দেশের গণতন্ত্র এখন গণভবন আর রোডমার্চে! ওই দুই নিশানা থেকে গণতন্ত্রের যে সব পৃথক বানী আসছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই আবর্তিত হচ্ছে দেশের রাজনীতি! উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা আসার পথে পথে খালেদা জিয়ার রোডমার্চের তোরণ দেখে দেখে ঢাকা এসে মহাজোটের নেতা, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেছেন, তার মনে হয়েছে এসবের পিছনে বিএনপির চাইতে জামায়াতের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা বেশি, আর রোডমার্চের মূল টার্গেট যেন আগামিতে তারেক রহমানকে ক্ষমতায় আনা’!
যুদ্ধাপরাধের অপরাধে আটককৃত নেতাদের বিচার ঠেকাতে জামায়াতের যে এখন ভরসার নাম খালেদা জিয়া তা দেশের রাজনৈতিক সচেতন সবাই জানে! বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের বকেয়া এই বিচার কী এভাবে ঠেকিয়ে দিতে পারবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন? একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কী এভাবে ব্যর্থ করে দেয়া যায়? না গায়ের জোরে হাঁটানো যায় উল্টোপথে? দেখা যাবে।
রোডমার্চের তোরণে তোরণে এক পরিবারের তিন সদস্যের ছবি! জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান।
এরজন্যে বলা হচ্ছে ইমেজ পাল্টাতে প্লাস্টিক সার্জারি নয়, খালেদার দরকার ল্যাঙ্গুয়েজ সার্জারি! ছেলেদের দুর্নীতি স্বীকার করা। কারন সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে ছেলেদের টাকা যে ধরা পড়েছে, তাতো কারও বানানো গল্প নয়। কোকোর টাকা সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে আটক হয়েছে মার্কিন ফেডারেল আদালতের নির্দেশে। আর এফবিআই’র যে কর্মকর্তা তারেকের টাকার তদন্ত করেন তিনি নিজে এসে ঢাকার আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। খালেদা ক্ষমতায় ছিলেন, তাই এফবিআই`র কর্মকর্তা তারেকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে কী করে ঢাকায় এসেছিলেন বা আসতে পারেন, তা তিনি জানেন। এই কর্মকর্তা এসেছিলেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে। যেমন বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ছাড়া দেশের কোন পুলিশ কর্মকর্তা অন্য দেশে সাক্ষী দিতে যেতে পারেন না।
কাজেই এ বিষয়টি নিয়ে মওদুদ আহমদ কি বললেন না বললেন তা ধর্তব্যের না। মওদুদ আহমদ পেশাদার উকিল। মক্কেল এরশাদ হোন আর তারেক রহমান হোন সময়ের গন্ধ শুঁকে তিনি বক্তব্য দেন। বিএনপিরই আরেক নেতা নাজমুল হুদার অভিযোগ, মওদুদের পরামর্শে নিম্ন আদালত এড়িয়ে এক দৌড়ে হাইকোর্ট-সুপ্রীমকোর্ট দেখাতে গিয়ে ক্যান্টনম্যান্টের বাড়ি হারিয়েছেন খালেদা জিয়া! অথচ নাজমুল হুদার পরামর্শ ছিল নিম্ন আদালত হয়ে এলে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে তা নিষ্পত্তি হতে তা অনেক দূর লাগত। এখন মওদুদরা বোঝাচ্ছেন বিএনপি আবার ক্ষমতায় ফিরলে খালেদা আবার বাড়িটি ফেরত পাবেন! তা কী বুলডোজারে সেখানে সেনাকর্মকর্তাদের জন্য নির্মীয়মান বহুতল ভবনটি ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের পর? সবতো একটু সাফ সাফ বলা দরকার।
এখন প্রতিটি জনসভায় বক্তৃতার সময় খালেদার বডিল্যাংগুয়েজে যে আগুন ঝরে, এর এক নম্বর রাগ শহীদ মইনুল রোডের ৯ বিঘা জমিওয়ালা সেই বাড়ি। ‘সেই বাড়ি তুমি কেড়ে নিয়েছ শেখ হাসিনা, তুমি শেষ!’ নাম্বার টু, ছেলেদের বিরুদ্ধের দুর্নীতির মামলা! এখন সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে ফেলে দেবার আগে ছেলেদের এসব ধরাপড়া দুর্নীতির বিষয়ে অবস্থান সাফ করতে হবে বিএনপির চেয়ারপার্সনকে। ‘আমার ছেলেরা দুর্নীতি করতে পারেনা, শহীদ জিয়ার ছেলেরা দুর্নীতি করতে পারেনা’, এসব মাতৃস্নেহের কথাবার্তাতো পাবলিককে শুনিয়ে লাভ নেই! কোন মায়ের কাছেই সন্তান খারাপ না। কানা ছেলের নামও মায়ের কাছে পদ্মলোচন! ছেলেরা দুর্নীতিবাজ না ফেরেস্তা তা প্রমান করতে হবে কাগজেপত্রে। বিলাতে-মালেয়েশিয়ার কোন চাকরি-ব্যবসাবাণিজ্য ছাড়া বছরের পর বছর সপরিবারে ছেলেরা থাকছে কী করে তা নিয়ে এখনো কিন্তু প্রশ্ন তোলেনি পাবলিক ।
বিএনপির রোড মার্চে বিস্তর লোক হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার যে বিচলিত তা বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ হিসাব নিচ্ছে রোডমার্চের গাড়ির। ওবায়দুল কাদের বলেছেন সারাদেশ ঘুরে রোডমার্চ না করে সংসদ ভবন অভিমুখে করুন।
হরতালের বদলে রোডমার্চ হচ্ছে তা অনেক ভালো। আওয়ামী লীগ-বিএনপির চাঁই নেতারাতো দেশের গরিব মানুষজন না, সবই টাকাওয়ালা-গাড়িওয়ালারা। বিএনপির এই গাড়িওয়ালা অনেকে রোডমার্চে বিনিয়োগ করছে, এই বিনিয়োগ সুদেআসলে তুলে নেবে তা ভবিষ্যতে। এটাই এখন আমাদের দেশের রাজনীতির মৌলিকত্ব! তা বিএনপির রোডমার্চের সাফল্যে বেদিশা না হয়ে আওয়ামী লীগওতো দিতে পারে এমন জনসংযোগ কর্মসূচি! না সরকারে চলে যাবার সঙ্গে দলটাও ক্ষমতার মধ্যে ঢুকে পড়াতে তারা এখন ডিসি-এসপি, গোয়েন্দা নির্ভর জনসভায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন? বিরোধীদলের পাল্টা যেমন বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন, এরশাদ, খালেদা জিয়া! এখন দিচ্ছেন শেখ হাসিনা! দেশের রাজনীতিতে সরকার বা বিরোধীদলের কোথাও আসলে কোন গুণগত পরিবর্তন নেই!
রাশেদ খান মেনন সেই মিডিয়া বক্তব্যে বলেছেন, সরকার আমাদের কোন কথা শোনেনা। পরামর্শ নেয়না। কথা বললে উল্টো ভুল বোঝাবুঝি হয়। মহাজোটের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার বক্তব্যে উঠে এসেছে সরকারটি কী গণতান্ত্রিক কায়দায় চলছে। আসলে পরামর্শতো তিনি নেবেন বা চাইবেন যিনি একোমডেটিভ বা সবার কথা শুনে চলতে পছন্দ করেন। আর যদি আমি মনে করি আমিই শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, অজেয় অমর অক্ষয়, সবকিছু আমিই জানি তাহলেতো কারো পরামর্শ নেয়ারও প্রয়োজন নেই।
বিএনপিতে এত রাজনৈতিক নেতা থাকতেও গেলবার ক্ষমতার সময় দেখা গেল বেছে বেছে আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালু আর হারিছ চৌধুরী হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব! এরমাধ্যমে দেশের মানুষ ক্ষমতাধরটির রূচি-প্রজ্ঞার হিসাব পেয়ে গেল। এবারে কারা রাজনৈতিক পরামর্শক তাও ওয়াকিফহালদের কাছে লুকোচাপা নেই। এরমাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথ হারিয়ে সরকার যে রাজনৈতিকভাবে ডুবছে তা শাসকদলের নেতাদের কথাবার্তাতেই স্পষ্ট।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময় ১৪১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১১