সিডনি: চৌদ্দ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিএনপির আলোচনা অনুষ্ঠান দুটিতে খালেদা জিয়া ছিলেন না। দুদিনেই অবশ্য যথারীতি মিরপুরের বুদ্ধিজীবী স্মৃতি আর সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় এদিন অনাকাঙ্ক্ষিত একটি গোলযোগের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস দুটিতে দলীয় প্রোগ্রামে খালেদা জিয়া কেন নেই? দলের পক্ষে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তিনি অসুস্থ একথা বলারও সুযোগ ছিলম না। কারণ দু’দিনেই সকালের প্রোগ্রামে তিনি ছিলেন।
বিজয় দিবসের দলীয় প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি হিসাবে তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যাননি। অনুষ্ঠানের ঘন্টা খানেক আগে তার প্রেস সেক্রেটারি মিডিয়াকে বলেছেন, ম্যাডাম বোধ হয় প্রোগ্রামে যাচ্ছেন না।
এভাবে কী চলতি রাজনৈতিক কারণেই দিনে দিনে বদলে যাচ্ছেন আমাদের বিরোধীদলের নেত্রী? যেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিন দুটিও তার কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ নয়? না সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের পক্ষে কথা বলা সম্ভব ছিল না। বা এ প্রসঙ্গ অনিবার্য এসে যেত, এসে গেলে তা নিয়ে ঘোট পাকাত আওয়ামী লীগ এবং মিডিয়া- সে শংকায় যাননি?
কোনও জবাব আছে এসব প্রশ্নের?
খালেদা জিয়ার এবার এসব অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলা সম্পর্কে বর্তমানে আমেরিকাপ্রবাসী জিয়ার ঘনিষ্ঠ একজন সাংবাদিক টেলিফোনে মন্তব্য করেন, রাজনৈতিক দলগঠনের জন্য জিয়া স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু কখনো জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চাননি। যেটি আজ খালেদা জিয়ার হাতে হচ্ছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর বিজয় দিবসে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের দুটি ফটো সেশনেই অন্যদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। প্রথমজনকে তার ঠাকুরগাঁও’র স্থানীয় লোকজন সেখানকার একাত্তরের রাজাকার চোখা মিয়ার ব্যাটা হিসাবে চেনে-জানে। এই অপরাধ বা কলঙ্কটি অবশ্য তার নিজের না। পৈত্রিক।
আর বাংলার অমর পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের মেয়ের জামাই’র পরিচয়ের চাইতে মওদুদের বড় পরিচয় এখন একজন ডিগবাজি বিশারদ রাজনীতিকের। মওদুদ তাই সাংবিধানিক ভালো কোনও কথা বললেও দেশের সন্দিহান লোকজন তাতে একটা ‘কিন্তু’ খোঁজেন! সেই মওদুদ এখন দেশের চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের একজন উকিলও!
অতএব এমন চরিত্রদের নিয়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার স্ত্রী’ খালেদা জিয়া এখন আর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসেও মানসিক স্বতঃস্ফূর্তি দেখাতে পারলেন না। তার মনোভাব চলতি বছরের উল্লেখিত দুটি দলীয় সভায় অনুপস্থিতির মাধ্যমে প্রমাণ রেখেছেন বিরোধীদলের নেত্রী!
সর্বশেষ রোড মার্চের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া জোর গলায় দাবি করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বিএনপি। তাহলে নেত্রী কেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার ঈমানি জোর পান না? এ প্রশ্নের জবাব কী আছে তার কাছে?
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে পাকিস্তানি বাহিনীর চাইতে রাজাকারদের ভূমিকা বেশি ছিল। তা এই রাজাকার কারা?
এখন বিচারের জন্যে যে গ্রেপ্তারকৃত-অপেক্ষমান মতিউর রহমান নিজামি, আলী আহসান মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান বা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এরা কি আত্মস্বীকৃত রাজাকার তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষার সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন না? নাকি তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মওদুদ সাহেব? এই রাজাকারদের উকিল হিসাবে কোর্টে দাঁড়িয়ে কি তিনি ভিন্ন কথা বলবেন? না আর বলতে পারবেন?
ধরা পড়ে গেছেন মওদুদ সাহেব। সরকারি উকিলরা এখন তার এসব বক্তব্যের নিউজ, ভিডিও ক্লিপিংস এভিডেন্স হিসাবে কোর্টে জমা দেবেন। ট্রাইব্যুনাল আইনে এসব এভিডেন্সও গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধীদের উকিলদের সেটিই ভয়। কারণ আজ যাদের বিচার হচ্ছে- তাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হচ্ছে একাত্তরের ‘সংগ্রাম’ (জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র)পত্রিকার ফাইল।
সে কারণে গ্রেপ্তারের আগে আলী আহসান মুজাহিদ একবার বলেছিলেন, একাত্তরের ‘সংগ্রাম’-এর রিপোর্ট পত্রিকাটির রিপোর্ট। জামায়াতের রিপোর্ট না। যদিও সংগ্রাম পত্রিকার সঙ্গে জামায়াতের কোনও সম্পর্ক নেই’ ঈমানি কমজোরিতে এমন দাবি করতে পারেননি মুজাহিদ।
প্রতিবছর বিজয়ের এই ডিসেম্বর মাসে দেশজুড়ে অন্য একটি প্রবাহ থাকে। এ প্রবাহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষের পক্ষে। শহীদ-পরিবার, শহীদজননী-জায়া, শহীদের সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা-সহানুভূতির। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব বর্ণনার।
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের। বাস্তব পরিস্থিতি আঁচ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার, তাদের আন্ডাবাচ্চারাও এ সময় কিছুদিনের জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনের গর্তে গিয়ে ঢোকেন। এদের যে সারা বছর টাকা দিয়ে পোষা হয়, এরপরও কিন্তু বিজয়ের বিশেষ এই দিনটিতে গর্তের বাইরে রাখতে রাজি করানো যায় না! আগে জান বড়!
এবার সবাই মানবেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ প্রবাহটি এবার ছিল তুলনামূলক অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়াতে এ নিয়ে এতদিনের বিভ্রান্তির অনেকটাই এর মাঝে কেটে গেছে। সে জন্য এবার ১৬ ডিসেম্বরের জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে শুরু করে সারাদেশের পথে প্রান্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের বুলন্দ আওয়াজের মূল দাবিটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার। যে কারণে এবার স্বাধীনতা বিরোধীদের দল জামায়াত, তাদের দোসররা একটু বেশি গভীর গর্তে ঢুকেছিলেন।
এমন কি তাদের এখনকার মূল ভরসা খালেদা জিয়া পর্যন্ত এবার মুখে কলুপ এঁটে বসেছিলেন! যদিও সবাই জানেন ও মানবেন গর্তবাসীরা আবার বেরুতে শুরু করবে আবার শিগগিরই। এবার অবশ্য এর একটু দেরি বা ব্যত্যয় ঘটতে পারে।
এই দেরিটাও অবশ্য জামায়াতীদের স্বরচিত। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করার কথা হচ্ছিল বিজয় দিবসের আগে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর এ নিয়ে অন্য রকম জাতীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকায় তা বিলম্বিত করতে সমর্থ হন গোলাম আযমের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ‘খাজুর রাজাকার’।
ট্রাইব্যুনাল কোর্টকে তিনি বলেছিলেন, ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় থাকতে পারবেন না। তাই ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন মঞ্জুর করে গোলাম আযমের অভিযোগনামা আমলে নেবার তারিখ ঠিক করেছে ২৬ ডিসেম্বর। ধারণা করা যাচ্ছে এতে করে ২৬ ডিসেম্বর বা এর ২/১ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হবার সুযোগ ঘটবে সাবেক জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আজমের।
বহুল অপেক্ষার এই গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সৃষ্টি হবে বিশেষ একটি আবহের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের আরেক আনন্দ-স্বস্তির। বিজয় অনুভূতির। সরকার সত্যি সত্যি তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরবে না শীর্ষ ঘাতকের মানবাধিকার চিন্তায় তাকে বন্দী করে রাখবে তার বড় মগবাজারের ডেরায়?
বিএনপি কী জোটের অন্যতম শরীকের মুরব্বি নেতা বিবেচনায় এই শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতাবিরোধীর গ্রেপ্তারের নিন্দা করবে? না চুপ থাকবে? এসবের উত্তর জানার জন্যে মুখিয়ে আছে দেশের মানুষ।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১১