কানাডার প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দের সংবাদ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরল ভূমিকা রাখার জন্য তৎকালীন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি ও সম্মান।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বর্তমান সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এই মহান কার্যক্রমের। একাত্তর সালে বিদেশিদের অসামান্য অবদান মূল্যায়ন করে বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ভারত, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও রাশিয়ার খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মানবতাবাদীদের সাথে রয়েছেন পিয়েরে ট্রুডো।
পত্রিকা থেকে জানা গেলো, আরো একজন কানাডীয় নাগরিক সগীর আহমেদ এই সম্মান অর্জন করেছেন। *১ অথচ আমরা তার খবরও রাখি না। এ ব্যাপারে অটোয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খোন্দকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সঠিক তথ্য জানাতে পারেননি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব সরাসরি বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। পাক-বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালানো-পোড়ানোর মতো বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডকে তারা সমর্থন জানিয়েছিল। আর সেই সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ভারত, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জাপানসহ অন্যান্য রাষ্ট্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করলেও এই দু’দেশের অনেক সচেতন নাগরিক পাকিস্তানি হানাদারদের তীব্র বিরোধিতা করে জেল খেটেছেন, কলম ধরেছেন, ক্যামেরা ধরেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।
তাঁদের এই অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। আর তার দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৮ জুলাই ২০১০ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে ১৫০ জন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা দেওয়া হবে।
একটি দৈনিক পত্রিকা ডিসেম্বর ১৪, ২০১০-এ জানিয়েছে যে, সেই তালিকা প্রায় ৪০০তে বর্ধিত করা হয়েছে। যদি ১৯৭১ সালে বিদেশি বন্ধুরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সাহায্য, সহযোগিতা এবং সমর্থন না দিতেন, তাহলে হয়তো স্বাধীনতা অর্জন আরো বিলম্বিত হতো। বিশ্ববাসীর প্রবল চাপে পাকসেনারা লেজ গুটিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল।
বিদেশিদের ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয় বই লেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রিটেন, ভারত, জাপান ও জার্মানির অবদান তুলে ধরেছে লেখকবৃন্দ। যা আমার ঐতিহাসিক অমূল্য সম্পদ।
যেমন, নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী অস্ট্রেলিয়ান ওডারল্যান্ড সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরপ্রতীক খেতাব অর্জন করেছেন। *২ তখন তিনি বাটা কোম্পানিতে কাজ করতেন। আর সেই বাটার হেড অফিস ছিলো টরন্টোতে। বাটা কোম্পানি’র মালিকও নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন।
১৯৭১-এ কানাডার সরকারসহ বিভিন্ন মিডিয়া, টরেন্টো ভার্সিটি, এনজিও ও বিভিন্ন চার্চসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কানাডা প্রথমে অবশ্য সরাসরি সমর্থন দেয়নি। তবে শেষদিকে সার্বিক সহযোগিতা করে। স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পার্লামেন্টে পাকিদের বর্বরতার নিন্দা প্রস্তাব এনেছিলেন এবং ত্রাণ পাঠিয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর যোশেফ ও কর্নেল কানাডা সরকার ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে লিখেছেন:
“The Government of Canada, headed at that time by Prime Minister Pierre Elliot Trudeau, with Mitchell Sharp as Minister of External Affairs, was, however, much more inclined to be of assistance to the Bangladeshis on both humanitarian and diplomatic levels than that of the United States, which for decades had treated Pakistan as a Cold War ally vs. the Soviet Union and in 1971 was keen to use Pakistan’s good relations with Chiana as a means of ...*৩
যুদ্ধের পরেও কানাডা আশ্রয় দিয়েছে ১৮জন যুদ্ধশিশুকে। তারা এখন কানাডায় বসবাস করছে। যেমন- বায়ান বি গুড, ল্যারা জারিনা, বাতুন প্রমুখ।
জানা গেছে, এদের একজন এখন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে বায়ান গুড ওরফে বাদল তো মা’র খোঁজে মাতৃভূমিতে গিয়েছিলেন। মন্ট্রিয়ল’র চিত্রপরিচালক প্রভেনচার রেইমন্ড ‘ওর্য়াল্ড চাইল্ড’ শীর্ষক যে মর্মস্পর্শী ছবি নির্মাণ করেছেন, তাতে বায়ান গুডের চরিত্র স্থান পেয়েছে সিংহভাগ।
খুঁজলে দেখা যাবে, এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অবদানে কানাডা এবং কানাডিয়ানদের ভূমিকা অনেক। যার দৃষ্টান্ত নেপথ্যে থাকা সগীর আহমেদ। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম কবি ও লেখক Carolin Smart-কে; যিনি একাত্তরে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন, কবিতা লিখেছেন।
ট্রুডোর ছেলে জাস্টিন ট্রুডো দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি সব সময়ই গর্ববোধ করি, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বিশ্বের অল্প যে ক’টি দেশ প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, কানাডা তাদের একটি। ’
তিনি ১৯৮৩ সালে বাবার সাথে বাংলাদেশ সফরের মধুর স্মৃতিচারণ করেন এবং মন্ট্রিয়লের প্যাপিনো আসনের বাংলাদেশি-কানাডিয়ানেরা তাঁকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন, সে জন্য কৃতঞ্জতা প্রকাশ করেন। *৪
এদিকে টরন্টো’র সাইফুল আলম ট্রুডোর নামে বরিশালে একটি লাইব্রেরি চালু করেছেন প্রায় এক দশক আগে।
এদিকে কেউ কেউ ভুয়া ‘বীরপ্রতীক’ বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। কেউ কেউ বীরদর্পে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে কৃতিত্ব নিচ্ছেন। কেউ বা কল্পকাহিনিকে সত্য বলে চালিয়ে লেখালেখি করছেন।
এদেশের শেকড় অনেক শক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন যুদ্ধাপরাধী আশরাফুজ্জামান খান, যুক্তরাজ্যে চৌধুরী মঈনুদ্দিনরা রয়েছেন, খুঁজলে এখানেও পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মতো একাত্তরের খুনীদের। যুক্তরাষ্ট্রে-যুক্তরাজ্যে খান-চৌধুরীদের মুখোশ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, এখানেও আত্মগোপনকারীদের চেহারা তুলে ধরবেন সচেতন প্রবাসী বাঙালিরা। তাই টরন্টোতে সমবেত হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা সমাজ।
কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (Pierre Elliot Trudeau) পিয়েরে ই. ট্রুডোকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর এই স্বীকৃতি কানাডার জন্যও বিরল সম্মান। *
*পুনশ্চ: ‘কানাডায় ১৯৭১’ শীর্ষক লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থের সার সংক্ষেপ।
তথ্যসূত্র:
১. ডিসেম্বর ১৪, ২০১০-এ একটি দৈনিক
২. ১৬ ডিসেম্বর ’৭২-এর সরকারি গেজেট নং ৮/২৫/ডি-১/৭১, ক্রমিক নংক- ৩১৭
৩. দ্য বেঙ্গলি টাইমস ডটকম, ডিসেম্বর ১৮, ২০০৯, টরন্টো, কানাডা
৪. সাপ্তাহিক আজকাল, জুলাই ২৯, ২০১১, টরন্টো, কানাডা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১