রিপোর্টিং’এ এই ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’র বিষয়টির বিশেষ-বিস্তর ব্যবহার হয়। কিন্তু সূত্রের উল্লেখ নেই, বড়জোর ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র’, ‘দায়িত্বশীল সূত্র’, ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র’ এমন নানাকিছুর ব্যবহার চলে।
রিপোর্টে যে বার্তাটি দেয়া হয় এর পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ-প্রচারও এথিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশে তা সব সময় সম্ভব হয় না। নাম প্রকাশ করলে সূত্রের গর্দান যাওয়া বা চাকরি-ব্যবসায় সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন যে কোনও নির্ভরযোগ্য সূত্র আবার একজন রিপোর্টারের কাছে সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁস।
ভবিষ্যতে নতুন নতুন এক্সক্লুসিভের স্বার্থে রিপোর্টারও চান না রাজহাঁসটা মরে যাক। কিন্তু বার্তাকক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বা সম্পাদক জানতে চাইলে রিপোর্টারকে বলতে হয় তার এই বিশ্বস্ত সূত্রের সাকিন-বৃত্তান্ত। কারণ প্রকাশিত রিপোর্টের দায়দায়িত্বের সঙ্গে তারা জড়িত।
কিন্তু এভাবে বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট হচ্ছে। এমনও হয় যে, রিপোর্টার সূত্রকে চেনেন না জানেন না, তথ্য-প্রমাণাদি হাতে আছে, অথচ রিপোর্টটি মিস করা চলে না। এমন অনেক রিপোর্ট বেরুচ্ছে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-কাজ হচ্ছে এমনটাও ঘটে।
রিপোর্টার হিসাবে আমারও এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট আছে। প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ক্রয় সংক্রান্ত এমন অজ্ঞাত সূত্র থেকে পাওয়া ফাইলভিত্তিক দুবার দুটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট টেন্ডার বাতিল হয়। ভেস্তে যায় এ সংক্রান্ত ক্রয়-কারসাজি! অথচ সংশ্লিষ্ট সূত্র দুটিকে চিনি না-জানি না। আজও নয়। ঘটনাটি উল্লেখ করে মাঝে মাঝে মজা করে বলি, হেলিকপ্টার কেনা বাতিলের রিপোর্টগুলোর সময় ঢাকায় তখন নিজের রিকশা কেনার সামর্থ্যও ছিল না!
একটা ঘটনা বলি। অফিসের টেবিলে একটা ফোন এসেছে। পাঠক পরিচয়ে ভদ্রলোক এ রিপোর্ট সে রিপোর্ট নিয়ে প্রশংসা-আলোচনার পর বলেন আপনার কাছে একটা ফাইল পাঠাচ্ছি। পড়ে দেখবেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফাইল চলে আসে। ফাইলটি পড়তে পড়তে চোখ কপালে ওঠে। বিএনপির আমল। হেলিকপ্টার কেনার আন্তর্জাতিক টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি টেন্ডার প্রস্তাবের খুঁটিনাটি মূল্যায়ন করে সেগুলোর বিষয়ে বিমান বাহিনীর বিশেষজ্ঞ কমিটির মূল্যায়ন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের চিঠি চালাচালি, বিমান বাহিনীর যাদের প্রস্তাব ত্রুটিপূর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ বলে বাতিল করেছে, তেমন একটি পার্টির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সুপারিশ, অনুমোদনের চিঠিসহ সবকিছু এক ফাইলে!
এমন এমন গায়েবি ফাইল কোথা থেকে আসে রিপোর্টাররা জানেন। নিশ্চয় টেন্ডারে কোনও একটি বঞ্চিত-ভিকটিম পক্ষ। অথচ ঘটনা সত্য। পদ্মাসেতু নিয়েও সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমস্যার ক্ষেত্রেও তেমন একটি ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত রিপোর্ট মূলত হয় আইএসপিআরের পাঠানো প্রেস রিলিজ সূত্রে। অথবা সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট পক্ষের বক্তব্য নিতে আইএসপিআরের মাধ্যমে যেতে যোগাযোগ হয়। রিপোর্ট সূত্রে আইএসপিআরের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে ভালো একটি সম্পর্ক ছিল।
হেলিকপ্টার ক্রয় সংক্রান্ত রিপোর্টটি নিয়ে আলাপ শুরু করতেই ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়ার প্রতিক্রিয়ায় জানতে চাইলেন, `আপনি এসব কোথায় পেলেন? এরপর ফাইলের খুঁটিনাটি সমুদয় শুনে বললেন ভাই আমার সঙ্গে আপনার কিন্তু কথা হয়নি। আপনি আপনার মতো যা ইচ্ছা করার করেন। আমারে খালি জড়াইয়েন না। ভাই হিসাবে খালি একটি দাবি করে বলি, যদি পরে আমাকে কোনও রিজয়েন্ডার দিতে বলে তা একটু ছাপিয়ে দিয়েন। রিপোর্ট ছাপার পর সেই রিজয়েন্ডার বা প্রতিবাদ আসেনি। বাতিল হয়ে যায় হেলিকপ্টার ক্রয়-কারসাজি। `
এবারে নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনের আগ মুহুর্তে অস্ট্রেলিয়া সফররত প্রধানমন্ত্রীর এক সফরসঙ্গীর বরাতে তেমন চলে আসে বিশ্বস্ত সূত্রের বিশেষ একটি খবর! নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী ডা সেলিনা হায়াৎ আইভী যে জিতছেন সে খবর আগেভাগে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়। নির্বাচনে যে সেনাবাহিনী দেওয়া হবে না, এ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর এক্সপেরিমেন্ট, ভোটের দিন শামীম ওসমান যাতে ভিন্ন কিছুর চেষ্টা করতে না পারেন সেক্ষেত্রে র্যাবকে কী বার্তা দেওয়া হয়েছে, সে তথ্যও দেয় বিশ্বস্ত সূত্র। বাংলানিউজে লিখে পাঠালে তা সতর্ক প্রকাশও হয়। ভোটের আগে ভোটের রেজাল্ট! এমন একটি রিপোর্ট বিশেষ স্পর্শকাতরও বৈকি! যথারীতি এর জন্য শামীম ভক্তদের নানান গালমন্দ হজম করতে হয়েছে। ভোটের দিন দুপুরের আগেই র্যাব যখন শামীম ওসমানকে তার বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে আর সেখান থেকে আর না বেরুতে বলে আসে, তখন আবার বিশ্বস্ত সূত্রের চেহারাটি ভাসে মনের আয়নায়।
তার নামটি কোথাও লেখা হয়নি। লেখা-বলা যাবেনা কোনদিন।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।