এ মাস বিজয়ের। পাশাপাশি শহীদ পরিবারের সদস্য, শহীদ জননী, জায়াদের জন্য স্বজন হারানোর বেদনার, ক্রোধের।
বাস্তবের এই অমানুষটি কিন্তু অনেক বেশি নিষ্ঠুর, বেপরোয়া-বেয়াদপ টাইপের। গত ক`দিন এই সালাহউদ্দিন ওরফে সাকা চৌধুরী ট্রাইবুন্যালে যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন তা অমার্জনীয়! বিএনপির আশ্রয়প্রাপ্ত, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কুখ্যাত হোতা এই সাকা যেন উল্টো দেশের জনগণের বিচার করার হুঙ্কার ছুঁড়েছেন! যে জনগণ তার একাত্তরের দুষ্কর্মের বিচারের অপেক্ষা করছেন গত চল্লিশ বছর।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার শুরুর পর এদের সহযোগী দোসরদের পক্ষে যে কথাটি জোরের সঙ্গে চিল্লাফাল্লা শুরু হয়েছে তাহলো এই দুষ্কৃতিদের মানবাধিকার! এসব সো-কল্ড সুফি-সাধুরা(!) একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর জনতার বিজয় উল্লাস দেখে পালিয়েছিল কোথায়? জনতা সেদিন যদি তাদের ধরতে পারত দিগম্বর করে গণপিটুনিতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু জুটত কি নসিবে? তাহলে কী আর এতদিন পর এসে এত কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের বিচারের আয়োজন করার দরকার পড়ত? পচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর তারা পলাতক অবস্থা থেকে সাধাররণ্যে ফিরে আসে। এরপর থেকে কখন কোন পক্ষে থাকলে গর্দান বাঁচবে সে কৌশল-ফন্দি করেই তাদের কেটেছে। এখনও চলছে সে ফন্দি-ফিকির! সবশেষ ট্রাইবুন্যালের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে সাঈদী-সাকার পক্ষে যা কিছু ঘটেছে, এর সবই সেই ফন্দি-ফিকিরের অংশমাত্র।
ওখানে আবার ব্যারিস্টার নামধামধারী যিনি এসব চ্যালেঞ্জের মন্ত্রণাদাতা তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের একশ অভিযোগ আছে। সরকার কেন আজ পর্যন্ত তাকে ধরছে না সেটিও একটি জ্বলজ্বলে প্রশ্ন! যেমন এই যুদ্ধাপরাধীর স্বীকৃত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের টাকায় গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় ঢাকা শহর সাজিয়েছে সরকার। এখন আবার একই প্রতিষ্ঠানে টাকায় বিজয়ের মাসে সারাদেশজুড়ে স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট করা হচ্ছে। এরজন্য শুধু টাইটেল স্পন্সরের জন্যেই ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা! ভূত ঢুকে যায়নিতো সর্ষের মধ্যে?
যুদ্ধাপরাধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের মানবাধিকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দুষ্কৃতকারীদের ভাড়াটিয়া জ্ঞানপাপী উকিল কয়েকজন ছাড়াও এক শ্রেণীর মিডিয়াও এ বিষয় নিয়ে মেকি কান্নাকাটি করছে প্রায় প্রতিদিন। নিউইয়র্ক টাইমসের ব্লগে কি ছাপা হয়ছে সেটিও সার্চ দিয়ে খুঁজে বের করে ছেপেছে বহুরঙ্গা ট্যাবলয়েড! দেশের শহীদ পরিবারগুলো যে ৪০ বছর ধরে বিচার বঞ্চিত, তাতে মানবাধিকার সমুন্নত ছিল কী? দেশের মানুষ কিন্তু এদের অনেক ইতিহাস জানে। নতুন করে চিনে রাখছে। টেলিভিশনে এসে মিষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিরপেক্ষতার কথা বলবেন আর কৌশলে একাত্তরের খুনিদের পক্ষ নেবেন, অত ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চালাকি ভালো নয়। দেশের মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে পথঘাটে বস্ত্র হারাতে কতক্ষণ।
এই ট্রাইবুন্যাল গঠনের আগেও একাত্তরের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার জন্য সালাহউদ্দিন গং কোনদিন অনুতাপ দেখাননি। উল্টো যখনতখন পাল্টা হুঙ্কার ছুঁড়ে বলার চেষ্টা করেছেন, যা খুশি করেছি-পারলে বিচার কর। ট্রাইবুন্যালকে এক ফুঁ’তে উড়িয়ে দেবার হুঙ্কার ছুঁড়তেন আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান গং। সাকা চৌধুরী হামসে বড়া কৌন হ্যায়’, ভাব করে দেখাতেন তাকে গ্রেফতারের সাহস সরকারের নেই। তার গায়ে হাত দিলে হাজার হাজার রাজাকারের আন্ডাবাচ্চা রাস্তায় নেমে পড়বে, দেশ অচল করে দেবে ইত্যাদি!
এখন ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে ডাহা মিথ্যা বলেন স্বঘোষিত আল্লামা(!) দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী! একাত্তরে তিনি কোথাও কোন অপরাধ করেননি! তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পর কেন এলাকা পালিয়েছিলেন পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামের দেলু রাজাকার? ট্রাইবুন্যালে সাঈদী মিথ্যা দাবি করে বলেছেন তিনি জামায়াতের মজলিসে সুরার সদস্য হবার আগ পর্যন্ত কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি! কিন্তু পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদতো তার একাত্তরের কীর্তিকলাপ সাপ্তাহিক বিচিন্তার কাছে লিখিতভাবে জানায় ১৯৮৭ সালে। বিচিন্তায় তখন দেশের বিভিন্ন এলাকার রাজাকারদের তালিকা ছাপা হচ্ছিল। সাঈদী তখন কিন্তু একজন ওয়াজি মাওলানা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে মোটেই আলোচিত ছিলেন না। আরেকটা মিথ্যা কথা বলেন সাঈদী। জামায়াতে অফিসিয়েলি জয়েনের আগে তিনি যে তাদের আরেকটি ছদ্মবেশী সংগঠনে ছিলেন বা তাকে সেখানে রাখা হয়েছিল, তা কিন্তু তিনি বলেন না। যেমন বলেন না ৯/১১’র পর বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত হিসাবে তার মার্কিন ‘নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জার’ তালিকাভুক্তি আর চ্যানেল ফোরের রিপোর্ট প্রচারের পর গ্রেফতার এড়াতে লন্ডন থেকে পালিয়ে আসার কথা।
সাকা আগে বলতেন তার গায়ে হাত দেবার সাহস কারও নেই! এখন সকালসন্ধ্যা ট্রাইবুন্যালের এক্তিয়ার নিয়ে কথা বলেন। বিচারের স্বচ্ছতা, তার মানবাধিকারের কথা বলেন। দেশের চিহ্নিত ‘রাজনৈতিক বে--(!)’ ব্যারিস্টার মওদুদ গং’ও তাই বলেন। উনারা একেকজন এত বড়বড় উকিল ব্যারিস্টার থাকতে এখন আবার ট্রাইবুন্যালে বিদেশি উকিল ছড়া ভরসা পান না কেন? আর বিদেশি উকিল আসতে দিলেই কী একাত্তরে এই খুনিদের খুন-ধর্ষন সহ সব অপরাধ কর্পুরের মতো উবে যাবে? না প্রতিষ্ঠিত করা যাবে যে একাত্তরে রাজাকাররা বাংলাদেশের পক্ষে আর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে! এখন এই অপরাধীদের ভাড়াটেরা লাখ লাখ ডলারের ফান্ড গঠন করে দুনিয়ার দেশে দেশে মুসলিম নেতাদের ভুল বুঝিয়ে তারা নানান মিটিং’এ নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে দিয়ে বলাচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, বিচারের নামে তাদের মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে। এসব দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা আছেন, আওয়ামী লীগের নামে চার-পাঁচটা করে গ্রুপ আছে। কিন্তু এদের কেউ কোথাও ওই সব বিভ্রান্ত কমিউনিটির কাছে গিয়ে প্রকৃত ঘটার বলার চেষ্টা করেছে, এমন কোনও দৃষ্টান্ত নেই। বিশাল প্রত্যাশার বিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে এসব সরকারি প্রস্তুতির চিহ্নিত দুর্বলতা!
ট্রাইবুন্যালে রাজাকার সাকা চৌধুরী বলেছেন এক বছর আগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দিতে সাত মাস সময় নিয়েছেন। এসব সত্য। এসব নিয়ে তিনি তার মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু আগেতো ৪০ বছর বিচার বঞ্চিত শহীদ পরিবারগুলোর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এরপর খুনির প্রটেকশন! রাজাকারের স্ত্রী ফারহাত কাদের সাংবাদিকদের সাত দফার কাগজ দিয়ে বলেছেন, আগে এই সাত দফা বাস্তবায়ন না হলে তার রাজাকার স্বামী ট্রাইবুন্যালকে অসহযোগিতা করবেন! এখন এ ব্যাপারে ট্রাইবুন্যাল তার কাজ করবে, কিন্তু পতিভক্ত রাজাকারের স্ত্রী হলেও ডিসেম্বর মাস কেন ভুলে যান কী করে ফারহাত কাদের? এদেশের সব দাপুটে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারওতো মার্চ-ডিসেম্বর অন্তত এই দু’মাসে একটু সাবধানে হাঁটাচলা করে, কথাবার্তা বলে! কারণ এই মাস দুটি দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা, পরাজয়ের মাস। পিঠ বাঁচানোর মাস। এখন এসব স্পর্শকাতর উস্কানিমূলক দম্ভোক্তির মাধ্যমে মানুষের ক্রোধে আক্রান্ত হলে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের স্ত্রী হিসাবে ফারহাত কাদেরের নিরাপত্তার মানবাধিকারের নতুন ইস্যু সৃষ্টি করা যাবে কী?
বিচার ভণ্ডুলের ভুল চেষ্টায় কী তেমন আরেকটি জুয়া খেলার পথে হাঁটছেন ধূর্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।