ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এমনই কপট প্রজাতি আমরা!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১১
এমনই কপট প্রজাতি আমরা!

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, স্বাধীনতা ঘোষণার মাস মার্চ বা ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি এলেই মিডিয়াজুড়ে শহীদ আর ভাষা সৈনিক বন্দনার প্রতিযোগিতা দেখে শবেবরাতের ফকিরের কথা মনে পড়ে যায়(দূঃখিত)! আমাদের একদল মানুষজন সারা বছর যাই করেননা কেন শবেবরাতের রাত দেখে একটু বেশি দান খয়রাত করেন। হুজুর-মৌলভী  অনেকেরও শিডিউল পাওয়া দুষ্কর হয়।

যেমন অভুক্ত-ক্ষুধার্ত শহীদ পরিবার, বীরাঙ্গনাদের খবর না নিলেও মার্চ-ডিসেম্বর দেখে দেখে তাদের প্রতি আমাদের আবেগ-ভালবাসা সব উথলে পড়ে যেন! সারা বছর তাদের আর কোন খোঁজখবর রাখিনা অথবা রাখার দরকারও মনে করিনা! এসব দিনের জন্য আমাদের বনেদি কিছু বক্তা-আলোচক অথবা ইন্টারভ্যুদাতাও আছেন! পোশাকি ছবির পরিচালক-পাত্রপাত্রীদের মতো এমনই যেন কপট আমরা সবাই! অথচ এই শহীদের আত্মাহুতি, বীরাঙ্গনাদের ইজ্জতের বিনিময়ে আজ দেশে-বিদেশে আমরা একেকজন মান্যিগন্যি! দেশ স্বাধীন না হলে কী কেরানী ভাগ্যের বেশি কিছু জুটত?

বাংলানিউজে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ঝাড়ামোছার ছবি দেখে মনে হলো ক’দিন পর সেখানে সবার সঙ্গে খালেদা জিয়াও যাবেন। কালো ব্যাজ লাগিয়ে শোকার্ত ফুল দেবেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ বেদিতে! কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারগুলোকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। বিজয়ের দু’দিন আগে কারা তাদের স্বজনদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল? ঘাতকদের সবাই ছিল জামায়াতে ইসলামীর লোকজন। এদেরকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরিয়েছেন খালেদা জিয়া! স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর রাষ্ট্র যখন ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে, রাজনৈতিক কূটচালে তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন! এবার এ বিষয়ে বিএনপির দ্বিচারীর ভূমিকাটি আরেকটু দৃষ্টিকটু দেখাবে এ  কারনেই যে, সর্বশেষ দলটির পক্ষে অফিসিয়েলি প্রেস কনফারেন্স করে এই জামায়াতিদের বিচার বন্ধের দাবি করা হয়েছে। অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মীরপুরের বার্ষিক ছবিটিও মিস করেন না বা করবেন না খালেদা জিয়া! ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ফুল দিতে জাতীয় স্মৃতিসৌধেও যান এবং এবারও যাবেন। আমাদের এসব দ্বিচারী খায়খাসলতের প্রতিদান আগামিতে রাস্তাঘাটে পেতে শুরু করবেননা, এর গ্যারান্টি কে কাকে দিয়েছে?
 
বাংলানিউজে বীরাঙ্গনা রাজু বালার করুন জীবন কাহিনী পড়ে চোখের পানি সামাল দেয়া  কষ্টের। বিজয়ের মাস উপলক্ষে রাজুবালাকে ঢাকা নিয়ে এসেছে নারীপক্ষ। এ সংগঠনের সংগঠক নারী নেত্রীরা বিত্তশালী অথবা ভালো চাকরি বা এনজিও’র সঙ্গে জড়িত থাকায় এই ক’দিন হয়ত খাবারদাবারের কষ্ট থাকবেনা রাজুবালার। কিন্তু এরপর? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আজমের প্রতীকী বিচারের অনুষ্ঠানেও কুষ্টিয়া অঞ্চলের কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে সাক্ষী দিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর কোনদিন তাদের খবর রাখার খবর বেরোয়নি। সাঈদীর মামলার পিরোজপুরের ভানু সাহা এখন ভারতে বেঁচে আছেন কিনা তা আমরা জানিনা। ক’দিন আগে একজন হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা মারা যাবার পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সময় অবহেলায় গান সেলুট না দেবার খবর ছাপা হয়েছে মিডিয়ায়! বেঁচে থাকতে তিনি চিকিৎসা পাননি। তার যুদ্ধে স্বাধীন দেশে বিনে চিকিৎসায় মৃত্যুর পর দরিদ্র বলে পাননি গান সেলুট! এমনই কপট প্রজাতি আমরা!

দেশের দূর্বলদের কথা বাদ দিন, ঢাকা শহরে থাকেন জাতীয়ভাবে পরিচিত এক ব্যক্তিত্বকে জানি, তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী। ভাস্ক্রর্য শিল্পী ব্যক্তিগতভাবে তিনিও ভালো নেই।   একাত্তরে খুলনার বাড়ি থেকে পাকিস্তানি পশুরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। একবার ঢাকায় পাবলিক লাইব্রেরীর এক অনুষ্ঠানে স্বামী-সন্তানদের উপস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন সেই লাঞ্ছনার বৃত্তান্ত। সে সময় কাঁদছিলেন ফেরদৌসী। বাবার পাশে বসে কাঁদছিলেন তার সন্তানেরা। উপস্থিত শ্রুতিমণ্ডলীর চোখগুলোও ভিজেছে। সেই ফেরদৌসীর ঢাকার জীবন এখন নানা সমস্যায় জর্জড়িত। মাথা গোঁজার নিজস্ব ঠাঁই নেই।
 
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথাও কোন একটি পরিত্যক্ত পুরনো বাড়ির জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। পূর্ত প্রতিমন্ত্রী সে ব্যবস্থা করেননি। মুখ ফুটে নিজের সমস্যার কথা তিনি বলতেও পারেননা। সর্বশেষ সংরক্ষিত মহিলা এমপিদের তালিকায় তার নাম এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী দেননি বলে হয়নি। এতে অন্তত কিছুদিনের জন্য তার আবাসন সহ অন্য সমস্যাগুলোর সুরাহা হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য ইজ্জত দিলেও দেশ-সরকার এই ফেরদৌসীদের মাঝে মাঝে দয়া দেখাতে চাইলেও ইজ্জত দিতে চায় না! মুক্তিযুদ্ধ আর এ সংক্রান্ত সমস্ত গরিমা-ইজ্জত এসব বিষয় এমন আমাদের যার যার এমন ব্যক্তিগত সম্পদ! এক শহীদের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছেলেকে চিনি দেশে তার শহীদ জায়া বৃদ্ধা মায়ের উদ্বেগের দিনরাত্রি কাটে এর আগে পাওয়া সরকারি বরাদ্দের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ আতংকে। যদিও দেশে এখন ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার।
 
এই বিজয় দিবসেও কিন্তু শহীদ পরিবারগুলোকে নিয়ে অনেক বাকোয়াজি হবে। কিন্তু শহীদ পরিবারগুলোকে কত টাকা ভাতা দেয় সরকার? একেকটি সরকার মাঝে মাঝে ভাতা বাড়ানোর গল্প বলে। কিন্তু শহীদ পরিবারগুলোর ভাতার পরিমান কত? এ টাকায় এ আক্রার বাজারে তাদের কয়দিন চলে? স্বাধীনতার পর থেকে দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি, সচিবসহ দায়িত্বশীল একেকজনের বেতনভাতাসহ নানা কিছু কতগুন বেড়েছে? আর সে সব অবস্থানে বসে ভাতার নামে তারা কী শহীদ পরিবারগুলোকে দয়া করে ভিক্ষা দিচ্ছেন? বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ইনাদের একেকজন কে কোথায় থাকতেন? এসব নিয়ে দরকার আমাদের সবার আত্মজিজ্ঞাসা। এই বিজয় দিবসে অন্তত এসব ভণ্ডামির বিষয়াদি নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের বিজয় দিবসে যাকে যেখানে বাকোয়াজি করতে পাবেন, তাকে জিজ্ঞেস করুন মুক্তিযুদ্ধের আগে তার বা তাদের পারিবারিক অবস্থা-সহায়সম্পদ কী ছিল, এখন কী বা এখন তাদের জীবনযাপনের মাসিক ব্যয় কত, আর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা বা শহীদ পরিবারকে কত ভাতা দেয়া হয়, অথবা তারা যদি আমাদের কাছে শ্রদ্ধা-মর্যাদার হয়ে থাকেন তাহলে মর্যাদাপূর্ন জীবনযাপনের জন্য ভাতা  মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকার কম হওয়া উচিত কী? রাষ্ট্র থেকে যদি তারা তাদের নিজেদেরটা কড়ায় গণ্ডায় নিতে বা আদায় করতে পারেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা অথবা শহীদ পরিবারকে কেন তা দেবেন না। দায়িত্বশীল সামনাসামনি ধরে জিজ্ঞেস করুন। এরপর বক্তৃতা-বাকোয়াজি করতে দিন।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১২১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।