত কথা হয়। কথা প্রসংগে জানলাম টরেন্টোতে বিশাল আয়োজনের বিজয়মেলা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ব্যয়বহুল শেরাটন হোটেলে। শুনে প্রীতই হলাম কিন্তু ক’দিন পর বাংলানিউজে প্রকাশিত খবরে পুরোপুরি বিভ্রান্ত। বিভিন্নজনকে ফোন করে জানলাম সত্যি সত্যি নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু খুনী মেজর নূর। বেচারা ’রিপার্ট্রেশনের’ হাত থেকে গলাটা বাঁচানোর জন্যে হেন কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি। কানাডা সরকার মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হলেও সব সময় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। বেচারা নূর তাই উঠে পড়ে লেগেছে বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন লাভের জন্যে।
এরই মধ্যে আয়োজক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঘোষণা দিয়েছে তারা এই সম্মেলনে জীবিত সকল সেকটর কমান্ডার ও খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের নেপথ্য কর্মীদের সবাইকে হাজির করবেন। সংস্হাটির কাছে ছোট খাটো একটি অনুষ্ঠান করার সামর্থ্য নেই। এতো বড় আয়োজন কিভাবে হচ্ছে? টরন্টো আওয়ামী লীগ সভাপতি মোস্তফা কামালও বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত। আওয়ামী সভাপতি জনাব কামালের আশংকা, কেন্দ্র অনুমোদিত কানাডাস্হ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জামায়াত-ফ্রিডম পার্টির সহায়তায় বিজয়মেলায় কিছু আদম আনবেন মোটা অর্থের বিনিময়ে। এতে দেশের ও মুক্তিযোদ্ধাদের বদনাম হবে। ভবিষ্যতে কানাডা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ে ভর করে বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরী পার পাবে এই দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগসহ অন্য দলের খাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে একাট্টা হচ্ছেন ২৭ নভেম্বর এক সভায় । কেউ জানেন না এতো অর্থবিত্তের উৎস কোথায়? তবে সব পরিচিত আংগুল মেজর নূর চৌধুরীর দিকে ইংগিত করছে। গুজব, বাংলাদেশের হাইকমিশনার জনাব ইয়াকুবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাকি নূর চৌধুরীর বাংলাদেশী পাসপোর্ট নবায়ন হয়েছে সম্প্রতি। সত্যি মিথ্যে জানার জো নেই।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কেবল বলতে পারি, গুজবটা সত্যই হবার সম্ভাবনাই বেশি। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা-জামায়াতীরা নিজ স্বার্থে এভাবেই ছদ্মবেশী হয়। স্বার্থের টানে একবার দৌঁড়ায় সউদি আরব, একবার ইসলামাবাদ। আবার ত্রিপোলি। একবার ফ্রিডম পার্টি, আবার বিএনপি। তবে ভেতরে ভেতরে জামায়াতী নিজের দলের স্বার্থের প্রতিই কেবলামুখি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে খেলো সাজাতে জামায়াতীরাই বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধুয়া তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে।
বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপর নাম জামায়াত।