যাযাবর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মেলামেশা করেছি। তাতে বেড়েছে জানা-শোনা ও সম্পর্কের বিস্তৃতি।
চাটগাঁর মনোরম বাটালি হিল আর মতিঝর্ণার কোল ঘেঁষে আছে লক্ষ-কোটি স্মৃতির লালখান বাজার। শৈশব-কৈশোরের হাইলেভেল রোড, ইস্পাহানি মোড়ের রহমান স্টোর, ব্যাংক অব চায়না, ম্যাজিস্ট্রেট কলোনি, পুলিশ লাইন মাঠ, মঞ্জু মিয়ার কলোনি, তুলাপুকুর (স্হানীয় ভাষায় পুস্করনী) ইত্যাকার সব মিলিয়েই লালখান বাজার আমার বেড়ে উঠার প্রথম সজ্ঞান-সোপান। দাপিয়ে ক্রিকেট খেলি চাঁটগা ক্লাবের নীচের মাঠে। কিংবা পানির ট্যাংকির উল্টোদিকের খোলা জমিনে। রোববার সকালে দল বেঁধে আলমাসে ইংরেজি মর্নিং শো মারি স্টুডেন্ট কনসেশনে। ফেরার পথে আলতামাস বুক স্টল থেকে নিপুন হাতে গায়েব করি দস্যু বাহরাম, স্বপন কুমার, নীহার রঞ্জনের কিরীটি রায় এবং শেষ দিকে প্রিয় বিদ্যুৎ মিত্রের কুয়াশা। তখনো দস্যু বনহুর আর মাসুদ রানা বাজারে আসেনি। পরেতো মাসুদ রানাই হয়ে গেলো ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম। ক্রিকেট খেলায়, আলমাসের মর্নিং-ম্যাটিনিতে, তুলা পুস্করনীর সাঁতারে তখন একদংগল উঠতি কিশোর। গুরুজনদের লুকিয়ে দল বেঁধে টানি সস্তার কে-টু, সিজার্স। হাই লেভেল রোডের ‘গুল গুইল্যা’( ডুবন্ত তেলে আটার গোল দলার ভাজি)।
আমরা মানে হামিদ কন্ট্রাকটরের ভাতিজা আবুল কালাম। গায়ের রংটা আফ্রিকানদের কাছ থেকে ধার করা বলেই কালা নামেই সমধিক খ্যাত। মদ্যপ পুলিশপিতা আর আজল (দুনিয়াদারী সম্পর্কে ধ্যান-ধারণাহীন) মোশাররফ। সিলেটি কামাল মজুমদার। সন্দ্বীপের ছোট্ট-খাটো বারী বা সেলিম। দেলোয়ার আর লম্বা মঞ্জু। বডি বিল্ডার রতন। আমাদের পৃথিবী তখন অভিন্ন রংয়ের। সমমনা স্বপ্ন ও বাসনার। আমরা নিজেরাই তখন আমাদের নিজেদেরই প্রেম! টোয়েন্টি টোয়েন্টির ফাটাফাটি টিম স্পিরিটের কারণে কোনো কিশোরীর চাহিদা জাগেনি কারো মনে। কেন জানি না তুখোড় কাকর-শেখরঁ-জাফরের সংগে স ম্পর্কটা জমে ওঠেনি। সালটা সাতষট্টি।
তখনো লালখান বাজার শহরের মধ্যে পাক্কা মফঃস্বল। ইস্পাহানির মোড় ধরে এসে কর্নার হোটেলের সামান্য সামনে গিয়েই শেষ। অবশেষ কর্ণার হোটেলের কোল ঘেঁষে ডান দিকের রাস্তাটা ইটের সুরকির হাই লেভেল রোড হয়ে পানির ট্যাংকি ছুঁয়ে আলমাস সিনেমা, মেহেদী বাগ, কাজীর দেউড়ি , নাসিরাবাদ অবধি গড়িয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। মতিঝর্ণার কোল ঘেঁষে বিহারীদের একটি কলোনি। কিছু বিহারি থাকতো শেরশাহ সূরী কলোনিতে। বাংগালীর তুলনায় বিহারিদের সংখ্যা ছিলো নেহাতই নগণ্য। তবে খানিক দূরত্বের ফিরোজ শাহ কলোনি ছিলো বিহারি-অবাংগালীদের আখড়া।
এক বছরের কুমিল্লার স্কুল হোস্টেলের বনবাস শেষে পয়ষট্টি সালে আবার ফিরি চির পরিচিত লালখান বাজারে। মঞ্জু মিয়ার ব্যয় বহুল ফ্ল্যাট কলোনির বারোটি ফ্ল্যাটের মধ্যে আমরাই একমাত্র বাংগালী। পাঁচটি অবাংগালী আগা খানী মেমন পরিবার আর বাকী ছয়টি অ্যাংলো খৃষ্টানদের হৈ-হুল্লোড়। তখন আমার কৈশোর চৈতন্য জুড়ে দাবা খেলার আসক্তি। বড় ভাইয়ের বন্ধুদের দাবা খেলা দেখতে দেখতেই আমার দাবা-প্রেম। ভাইজানের জানি দোস্ত কামরুল ভাই ছাড়াও কাজী নামের এক বন্ধু আসতেন বাসায়। কাজী ভাইয়ের পরিবার উনাকে ডাকতেন বড়বাবু। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষের মতোন কৃষকায় গাট্টাগোট্টা ছিলেন কাজী ভাই। চোস্ত ইংরেজির কথাবার্তায় বাংগালী বোঝার জো নেই। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই কাজী ভাই বা বাবু ভাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বড় বাবুর ছোট ভাইর পরিচিতি ছিলো ছোট বাবু নামে। এমনিতে কোনো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি তবে দু’জনেই প্রায় তুলা পুস্করীনিতে সাঁতারে মাততাম। এক দুপুরে আমার সাথে সাঁতারে গিয়ে ছোট বাবু আর ফিরলো না। সেই প্রথম খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে চাক্ষুষ করা।
লালখান বাজারের সীমানা তখন খুব বেশিদূর বিস্তৃত নয়। দল বেঁধে বাগমণিরাম ও পুলিশ লাইন ছেড়ে আমি ও কালা পিটি আইতে ক্লাস ফাইভ ছুঁয়ে কলেজিয়েট স্কুলে ব্যাটারি স্যারের নৈমিত্তিক ঠেংগানীর শিকার। স্কুলে যাওয়া আসার পথে নিত্য ঢিলাই অন্যের গাছের আম-পেয়ারা-বড়ই। বিকেলে, ছুটির দিনে আর ভরা বর্ষায় স্কুলের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে আমরা ফুটবল ক্রিকেটে পুলিশ লাইন মাঠে, পানির ট্যাংকির উল্টো পাশে, বাটালী হিলের চূড়ায় কিংবা আশকার দীঘির জলজ দাপাদাপিতে। তখন ব্যাটারি গলির তোফাজ্জল বা তপু নতুন সংগী। কবি খালিদ আহসান তখনো অতিথি পাখির মতো আসা-যাওয়ায়। মাঝেমধ্যে দল বেঁধে আমরা যাই নোয়াখালী থেকে এসে বাকলিয়ায় বসত গড়া ফরিদদের সুবিশাল বাসায়। কৈশোরের সেই উত্থাল দিনগুলোতেও কেন জানিনা আমাদের সাথে বিহারী ও অবাংগালী সমবয়সীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। কেবল হ্যালো-হাই ধরনের আনুষ্ঠানিক ও সীমিত মেলামেশা। ওদের দৃষ্টিতে আমরা বাংগালী নিম্ন বর্ণীয় গোত্রের কেউ! আমাদের দৃষ্টিতে ওরা উপদ্রব মাত্র!
একাত্তরের ২৬ মার্চ চাটগাঁ ছেড়ে পালানো আমাদের পরিবারের মাত্র দু’জন ফিরেছিলাম মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। আব্বা আর আমি। লুকিয়ে মঞ্জু মিয়ার কলোনিতে উঠলাম। প্রতিবেশীরা আমাদের ‘দুঃসাহস’ দেখে হতবাক! অ্যাংলো খৃষ্টান আর মেমন পরিবারগুলো আমাদের নিরাপত্তায় ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। পাঠান একজন দারোয়ান ছিলেন কলোনির গেটে। বিহারিরা এসে নিয়মিত আমাদের খোঁজ-খবর নেয়। অ্যাংলো খৃষ্টান আর আগা খানী প্রতিবেশীদের দাপটে পারে না। দু’দিন পর এক বিকেলে ওয়াল টপকে আমি ব্যাংক চায়নার পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কাজী ভাইদের বাসার উদ্দেশ্য দুঃসাহসিক যাত্রা করি। চুপি চুপি কাজী ভাইদের টিনশেড আর বেড়া-শনের ঘরের পাড়াতে পৌঁছে দেখি কবরের নীরবতা। শিশুর কান্নাতো দূরের কথা, কুকুরের গরগরও নেই। দীর্ঘক্ষণের টোকায় দরোজা খোলে কাজীদার সাত বছর বয়সী ছোট বোনটি (দুঃখিত নামটি স্মরণে আসছেনা)। আমাকে দেখেতো হতবাক, আমি যেন ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী কিংবা অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ।
মুহূর্তের মধ্যেই একটা হাত আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরে। আমি বাহুবন্দী হলাম ছোট বাবু-বড় বাবুর মায়ের। কী নিঃশব্দ সেই কান্না ! কী অসম্ভব হূদয় বিদারক সেই মুহূর্তটি। কী অসম্ভব হৃদয় বিদারক সেই মুহূর্তটি। চোখের জলে বুক ভেজানো সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট সেই বেড়ার ঘরে। খালাম্মা কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে নিয়ে লুকালেন পাহাড়ের এক গাছ গাছালির ঢালে। জানলাম একাত্তরের বিভীষিকার ভয়াবহতা। এর আগে কেবল দেখেছি রাস্তার পাশে কুকুরে-কাকে ঠোকরানো মৃতদেহ। বুঝিনি মৃতদেহের সারি দিয়ে মৃত্যুকে স্পর্শ করা গেলেও উপলব্ধি করা যায় না। মৃত্যুর নির্মমতা বুঝতে হয় শোকের ভয়াবহ মাতম দেখে-শুনে।
উপলব্ধিতে একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ দল বেঁধে বাঙালিরা শহর ছেড়ে পালিয়েছে গ্রামে। বড় বাবুরা নদী ভাঙা এলাকার মানুষ। ওনাদের কোনো গ্রামের বাড়ি ছিলো না। বাধ্য হয়ে আরো সতেরোশ’ হতভাগ্য পরিবারের সাথে উনারা ইয়া নফসি ইয়া নফসি পড়ে আঁকড়ে থাকলেন লালখান বাজারের পাহাড়ি মাটি। প্রতিরাতে হানাদার বাহিনীর আতংক জাগানো টহলের মুখে ওনাদের রাত কাটে পাহাড়ের জংলী উদার আকাশে। মেঘ-বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুব বাচ্চারাও প্রাণের ভয়ে ক্ষুধার কান্না গিলে ফেলে। হায়রে জীবনের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ! কিন্তু নব্য রাজাকার আর জামায়াতিরা একদিন বিহারিদের নিয়ে সদলবলে হাজির হলো মাঝরাতে। তীব্র বর্ষণমূখর সেই রাতে অনেকেই জঙ্গলের চেয়ে বাড়িকে নিরাপদ ভাবার ভ্রান্তিতে ছিলেন। অস্ত্রের মুখে সব পুরুষকে ঘর থেকে বের করে এনে লাইন ধরে গুলি করা হয়। একরাতে সতেরো শ’ পরিবার হারায় তাদের সব পুরুষ সদস্য। বাচ্চারাও রেহাই পায়নি। অনেক মহিলাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। কী নারকীয় সেই দৃশ্য! নিহতদের মধ্যে ছিলেন দাবা চ্যাম্পিয়ান কাজী দাও।
একরাতের বিভীষিকায় লালখান বাজারের সেই সরগরম পাড়াটা পরিচিতি পেলো বিধবাপাড়া নামে। স্বজন হারানো সতেরোশ’ পরিবার বুকে জগদ্দল পাথর বেঁধে নায্য বিচারের অপেক্ষায় চল্লিশ বছর বেঁচে আছেন। হত্যাকারী বিহারীদের অনেকেই চাটগাঁ ছেড়ে অন্যত্র মুখ লুকিয়েছে। কিন্তু হত্যাকারী রাজাকার আল বদরেরা এখনো দিব্যি বেঁচে আছে, বুক ফুলিয়ে সমাজে প্রতিপত্তির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিধবাপাড়ার গণহত্যার কী কোনো বিচার হবে না? বিজয় দিবসের চেতনা কী বলে?
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com