একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীর বিচার, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এ বিচার নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষমান দেশবাসীর জন্য এটি একটি শুভ সংবাদ।
এখনও কারা কারা এই বিচারে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের দেশবাসী চেনে-জানে। বর্নচোরাগুলোও দিনদিন শনাক্ত হচ্ছে। এ বিচার বন্ধের অফিসিয়াল দাবি করে বিএনপির ঘরেবাইরে এবং সারাদেশে কী প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা তারা জানে। এর ক্রোধ আপাতত মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে গেলেও একদিন তার ব্যাপ্তি হবে যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতা বিরোধী, তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে গ্রাম-শহরে। ঘরে ঘরে।
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’র মতো জাতিসংঘের আইনে যুদ্ধাপরাধী আর এদের সহযোগীরা সমান অপরাধী। হিটলারের একদার স্বর্গরাজ্য জার্মানিতেও এখন যুদ্ধাপরাধী বা তাদের সহানুভূতিশীলদের রাজনীতিসহ সবধরনের সামাজিক অন্তর্ভূক্তি নিষিদ্ধ। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে আবেদনকারী কোথাও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল অথবা অভিযুক্ত কিনা! নতুন আধুনিক প্রজন্মের বাংলাদেশেও একদিন এসব মওদুদগংদের সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির এমন সমান পরিস্থিতি হবে। রাজাকার যুদ্ধাপরাধী বা তাদের দোসর চিহ্নিত হলে কেউ তার বা তাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কও রাখতে চাইবেন না। সামনে সেদিন।
এ বিচারের কথা বলে আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে ভোট নিয়েছে। সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রস্তাব পাশ থেকে শুরু করে নানান কার্যকম চালালেও প্রায়শ নানান ধীরগতিতে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও শুরু থেকে সবার একটা সহজ-সরল উপলদ্ধি হচ্ছে এ বিচার যতটা হয় তা আওয়ামী লীগের আমলেই হবে। বিএনপির আমলে বা নেতৃ্ত্বে নয়। সর্বশেষ এ বিচারের বিরুদ্ধে নিজস্ব দলগত অফিসিয়েল অবস্থান প্রকাশ করেছে বিএনপি। এরমানে এ নিয়ে তাদের আর লুকোছাপা বা কোন ধানাইপানাই নেই। অতএব যারা বিচারের বিপক্ষে তারা জামায়াত-বিএপি-জাগপা-অলি আহমেদ যাই হোন, বিএনপির নেতৃ্ত্বে যেতে পারেন। বিএনপি আগামিতে ক্ষমতায় যেতে পারলে আজকের আটক সব যুদ্ধাপরাধীদের ফটাফট জেল থেকে বের করে তাদের সমব্যিহারেই কেবিনেট গঠন করবে! এরপর চিহ্নিত এসব স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার চেষ্টার ধৃষ্ট অপরাধে(!) বিচার করবে শেখ হাসিনাগংদের!
এ বিচার নিয়ে সংশয়বাদীদের সঙ্গে দ্বিমত এখানেই। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ন সিদ্ধান্ত হচ্ছে দেশের চিহ্নিত রুইকাতলা যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখিন করা। মিডিয়ার লোকজন যারা এ বিচারের পক্ষে ভ্যানগার্ডের দায়িত্ব পালন করে আসছেন, এ বিচার কোথাও অসম্পূর্ন ত্রুটিপূর্ন থাকলে কালপ্রিটগুলো বেরিয়ে যেতে পারলে, এখনও এমন অকল্পনীয় কিছু ঘটলে সবার আগে জীবনঘাতী ঝুঁকিতে পড়বেন স্বয়ং হাসিনা। অতএব পূন্যের কাজটিতে যখন হাত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে ইতিহাসের কাছে নিজস্ব কৃতি্ত্ব, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাই এ বিচার শেষ করে যেতে চাইবেন। কমিটমেন্ট রক্ষার দীপ্ত পথে এগিয়ে যাবার কৃতজ্ঞতা শেখ হাসিনাকে। এ বিচারের নেপথ্যে ব্রিটেন প্রবাসী একদল বাংলাদেশি আইনজীবী ও ডিজিএফআই’র একটি বিশেষ সেল কাজ করছে জেনেও ভাল লেগেছে। ডিজিএফআই’র সেল গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
এখন এ বিচার নিয়ে পদে পদে যারা প্রশ্ন তুলছেন তা তারা তুলবেনই। বঙ্গবন্ধুর খুনি থেকে শুরু করে এরশাদ শিকদারের ডিফেন্ডিং উকিলও তাকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা করেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল এরশাদ শিকদারের বিচারের সময় খুলনার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। বিচার চলাকালীন তার উদ্যোগে ওই মামলার সাক্ষীদের একটি নিরাপদ স্থানে রাখা হয় বর্তমান ট্রাইবুন্যালে আসা সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিষয়ে ওই মামলার দৃষ্টান্ত অনুসরন করা যেতে পারে। সাক্ষীদের নিরাপত্তার সুরক্ষা প্রসিকিউশনের দায়িত্ব।
প্রথম বলা হয়েছিল সরকার আসলে বিচার করবেনা, কথিত ধর্মীয় নেতাদের ধরে ধরে খামোখা হয়রানি করা হচ্ছে! এরপর শুরু হয় ট্রাইবুন্যাল আর বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা! খুনিদের মানবাধিকার বিষয়ক হৈচৈ! যেন এসবইতো তাদের কাজ! এদের কাছে নিরপেক্ষতার মানদন্ড হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে আর রাজাকারদের পক্ষে থাকা। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারগুলোর বিচার পাবার বিষয়টি কোন মানবাধিকার না! মানবাধিকার হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী খুনি রাজাকারদের সুরক্ষা!
ঐতিহাসিক এ বিচারে সরকার আর ট্রাইবুন্যালের গুরুত্বপূর্ন সহায়ক শরীক হচ্ছে দেশের মূলধারার প্রায় সব জনপ্রিয় মিডিয়া। কারন প্রধান এসব মিডিয়া এই বিচারের পক্ষে। একটা মিডিয়া যখন মানুষের পক্ষে থাকে তখন সে জনপ্রিয়-প্রধান হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জনপ্রিয় মিডিয়া পক্ষে মানে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এই বিচারের পক্ষে। এখন আমাদের লেখাগুলোর নিচে রাজাকার বা তাদের আন্ডাবাচ্চারা তাদের বোধগম্য কষ্টের বহিঃপ্রকাশ যেসব কমেন্টস লিখেন তারাই কিন্তু দেশের মূল স্রোতধারা নয়। এসব লেখার জন্য তারা নিয়োগপ্রাপ্ত। একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার সাঈদীকে যারা সুফী মাওলানা(!) হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টায় ব্যস্ত, তাদেরও কিন্তু বুকে হাত রেখে বলার সাহস নেই তাহলে কী কারনে মুক্তিযুদ্ধের পরপর সাঈদী তার এলাকা থেকে পালিয়েছিলেন? দেশ স্বাধীন হয়েছে দেখে যখন সারাদেশের মানুষ বিজয় উল্লাস করছিলেন, তখনতো কোন নিরপরাধ সুফী মাওলানার এলাকা থেকে পালানোর কথা নয়!
একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার সাঈদীর বিচার শুরুর সময়ে পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সেই বীর যোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া এই ওয়াজি মাওলানার একাত্তরের ফুলের মতো চরিত্রটি(!) মিডিয়ার নজরে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টের কাজে যে সব তরুন রিপোর্টার ওই এলাকাগুলোতে অনুসন্ধানে যান পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। স্মরণ করছি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে। যিনি একাত্তরের এসব পাপিষ্ঠদের বিচারে নতুন আন্দোলনের বীজ বপন করে দিয়ে গেছেন আমাদের চেতনায়। সাঈদীকে মার্কিনিরা নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জারস তালিকাভূক্ত করার পর বাংলাদেশ সরকারের কাছে আসা এফবিআই’ত চিঠিটি ফ্যাক্স করে দিয়েছিল অজ্ঞাতনামা একটি সরকারি সূত্র। সর্বশেষ বিলাত থেকে তার বিতাড়নের পর রিপোর্টটি করতে সহায়তা করেন লন্ডন প্রবাসী বাঙ্গালি একজন সাংবাদিক। সাঈদীর বিচার শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণে এদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৩৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১১