ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

খুঁজে ফিরি আমার শিকড়

ইকবাল হাসান, কথাশিল্পী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১
খুঁজে ফিরি আমার শিকড়

সত্যি বলতে কি- আমার পায়ে এখনো মফস্বলের কাদা লেগে আছে। চৌত্রিশ বছরের সহধর্মিনী আমার পোশাক পরিচ্ছদে খুবই বিরক্ত, এবং প্রায়শ বিব্রত।

তার অভিযোগ- এতো বছর বিদেশে থেকেও তুমি এখনো মফস্বল মার্কাই রয়ে গেছো। মেয়েও মাঝে মাঝে বলে, আব্বু বি স্মার্ট। জামাই বাবাজিও নিশ্চয়ই আড়ালে আবডালে মেয়েকে বলে- তোমার বাপ একটা খ্যাৎ!
 
আর বলবে নাই বা কেন! একদিনের কথা বলি- শুনলে আপনিও ওদের সঙ্গে একমত হবেন।

ঘটনাস্থল হিলটন টাওয়ার্স, নিউ জার্সি। বাংলাদেশ সম্মেলন হচ্ছে। খুবই বড় ধরনের সম্মেলন। দেশি-প্রবাসী ‘কামেল’ ব্যক্তিগণ উপস্থিত। হুমায়ূন আহমেদ প্রধান অতিথি। দিনের বেলা সম্মেলন আর রাতে আড্ডা। জ্যোতি দা’ ( ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ) মহা আড্ডাবাজ মানুষ, ১৯৮৩-৮৪ সালে আমি যখন নিউইয়র্কে তাঁর বাসায় থাকতাম, প্রায়ই সারারাত আড্ডা হ’ত আমাদের, বল্লেনÑ আজ আমরা আড্ডা দেবো হোটেলের লবিতে। ড.পূরবী বসু, ফরিদা সরকার, ড.মঈনউদ্দিন মুন্সিসহ অনেকেই থাকবেন আড্ডায়। আড্ডা শুরু হবে মধ্যরাতে। সেই মধ্যরাতে আমাকে দেখেই জ্যোতি দা’ ছি ছি করে উঠলেন, কী হচ্ছে এসব ইকবাল! ফাইভ-স্টার হোটেলের লবিতে লুঙ্গি পরা অবস্থায় আমাকে দেখে তিনি যারপরনাই বিরক্ত, হাতে বাংলাদেশের মুড়ি আর ঝাল চানাচুর। মান-সম্মান সব ডুবে গেল বুঝিÑ একমাত্র পূরবী ছাড়া এমন একটা ভাব সকলের অবয়বে। কিন্তু আমার সমস্যা আমি কী করে বুঝাই! রাতের বেলা লুঙ্গি ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। দিনের বেলায়ও বাসায় সব সময় লুঙ্গি পরে থাকি। রাতের বেলা লম্বা স্ট্রাইপের স্লিপিং স্যুটে কাউকে দেখলে কয়েদি কয়েদি লাগে। কিশোর বয়সে কোন একটি চলচ্চিত্রে চিত্রনায়ক রাজ্জাক’কে জেল হাজতে লোহার গরাদের পিছনে অই ধরনের পোষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তো আমি আমার যুক্তিতে অনড়- মাওলানা ভাসানী যদি লুঙ্গি ও তালটুপি পরে সরকারি সফরে চীন যেতে পারেন- তাহলে আমি কেন একটি বেসরকারি আড্ডায় লুঙ্গি পরে যোগ দিতে পারবো না।
   
বলতে গেলে প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে যাই আমি। শীতের দেশ থেকে গিয়ে বাংলাদেশে মাস কয়েক থেকে শরীরে হৃদয়ে এক ধরনের উষ্ণ উত্তাপ নিয়ে ফিরে আসি। ঢাকায় একবার টিভির পর্দায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর গলায় গামছা দেখে আমার সখ হ’ল কানাডায় গামছা নিয়ে যাবার। সখের পাঁচ পা। বায়তুল মোকারম থেকে গামছা কেনা হ’ল দু’খানাÑ এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। হান্ড্রেট পারসেন্ট কটন, ঘন বুনোটের সেই গামছা বারো হাজার মাইল উড়ে টরন্টো এলো। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়- গামছা ৯. আইসক্রিম লেনে পৌছানোর পরপরই নিঁখোজ।

আমার সামনেই ফোন গেল কালিফোর্নিয়ায় মেয়ের কাছে, ...তোর বাপ বাংলাদেশ থেকে একজোড়া গামছা কিনে নিয়ে এসেছে। ছি ছি ছি, এখন বাড়িতে কোন গেস্ট এলে এবং বাথরুমে গামছা ঝুলতে দেখলে কী ভাববে? ওদিক থেকে নিশ্চয়ই পরামর্শ দেওয়া হল এনিয়ে উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় কাজ সারার। টেলিফোনের এপক্ষ কিছুক্ষণ পর ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিল। এর একদিন পরই গামছাজোড়া উধাও। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, নেই!  প্রশ্ন করা হল, গামছা কোথায় গেল? যে উত্তর এলো তা পরাবাস্তব কবিতার মতোই জটিল ও কুয়াশাময়। এবং শেষে বলা হল, কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না। গামছার কি দরকার? বাথরুমে তোয়ালে আছে। বুঝলাম, গামছার দর্শন আর পাওয়া যাবে না। এ ঘরে নিশ্চয়ই এমন কোন হিডেন স্পট আছে যেখানে গামছা কোন্ ছাই, লাশ গুম করে রাখলে স্বয়ং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এসেও খুঁজে পাবে না।
আর একবার, আমার যেন কতোতম জন্মদিন ছিল- তো আমাকে ডানিয়েল হেক্টারের সাদা স্যুট পরানো হল, গলায় ঝোলানো হল অ্যালসেশিয়ান কুকুরের জিভের মতো লাল টাই। আয়নায় স্যুটেড ব্যুটেড নিজেকে দেখে আমি হতবাক- ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করে কাক দাঁড়িয়ে আছে। যাহোক, এরপর স্বপরিবারে চাইনিজ রেস্তোরায় গমন। ঘটনাটি সেখানেই ঘটলো, না ঘটলেও পারতো কিন্তু অই যে- কপালের লিখন না-যায় খন্ডন! টেবলে কাটা চামচের সঙ্গে চপস্টিক রাখা ছিল। মেয়ে বললো, আজ তোমার জন্মদিন, আজ চপস্টিক দিয়ে ট্রাই করো, দেখো সবাই কী চমৎকার খাচ্ছে। আমি সাহস করে হাতে নিলাম। আমার মতো অস্থির প্রকৃতির মানুষের হাতে চপস্টিকের স্থির থাকার কথা নয়।
                                                            
তাই হল। দু’ আঙুলের ভিতর ধরতে না-ধরতেই চপস্টিক অস্থির। লাল সস মাখানো চিলি চিকেনের একটি টুকরো প্লেট ও মুখের মধ্যপথে আসা মাত্র- ভূমিকম্প হলে যেমন কাপবোর্ডে রাখা জিনিষপত্র কাঁপতে থাকে- তেমনি কাঁপতে শুরু করলো হাত, আঙুল ও চপস্টিক। আর অই সুযোগে চিকেনের টুকরো ঝাপিয়ে পড়লো ডানিয়েল হেক্টারের উপর। মুহূর্তেই সাদা স্যুটের উপর তৈরি হল অষ্ট্রেলিয়ার মানচিত্র, সঙ্গে ফোরিডার লেজ। আমি বেকুবের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দেখে, মা মেয়েকে বললো, তোকে বলছিলাম না, তোর বাপ একটা না একটা কা- ঘটাবেই আজ। এমতাবস্থায় কী করণীয়- সহসা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মেয়ে বললো, এটা এক্সিডেন্ট। স্যুট লন্ড্রিতে দিলেই হবে। মা- মেয়ের এসব কথোপকথনের মাঝপথ দিয়ে আড়চোখে পাশের টেবলের দিকে তাকিয়ে দেখি- একটি বাচ্চা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

দুই ::    
হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও ওয়েভ দিয়ে যে রান্না করা সম্ভব এই সত্যটি আবিস্কারের জন্যে পার্সি স্পেনসরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। দেয়া হয়নি। কে এই পার্সি স্পেনসর? তিনি ইলেকট্রোমেগনেটিক জগতে স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কামেল মানুষ। শিশু বয়সে বাবাকে হারান, মা তাঁেক ছেড়ে চলে যান। চাচার আশ্রয়ে পাওয়া অপার পিতৃ¯েœহটুকুও স্থায়ী হয়নি বেশীদিন। কয়েক বছরের ব্যবধানে পিতৃতুল্য চাচাকেও হারান তিনি। ফলে বেঁচে থাকার জন্যে কঠিন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে হয় খুব অল্প বয়সেই। হাইস্কুল শেষ করতে না পারলেও ছোটবেলা থেকেই আলোর গতি ও প্রকৃতি, বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থ বিদ্যার প্রতি তাঁর ছিল অপার আগ্রহ। ১৯৪৬ সালের দিকে র‌্যাথিয়ন কোম্পানিতে রাডার টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। নতুন ভ্যাক্যুয়াম টিউব ‘ম্যাগনেট্রন’ নিয়ে গবেষণার সময় স্পেনসর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর পকেটের ক্যান্ডিবার গলে যাচ্ছে! তিনি মোটেই বিস্মিত হলেন না, বরং এর কার্যকারণ খুঁজতে একজনকে ‘পপকর্ন’ আনতে বললেন। পপকর্ন এলো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, ম্যাগনেট্রনের পাশে রাখা পপকর্ন ফুটে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ল্যাবের চারদিকে। এবং এভাবেই তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অতি-প্রয়োজনীয় ‘মাইক্রোওয়েভ ওভেন’ যন্ত্রটি আবিস্কার করেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও হতে পারে, ১৯৪৭ সালে ডক্টর স্পেনসরের ডিজাইনে বাজারে আসা প্রথম মাইক্রোওয়েভের উচ্চতা ছিল ছ’ফুট, ওজন ছিল ৭৫০ পাউন্ড। আর এই বিশাল যন্ত্রটির দাম ছিল ৫০০০ মার্কিন ডলার।

হঠাৎ আমার লেখার মধ্যে পার্সি স্পেনসর সাহেব তাঁর অবাক আবিস্কার মাইক্রোওয়েভ নিয়ে কেন ঢুকে পড়লেন সে বিষয়টি খুলে বলা প্রয়োজন। এ বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি আমি যখন টরন্টো থেকে ১৪০০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের মাইনিং শহর থান্ডার বে’ আসি- আমার থাকার জায়গা হয় ম্যাকেলার প্লেসে। আগে হাসপাতাল ছিল, এখন বৃদ্ধদের রিটায়ারমেন্ট হোম। একলাখ বিশ হাজার স্কয়ার ফুটের এই বিশাল ভবনটি অকার্যকর হয়ে পড়লে নগর-প্রভুরা এটি ভেঙে ফেলার উদ্দ্যোগ নেন। স্বনামধন্য কেনেডিয়ান-বাঙালি আর্কিটেক্ট আহসানুল হাবীব ভবনটি সংরক্ষণে এগিয়ে আসেন। ভবনটি  ক্রয়ের পর অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্যে তিনি আশ্রয়ের ব্যবস্থাই শুধু নয়- ২৪/৭ নার্সিং সুবিধাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

ভবনে যারা বাস করেন কারো বয়সই সত্তরের কম নয়। কেউ কেউ আছেন যাদের বয়স নব্বুই থেকে একশ’                    বছর। হুইল চেয়ারে বসে তাঁদের কেউ কেউ তিনতলার বারান্দা থেকে নিভু নিভু দৃষ্টিতে আকাশের দিকে, পার্কিং
লটের ওপারে অনতিদূরের গির্জার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে অবাক বিস্ময় নিয়ে আমাকে দেখেন- আমিও তাঁদেরকে।

তাঁদের মনে হয়তো নীরব প্রশ্ন- আমি এখানে কেন? আমার বয়স কি সত্তরের উপরে?

ম্যাকেলার প্লেসে রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। নিয়মও নেই। গ্রাউন্ড ফোরে ভবনের বাসিন্দাদের জন্যে একটি রেস্তোরা আছে। অই রেস্তোরা থেকে কুপন দিয়ে খাবার কিনে খেতে হয়, সেট মেন্যু। দেখতে অনেকটা হাসপাতালের খাবারের মতো। সাদা সাদা, মশলার নাম গন্ধ নেই। ট্রে’তে চিকেনব্রেষ্ট, ম্যাশপটেটো যেন মৃত মাছের ঘোলাটে চোখের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে! অই খাবার খেয়ে বাঙালি বাঁচবে কীভাবে- এমত চিন্তায় মন যখন অস্থির, তখুনি রুমের ভিতর তাকিয়ে দেখিÑ ফ্রিজের পাশেই পার্সি সাহেবের আবিস্কার একটি ছোটখাট মাইক্রোওয়েভ ওভেন রয়েছে। বুদ্ধি এলো মাথায়। নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন।

মধ্যরাতে মাইক্রোওয়েভও যেন টুটু করে বলে উঠলো- আমাকে ব্যবহার করুন। উঠে দেখি, কফির পানি দিয়েছিলাম- বের করতে ভুলে গেছি। ব্যস পরদিন থেকে শুরু হ’ল বাঙালি মেধার শুভযাত্রা। মাইক্রোওয়েভ ওভেনে রান্না করা যায় শুনেছি- দু’মিনিটে ষ্টেক আর আধা ঘন্টায় আস্ত একখানা টার্কি। তবে প্রয়োজন হয়নি বলে নিজ হাতে চেষ্টা করে দেখিনি কখনো।

আমাকে আগেই বলা হয়ে ছিল, রুমে রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই এবং রান্না করা যাবে না।  

বললেই হল! বাঙালি না খেয়ে মারা যাবে নাকি ? আমার স্ত্রীর ধারনা ছিল, এই বৃদ্ধাশ্রমে আমি বোধহয় না খেয়ে মরেই যাবো। আমার সম্পর্কে তার আরো অনেক ধারনার মতো এটাও ভুল প্রমানীত হ’ল দু’চারদিনের  মধ্যেই ।
 
বেঁচে থাকার তাগিদে,অতএব, ভর্তা দিয়ে যাত্রা শুরু। কারণ বাঙালির খাদ্য তালিকায় ভর্তা থাকবে না এ কেমন কথা! দু’চারদিনের মধ্যেই মাইক্রোওয়েভে করল্লা, বেগুন, আলু, ডিম (আগে পানির ভিতর সামান্য লবন দিয়ে মাইক্রোওয়েভে সিদ্ধ করে নিতে হবে), ঢ্যারস, পেপে,কুমরা, জুকিনি, ফুলকপি, ব্রকলি, ডাল (আগে অল্প পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে) ভর্তা আমার কাছে ওয়ান ট্যু থ্রী ব্যাপার হয়ে গেল। তবে নো শুটকি ভর্তা! কক্সবাজার থেকে আমার বোনের স্বামী হারুন বাটিকের একজোড়া লুঙ্গি আর সঙ্গে পাঁচ-সাত পাউন্ড ‘লইট্কা শুটকি’ দিয়েছিল কানাডা নিয়ে আসার জন্যে। সেই শুটকি বিলি বন্টন শেষে সামান্য অংশ থান্ডার বে’ পর্যন্ত এসেছিল বটে। তবে মরা লাশের উৎকট গন্ধের সন্ধানে পুলিশ চলে আসতে পারে এই ভয়ে আর বের করা হয়নি।

রান্না নিষেধ ছিল। তবে সব নিষেধ মানতে নেই। মানলে, না খেয়ে খেয়ে শরীর ইথিওপীয়ানদের মতো হয়ে যাবে। দু’দিন পর মাটিতে আর ছায়াও পরবে না।

অতএব এভাবে চোরাগোপ্তা উপায়ে মাইক্রোওয়েভে রান্না চলছিল। ভর্তা দিয়ে শুরু হলেও অতি দ্রুত এই রন্ধন শিল্প অক্টোপাশের মতো হাত পা’ ছড়াতে থাকে। ডাল, লাউ দিয়ে চিংড়ি, আলু দিয়ে পালংশাক, বুটের ডাল দিয়ে খাশির মাংশ, মাশরুম দিয়ে কলিজা, গরুর ভুনা, খিচুরী, সবজি আর কেচকি মাছের চচ্চরির রান্না চলছিল ফুল গিয়ারে। রান্নার গন্ধ যাতে বাইরে যেতে না পারে সেজন্যে মোটা তোয়ালে সামান্য ভিজিয়ে রুমের একমাত্র দরোজাটির নীচে রেখে দেবার ব্যবস্থা হ’ল। আর্টস-এর ছাত্রের এই বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন কাজ দিয়েছিল বেশ। কিন্তু গন্ধের স্বভাব অনেকটা সত্য প্রকাশের মতো। জীবনের ফাঁক ফোকর দিয়ে একদিন বেরিয়ে আসবেই। হ’লও তাই।

নিজের উদ্ভাবনায় নিজেই পুলকিত যখন ঘটনাটি তখনই ঘটলো।

দুপুরে একজনকে খেতে ডেকেছিলাম। আর্কিটেক্ট, একটি কলেজে পড়ান। স্বভাবে পুরোদস্তুর বাঙালি, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী- এমন একজন বাঙালিকে ঘরে ডেকে কি হাসপাতালের খাবার খেতে দেয়া যায়!

রান্না চলছিল। সঙ্গে  স্বাগতালক্ষ্মীর কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। মেন্যু: ভুনা খিচুরি আর গরুর মাংশ। রান্না শেষ পর্যায়ে- এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো হঠাৎ। খুলে দেখি, দুই নার্স দাঁড়িয়ে- তাদের চোখেমুখে রাগ ও বিরক্তি। ওদের কিছু বলতে না দিয়েই আমি বললাম, সরি! আই এ্যম ডান।

ওরা খুব মোলায়েমভাবে বললো, প্লিজ ডোন্ট কুক হিয়ার। বৃদ্ধ মানুষেরা মশলার গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
কনিষ্ঠ নার্সটি হঠাৎ বলে উঠলো, ক্যান উই টেষ্ট ইওর ফুড এ লিটল বিট ? উই লাভ ইন্ডিয়ান ফুড।
বললাম, দিস ইজ নট ইন্ডিয়ান ফুড। পিওর বেঙ্গলি ফুড। ভুনা খিচুরি আর গরুর মাংশ।
ওরা খাবার নিয়ে হাসিমুখে বিদায় হ’ল। আর কোনোদিন বিরক্ত করেনি আমাকে।

এরপর সাহস বেড়ে গেল। ফুড ওয়ার্মারে রান্নার নতুন প্রক্রিয়া শুরু হল। মেন্যুতে ডাল কমন। জিরা তেজপাতা আর শুকনো মরিচ দিয়ে ডাল ‘বাগার’ আর দরোজায় গন্ধশোষক ভেজা টাওয়েল। এই দূর প্রবাসে ডালের কথা মনে হলেই আমার মেঝো চাচির কথা মনে পড়ে। তাঁর রান্না ডালের স্বাদ আজো আমার মগজের ভিতর ঘুড়ির মতো উড়ছে।

তিন ::  
শিল্পীর নাম স্বাগতালক্ষ্মী। রবীন্দ্রনাথের সব গানে কন্ঠ দিয়েছেন। গানের সংখ্যা ২০২৩। এমন কি যে গানগুলো বিদেশী গানের আদর্শে বা প্রভাবে রচিত সেই বিদেশী গানগুলোও গেয়েছেন তিনি। যেমন, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়’ কিংবা ‘সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়! কোথা সে লুকালো, কোথা সে হায়। ’
বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি আর মাঝে মাঝেই আকাশের বুকে বিদ্যুৎ চমক। ভুনা খিচুরী আর বেগুন ভাজির সঙ্গে আমার রুমে আজ যেন স্বাগতা উৎসব।
এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।
হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে-
তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে।
এরপরই স্বাগতালক্ষ্মী গেয়ে উঠলেন: আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/ তাই হেরি তায় সকল খানে/ আছে সে নয়নতারায় আলোক-ধারায়, তাই না হারায়- / ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়/ তাকাই আমি যে দিক-পানে...
দেশ, দেশের মাটি আর প্রাণের মানুষদের কাছে আমার অনেক ঋন। এক জনমে যা শোধ হবার নয়।

থান্ডার বে’, কানাডা

বাংলাদেশ সময় ২১৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।