ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

টিপাইমুখ ইস্যু: দুর্বলের আর্তনাদ

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১
টিপাইমুখ ইস্যু: দুর্বলের আর্তনাদ

টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে সর্বশেষ জকিগঞ্জের আমলসিদ পর্যন্ত লংমার্চ করলেন এরশাদ। যে উপলক্ষে এটি করা তাতে সফল সাবেক স্বৈরাচারী।

অর্থাৎ এর মিডিয়া কভারেজ ভালো হয়েছে। বাংলাদেশে হাসিনা-খালেদার বাইরে এই এরশাদের জনসভায় লোক সমাগম হয়। যেখানেই তাদের সমাবেশ হোক না কেন সেখানকার সব দলের লোকজন অথবা নিরপেক্ষ মানুষজন তাদের বক্তৃতা শুনতে অথবা দেখতে যান। এরা কিন্তু এই ভেবে পুলক অনুভব করেন যেন সমবেত লোকজন সব তাদের সমর্থক অথবা ভোটার! বাংলাদেশে এমনিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দুটি দল ছাড়া সংসদীয় তিনশ আসনে উপযুক্ত প্রার্থী দেবার বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা-সামর্থ্য তৃতীয় কোনো দলের নেই। সে কারণে জাপা-জামায়াতের মতো দলগুলো নির্বাচনে কিছু সিট নিয়ে বেরিয়ে আসতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতৃ্ত্বাধীন জোটে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ চায়। আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে জাপাকে নিয়ে নির্বাচনের তত্ত্ব যারা খোঁজেন তারা আসলে আ স ম রবের সেই গৃহপালিত বিরোধীদল মার্কা আরেকটি দুর্বল ক্ষণস্থায়ী পার্লামেন্টের বিধবংসী স্বপ্নচারী।

টিপাইমুখ লংমার্চে কী বললেন এরশাদ। সেই গতানুগতিক ভারতকে এই করতে দেব না সেই করতে দেব না! ক্ষতি না হবার গ্যারান্টি দিতে হবে ইত্যাদি! দুর্বলের আর্তনাদের মতো এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সব কথার সার কথাও এক! সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের চিঠির জবাবে মনমোহন বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু তারা করবেন না! ভাবখানা যেন ভারত সরকার নিজের দেশের স্বার্থের আগে দেখে বা দেখবে বাংলাদেশের স্বার্থ! অথবা নিজের দেশের মমতা ব্যানার্জিকে যতটা আমল-পাত্তা মনমোহন দেন, এর কানাকড়িও বাংলাদেশ বা প্রতিবেশী কোনো দেশকে দেন কী ড. মনমোহন? প্রতিবেশি দেশগুলো অভ্যন্তরীণ-অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে দুর্বল হওয়াতে এমনই স্বেচ্ছাচারী চলতে-চালাতে পারছে দিল্লির সাউথ ব্লক।

মনমোহনের চিঠি পাবার পর বিএনপি এ ইস্যুতে অনেকটা ইউটার্ন নিয়ে যা বলা শুরু করেছে, তার মানে দাঁড়ায়, বাঁধের বিষয়ে ভারতের নয়, সব দোষ শেখ হাসিনা সরকারের! শেখ হাসিনা সরকারের নতজানু নীতির কারণেই ভারত এই বাঁধ করতে পারছে! অতএব যে কোনো মূল্যে হাসিনার সরকারকে সরাতে হবে। যেন এমন কিছু করতে পারলেই বিএনপির ডরে ভারত আর এই বাঁধ করতে পারবে না, অথবা একদিন চুপচাপ গিয়ে তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসবে টিপাই বাঁধ!

আর শেখ হাসিনার দুই উপদেষ্টা ভারত থেকে ঘুরে এসে এত খোশ মেজাজ দেখালেন যেন সব উদ্ধার করে এসেছেন। এরপর দুই উপদেষ্টার টিপাইমুখ বচনসমূহ শুনলে সন্দেহ জাগবে এরা শেখ হাসিনা না মনমোহনের উপদেষ্টা? সবশেষ শেখ হাসিনা টিপাইমুখ বাঁধের দোষ দিলেন খালেদা আর এরশাদকে! তার কথা, উনারা ক্ষমতার থাকার সময় কী করেছিলেন? এভাবে টিপাইমুখ ইস্যুর তীর যেন ক্রমশ ভারতের দিক থেকে ঘুরে দেশের অভ্যন্তরীণ দোষাদুষির জায়গায় ঠাঁই নিচ্ছে! আসলে এমন ইস্যুর মোকাবেলা দেশের ভেতরে যে জাতীয় স্বার্থভিত্তিক ঐকমত্য থাকা দরকার, তা বাংলাদেশে নেই। যে কোনো দেশ এর সুযোগ নেয়। এখানে নিচ্ছে ভারত।

আদতে আমাদের নেতানেত্রীরা বরাবরই ভারতের কাছ থেকে দেশের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ অথবা অজ্ঞাত কারণে উদাসীন! মাঝে মাঝে যা আদায় করে আনেন, বিনিময়ে ভারতকে দিয়ে আসেন কয়েকগুণ বা ভারত তা কায়দা মতো আদায় করে নেয়। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক দর কষাকষিতে একবারই জিতেছে বাংলাদেশ এবং তা বঙ্গবন্ধুর আমলে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে তিনি অতিদ্রুত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। ১৯৭২ সালের সেই ভারত আজকের মতো প্রযুক্তিগত উন্নত, অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল না। এর কারণে প্রচার ছিল, তখন এপারের মুরগী একটা ডিম প্রসব করলেই তা মুহুর্তের মধ্যে ভারতে পাচার হয়ে যেত। এপারে সহজলভ্য আমদানিকৃত চীনা ইলেকট্রনিকস পণ্য দেদারসে পাচার হতো ভারতে। এমন একটি চিন্তার ভারত বা এর সেনাবাহিনী যারা নতুন একটি দেশ সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যাবার সময় তারাই কি না আত্মসমর্পণ করা ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যর অস্ত্রশস্ত্র তো বটেই, এপারের কলকারখানার মেশিনারিজ খুলে নিয়ে যাবার লোভ সামাল দিতে পারেনি! এসবের পাচার ঠেকাতে পারেনি যুদ্ধবিধবস্ত বাংলাদেশও।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দেশ প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে খাওয়ালো-পরালো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের ব্যবস্থা, আমেরিকা-চীনের মতো পরাশক্তির বিরোধিতা অবজ্ঞা করে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে গেল বাংলাদেশ সৃষ্টিতে, নতুন স্বাধীন দেশটি থেকে ফিরে যাবার সময় ওইসব আত্মসাতের ছোটখাটো লোভের কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুরুতেই যে হোঁচট খায়, তা আর কোনোদিন পারস্পরিক বিশ্বাস মর্যাদার জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর এক কথায় যে ভারত তখন তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, এর কারণও ছিল ওই সময়কার ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য। বঙ্গবন্ধু তখনও দেশের একক ও অবিসংবাদী নেতা। এরপর ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দেয় তখন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন না। সামরিক শাসক জিয়ার সেই সময়ে সীমান্ত পর্যন্ত লংমার্চ নিয়ে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ ঠেকানো যায়নি।

এখন টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুর শেষ কোথায়? এর অনিবার্য নির্মম অথচ সোজা উত্তর চলতি পরিস্থিতি এমন চললে এই বাঁধ হবে অথবা ভারত তা করবেই। কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, চীন এরা নিজেদের স্বার্থের প্রশ্নে এমনি একরোখা স্বেচ্ছাচারী যে তাদের মনে যা ধরে তা করেই। পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে নিউজিল্যান্ড সরকার তাদের দেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন সব কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া দুনিয়ার এক নম্বর কয়লা রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য সৃষ্টিতে দেশের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণের সঙ্গে সম্পর্কিত ৫০০ বড় শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে বিশেষ একটি কার্বন ট্যাক্স চালু করেছে দেশটির সরকার। অস্ট্রেলিয়ার গবাদিপশু রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু সেদেশে গবাদি পশু জবাইর নিষ্ঠুর কায়দার ছবি অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় প্রচারের পর প্রাণী অধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের মুখে ইন্দোনেশিয়ায় জীবিত পশু রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। আগামীতে যে কোনোভাবে বিশ্বশক্তি হতে উদগ্রীব ভারত বা চীনের মতো দেশগুলোর কাছে এমনটি আশা করা যায় কী?

টিপাইমুখ বাঁধের পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রথম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে ভারতের ভেতরে। যা আমরা কাপ্তাই বাঁধের অভিজ্ঞতায় জানি। কাপ্তাই বাঁধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার জীববৈচিত্র ধবংস আর সীমিত কৃষি জমির বেশিরভাগ ডুবে গিয়ে যে সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি। টিপাইমুখ বাঁধকে কেন্দ্র করে মণিপুরসহ আশেপাশের রাজ্যে একই সমস্যার সৃষ্টি হবে। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া সীমান্ত গড়িয়ে পৌঁছবে বাংলাদেশ পর্যন্ত।

দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিখছেন আন্তর্জাতিক আইনে ভারত এভাবে এ ধরনের একটি বাঁধ একতরফাভাবে করতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি আগে আন্তর্জাতিক ফোরাম বা আদালত পর্যন্ত নিতে হবে তো! তা না করে সরকার বলছে ক্ষতিকর হলে দেখে নেব। মানে যা করার তা করা হবে বাঁধ তৈরি-চালুর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া দেখে! বাঁধ হয়ে যাবার পর চুল ছিঁড়া বা কচু করা হবে আর কী! আর বিষয়টি মোকাবেলার বাস্তব কার্যকর পথে না গিয়ে বিএনপি এ নিয়ে সিলেটে হরতাল করে ফেলেছে! এরশাদ করে ফেলেছেন একখানা টিপাইমুখ মার্কা রংমার্চ!

এখন ভারতকে বিধ্বংসী ওই বাঁধ নির্মাণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা কী করে করা যায়? সরকার যেহেতু বাঁধ নির্মাণ পর্যন্ত অপেক্ষায় আগ্রহী, এর মানে বিষয়টি আগে ভাগে আন্তর্জাতিক আদালত বা কোনো ফোরামে নিয়ে গিয়ে ভারতের সঙ্গে চলতি সুমধুর সম্পর্ক(!)ঝুঁকিতে নিয়ে যেতে তারা রাজি নয়। আগামীতে ক্ষমতায় যাবার আশায় এ ইস্যু বা কোন ইস্যুতে ভারতকে চটাতে চাইছে না বিএনপি! তাহলে উপায়?
 
সংশ্লিষ্ট উদ্বিগ্ন ওয়াকিবহাল পক্ষগুলোর বিবেচনার জন্য একটি উদাহরণ পেশ করছি। একুশে ফেব্রুয়ারি যে এখন ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, এটিও কিন্তু কোনো সরকারি উদ্যোগে হয়নি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জোটবদ্ধ হয়ে বা বাপা বা কোনো পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি উত্থাপনের জন্য নিয়ে যাওয়া যেতে পারে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে। এখন তো অনলাইনের যুগ, এর জন্যে এখনই কারও শারীরিকভাবে কোথায় যাবার দরকার নেই। তথ্য উপাত্তসহ বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করা যেতে পারে অনলাইনেও। এ ব্যাপারে ভারতের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এ ব্যাপারে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি যৌথ আন্দোলন।

সুন্দরবনের জন্য যেখানে সামাজিক আন্দোলনের মতো করে ভোট চাওয়া গেছে, এ ইস্যুতে স্বাক্ষর সংগ্রহ বা অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনের মতো একটি সামাজিক আন্দোলন তেমন গড়ে তোলা সম্ভব । ড. কামালসহ যারা প্রতিদিন ভালো ভালো কথা বলেন, আন্তর্জাতিক ফোরামে শুনানির সময় জাতীয় স্বার্থে তাদের সেখানে যাবার কথা বলা যেতে পারে। সরকার আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু এখনই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে যেতে আগ্রহী নয়, বিধংসী বাঁধ নির্মান আগেভাগে ঠেকাতে তাই এমন একটি সংঘবদ্ধ বেসরকারি নাগরিক উদ্যোগের বিকল্প নেই।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।